স্বাধীনতার লড়াইতে আর এস এস কোথায়?
আর এস এস-এর জন্ম ১৯২৫ সালে। প্রতিষ্ঠতা পাঁচ জন। সবাই হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার লড়াইতে এরা কোথায়?
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এদের বৃটিশ বিরোধী কোন ভুমিকা পাওয়া যায়নি। বৃটিশ বিরোধী লড়াইতে কঠিন আত্মত্যাগ অথবা জেল জীবন- এদের নেই। ১৯২৫ এ আর এস এস-এর জন্মের পর ১৯৪৭ পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কালে, মহাফেজখানা খুঁজেও এরকম কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছেনা। আর এস এসের মুখ্য পৃষ্টপোষক সাভারকার। সেলুলার জেলে বন্দী ছিলেন বহু আগে। ছাড়া পান ১৯২৪ সালে। তখনও আর এস এস জন্মায়নি। আর সেলুলার জেলে তার ভুমিকা – সেটাও ভয়ংকর।
সাভারকার সেলুলার জেলে গেলেন ১৯১১ এর ৪ঠা জুলাই। দু’মাসের মধ্যে, ৩০শে আগষ্ট, হাঁটু গেড়ে বৃটিশের কাছে মুচলেকা দিলেন – ‘Petetion for clemency’। এই চিঠির উল্লেখ করে দ্বিতীয় দরখাস্ত দিলেন ১৯১৩ এর ১৪ই নভেম্বর। কি লিখলেন? – ‘There fore, if the Government in their manifold beneficence and mercy re-lease me, I for one cannot but be the staunchest advocate of constitutional progress and loyalty to the English Government which is the foremost condition of that progress.’
লিখছেন- ‘I am ready to serve the Government in any capacity they like …………….Where else can the prodigal son return but to the parental doors of the Government?’
আবার চিঠি ১৯১৭ এবং ১৯২০ সালে। এছাড়াও দুটি চিঠির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯১৪ এবং ১৯১৮ সালে। যাই হোক, পর পর চিঠি। দরখাস্ত। ক্ষমাভিক্ষা। মুচলেকা।
১৯২০ সালের ৩০শে মার্চ চিঠিতে লিখলেন – ‘Written to the government in my petetions (1914, 1918) about my firm intention to abide by the constitution and stand by it as soon as a begining is made to frame it by Mr, Montagu. লিখলেন – ‘I am sincere in expressing my carnest intention of treading the constitutional path and trying my humble best to render the hauds of the British dominion a bond of love and respect and a mutual help. Such an empire as is foreshadowced in the proclamation, wins my hearty adherance.’
এই দরখাস্তেই তিনি লিখছেন যে তিনি এবং তার ভাই কথা দিচ্ছেন যে সরকার যা বলবে সেই সময়ের জন্যই তারা রাজনীতিতে অংশ নেবেন না। ‘এছাড়াও যদি সরকার চান যে আমরা আরো কোন শর্ত পালন করি, যেমন কোন বিশেষ এলাকার বাইরে যাওয়া চলবে না অথবা নির্দিষ্ট সময় অবধি পুলিশকে আমাদের গতিবিধি সম্পর্কে জানাতে হবে – রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য যে কোন যুক্তিসঙ্গত শর্ত পালন করতে আমরা প্রস্তুত।’
নির্লজ্জ আত্মসমর্পন। ক্ষমাভিক্ষা। মুচলেকা। কি নয়? ভারতের স্বাধীনতার লড়াইতে এরা লজ্জা। অথবা সেলুলার জেলের এরা কলঙ্ক। এ ছাড়া একে কি বলা যেতে পারে?
পরবর্তী সময়ের তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিং এর মনোভাবাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। বাবাকে চিঠি দিয়ে জানালেন নিজের দৃঢ আপোষহীন মনোভাব, বৃটিশ শাসকদের প্রতি জেল থেকে লেখা তার চিঠির অংশ – ‘আপনাদের হাতে ক্ষমতা আছে এবং ক্ষমতার সামনে পৃথিবীতে কোন রকম সাওয়াল জবাবের প্রয়োজন হয় না। আমরা তো জানি যে আপনারা ‘মাইট ইজ রাইট’ নীতিতে বিশ্বাষ করেন। আমাদের বিচারের পদ্ধতি থেকেই সেটা খুব পরিস্কার। আমরা শুধু এটাই বলতে চাই যে আপনাদের কোর্টের রায় অনুযায়ী আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম এবং তাই আমরা যুদ্ধবন্দি। আমরা চাই যে আমাদের সাথে যুদ্ধবন্দিদের মতনই ব্যবহার করা উচিত। অর্থাৎ আমরা চাই যে আমাদের ফাঁসি না দিয়ে গুলি করে মারা হোক।’
হরকিষাণ সিং সুরজিত তখন সদ্য তরুন। ১৯৩২ সালে হোসিয়ারপুর জেলে তেরাঙ্গা পতাকা তুলতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তারের পর যখন নাম জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি তার নাম বললেন – ‘লন্ডন তোড় সিং’। লন্ডনকে ভাঙতে চান। বৃটিশ বিরোধী মনোভাবের দুর্দান্ত স্পিরিট। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্থানের প্রতিফলন। আপোষ না, লড়াইয়ের প্রতীক যেন।
ভগৎ সিং কিংবা হরকিষাণ সিং সুরজিতদের আপোষহীন সংগ্রামী চেতনা, দেশপ্রেম আর লড়াইয়ের ঐতিহ্য নিয়েই কমিউনিস্টরা। দেশপ্রেমিক। দায়বদ্ধ।
সাভরকরদের ক্ষমাভিক্ষা ও পদলেহনের মনোভাব আর ঐতিহ্যকে বহন করেই আর এস এস এবং তার নিয়ন্ত্রিত সংগঠনসমূহ। দেশপ্রেমের ছিঁটেফোটা যাদের নেই। বিশ্বাষঘাতক। দেশদ্রোহী।
বস্তুতপক্ষে বিশের দশক কিংবা তিরিশের দশক জুড়েই কংগ্রেস তখন ব্যস্ত নানান ধরনের অসহযোগ, অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামকে জোরদার করতে। বিপ্লববাদীরা আপোষহীন, সহিংস আন্দোলনের তুফান তুলেছে। কমিউনিস্টরা সংঘটিত গণআন্দোলনকে ক্রমশই বেগবান করছে। অজস্র অসংখ্য বিক্ষোভ বিদ্রোহ আন্দোলনে উজ্জীবিত সংগ্রামের গতিধারায় ব্রিটিশের বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে।
আর উল্টো দিকে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা, মুচলেকা, আপোষ আর দালালীর কাজে ব্যস্ত। আর ব্যস্ত ছোট-বড় নানা ধরনের দাঙ্গা অথবা দাঙ্গার পরিবেশ সৃষ্টিতে। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনে ব্যস্ত তারা। সংবাদমাধ্যমের কিংবা সরকারি বিভিন্ন রিপোর্টে দাঙ্গা এবং দাঙ্গার পিছনে সঙ্ঘের ভূমিকার যথেষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে এরা বরাবরই ব্রিটিশের দালালিতে ব্যস্ত থেকেছে। এটাই বাস্তব।
বস্তুতপক্ষে সংঘের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গোলওয়ালকার, সাভারকারদের বিভিন্ন লেখা ও বক্তৃতায় বিভাজনের রাজনীতি এবং উস্কানি স্পষ্ট। যেন হিন্দু এবং মুসলমান আলাদা দুটি জাতি এবং বৈরিতামূলক জাতি। শাসক ব্রিটিশ নানা ধরনের বিভেদের রাজনীতি করেছে এদেশে। হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ, বিদ্বেষ এবং বৈরিতার নানান চেষ্টা করে গেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই। ব্রিটিশের তৈরি এই ফাঁদে রাজনৈতিকভাবে পা দিল সঙ্ঘ। বৃটিশের তৈরি করা ছকের ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে সঙ্ঘ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করল। চল্লিশের গোড়ায় একই ফাঁদে রাজনৈতিকভাবে পা বাড়ালো তৎকালীন মুসলিম লীগের জিন্না সাহেবরা। ১৯৪৩ সালের নাগপুরে সাভারকার বলেছিলেন “মিস্টার জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের সাথে আমার কোন কলহ নেই। আমরা হিন্দুরা, নিজেরাই একটা জাতি এবং এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে হিন্দু ও মুসলমানরা দুটো জাতি।” বৃটিশের উদ্দেশ্য সাধনের পথে সঙ্ঘের চাইতে বড় দোসর আর কেই বা হতে পার
সম্পূর্ণ লেখাটি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত হয়েছে…
আগামী পঞ্চমপর্ব…
ক্রমশ…