শিক্ষিত যুবদের কাছে এখনও একটা ভালো, নিরাপদ কাজ মানে সরকারি চাকরি। সরকারি চাকরির জন্য রেল সবসময়ই নিয়োগের একটা বড় ক্ষেত্র হিসাবে থেকেছে। লোকসভা ভোটের মুখে গত বছর রেলের লক্ষাধিক শূন্যপদে নিয়োগের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। চারটি ক্ষেত্র মিলিয়ে লক্ষাধিক শূন্যপদে নিয়োগের জন্য দেওয়া হয় বিজ্ঞপ্তি। এরমধ্যে সব থেকে বেশি ছিল গ্রুপ ডি বা লেবেল ওয়ান পদের জন্য, ১ লক্ষ ৭৬৯টি শূন্যপদ। এছাড়াও রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড নন টেকনিক্যাল পপুলার ক্যাটাগরি যা এনটিপিসি নামেই বেশি পরিচিত, তার জন্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি। দুটি বিভাগ মিলিয়ে মোট ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ২৭৭টি শূন্যপদে নিয়োগের কথা জানানো হয়। এরমধ্যে ১০ হাজার ৬২৮টি শূন্যপদে নিয়োগের কথা জানানো হয়েছিল যাদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ। জুনিয়র ক্লার্ক এবং টাইপিস্ট, অ্যাউন্টস ক্লার্ক, জুনিয়র টাইম কিপার, ট্রেন ক্লার্ক এবং কমার্শিয়াল ও টিকিট ক্লার্ক পদে আবেদন করার কথা জানানো হয়েছিল এই বিভাগে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা বলা হয়েছিল স্নাতক বা সমতুল। এরমধ্যে ট্র্যাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট, গুডস গার্ড, সিনিয়র কমার্শিয়াল এবং টিকিট ক্লার্ক, সিনিয়র ক্লার্ক, জুনিয়র অ্যাকাউন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, সিনিয়র টাইম কিপার, কমার্শিয়াল অ্যাপ্রেন্টিস এবং স্টেশন মাস্টার পদ ছিল। এই ক্ষেত্রে শূন্যপদ ছিল ২৪ হাজার ৬৪৯টি। একইসঙ্গে প্যারামেডিক্যাল ক্ষেত্রে রেলওয়ে ১৯৩৭টি শূন্যপদে নিয়োগের কথা ঘোষণা করে। এরসঙ্গে ছিল রেলওয়ে মন্ত্রক এবং আইসোলেটেড ক্ষেত্রের ১৬৬৫টি পদের জন্য নিয়োগের ঘোষণা। এরমধ্যে থেকে কিছু কিছু প্রত্যাহার করা হয়। যদিও সব মিলিয়ে গত বছর রেলে প্রায় দেড় লক্ষ নিয়োগের ঘোষণা ছিল। ভোট হয়েছে। মোদীর নেতৃত্বে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ফের সরকার গঠন করেছে বিজেপি। কিন্তু রেলে লক্ষাধিক নিয়োগের ঘোষণা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী, রেল মন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রী কেউই সরকারি শূন্যপদে নিয়োগের কথা নিয়ে কোনও কথা বলছেন না। ৩৭০ধারা, সিএএ-এনআরসি, হিন্দু-মুসলিম, মন্দির-মসজিদ, ভারত-পাকিস্তান এইসবেই ব্যস্ত রাখা হয়েছে দেশবাসীকে। বিশেষ করে তরুণদের। গত বছরে যে চারটি ক্ষেত্রে নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল তারমধ্যে প্যারামেডিক্যাল ক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য কম্পিউটার ভিত্তিক পরীক্ষা বা সিবিটি হয়েছে গত জুলাই মাসে। নথি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে কিন্তু তারপর নিয়োগের প্রক্রিয়া আর এগয়নি। মিনিস্টিরিয়াল আইসোলেটেড ক্যাটেগরির ক্ষেত্রে রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড পরীক্ষার কোনও দিনক্ষণ ঘোষণা করেনি। গত বছর জুন মাসে এই পরীক্ষার সিলেবাস ওয়েবসাইটে দিয়েছিল বোর্ড। তারপর থেকে আর কোনও কথা নেই। সবথেকে বড় দুটি নিয়োগ হওয়ার কথা গ্রুপ ডি এবং এনটিপিসি’র ক্ষেত্রে। যেখানে দুই কোটির বেশি আবেদন জমা পড়েছে। বছর পেরলেও পরীক্ষাই নেওয়া হয়নি। এরমধ্যে গ্রুপ ডি বা লেবেল ওয়ান পদের জন্য যে ১ লক্ষ ৩ হাজার ৭৬৯টি শূন্যপদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ১ কোটি ১৫ লক্ষ ৬৭ হাজার ২৪৮টি। আরআরবি-এনটিপিসি’র ৩৫ হাজার ২৭৭টি শূন্যপদের জন্য ১ কোটি ২৬ লক্ষ ৩০ হাজার ৮৮৫ জন ফরম পূরণ করে আবেদন জানায়। অর্থাৎ দুটি ক্ষেত্র মিলিয়ে প্রায় আড়াই কোটি আবেদন জমা পড়ে। কাজের সঙ্কট এবং কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বিপুল অংশের যুবরা যে সরকারি ক্ষেত্রের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে তার প্রমাণ এই সংখ্যা। জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই নিয়োগের জন্য পরীক্ষা হবে বলে জানানো হয়েছিল। তিনটি ধাপে পরীক্ষা হওয়ার কথা। কম্পিউটার ভিত্তিক পরীক্ষা বা সিবিটি, শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা এবং নথিপত্র যাচাই ও মেডিক্যাল পরীক্ষা। পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ। সেই পরীক্ষা হয়নি। সিবিটি হওয়ার পরে সেখান থেকে উত্তীর্ণরা পরবর্তী পরীক্ষাগুলির জন্য নির্বাচিত হবে। এই পরীক্ষা কবে হবে কিছুই জানাচ্ছে না রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ড। বিজ্ঞপ্তি জারি করার পর এক বছর হতে চলল, পরীক্ষা নিয়ে কোনও কথা আর বলছে না কেন্দ্রীয় সরকার। এখন অর্থ মন্ত্রীর বাজেট ভাষণের পরে চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে অন্য আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নির্মলা সীতারামন বলেছেন, সরকার ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি বা এনআরএ গঠন করবে। যা নন গেজেটেড নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নেবে। রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের এনটিপিসি এবং গ্রুপ ডি নিয়োগের পরীক্ষাও এর আওতায় আসবে। চাকরি প্রার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, ২০১৯ সালের এই পরীক্ষাও কী তাহলে ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি তৈরি হওয়ার পরেই হবে? তাহলে পরীক্ষা কবে হতে পারে তার কোনও নিশ্চয়তাই নেই কারণ ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিই এখনও তৈরি হয়নি। সবটা মিলিয়েই চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছেলেমেয়েরা গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। আবার এমন কথাও উঠছে যে নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি আগে প্রকাশিত হয়েছে, সরকারের এনআরএ ঘোষণার কথা পরে বলা হয়েছে। ফলে আগের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই পরীক্ষা অবিলম্বে নেওয়া প্রয়োজন। এরমধ্যেই আরও একটি গুরুতর বিষয় উঠে এসেছে। নিয়োগের আবেদনপত্র পূরণের সময়ে জেনারেল ক্যাটেগরি বা সাধারণ অংশের জন্য ফরম পিছু ৫০০টাকা করে দিতে হয়েছে। সংরক্ষিতদের জন্য ২৫০টাকা দিতে হয়েছে। যেখানে ফরমের জন্য একশো টাকা লাগত সেখানে ২৫০ বা ৫০০টাকা নেওয়া হয়েছে। সাধারণ বা সংরক্ষিত কতজন ফরম পূরণ করেছেন তা নির্দিষ্টভাবে না জানার কারণে ফরম পূরণ করে মোট কত টাকা সরকারের ঘরে এসেছে তা স্পষ্ট নয়। তবে কমবেশি এক হাজার কোটি টাকার কম নয় বলেই সাধারণভাবে বোঝা যাচ্ছে। চাকরি প্রার্থীরা সিবিটি দেওয়ার পরেই একশো টাকা কেটে বাকি টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। দেশজুড়ে আড়াই কোটি চাকরি প্রার্থীর পক্ষে একবারে আড়াইশো বা পাঁচশো টাকা দিয়ে দেওয়া সহজ কথা না। পরীক্ষা হয়ে গেলে নানান ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই টাকা ফেরত পাওয়াও বড় ঝঞ্ঝাট। পরীক্ষা না হওয়ায় সেই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত সরকার এই হাজার কোটি টাকা জমা রেখে সুদ পাচ্ছে। যত বেশিদিন টাকাটা জমা থাকবে সুদ আসতে থাকবে। সেই কারণেও পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে কোনও কোনও মহল থেকে। এটাকে একটা বড় দুর্নীতি বলেও চিহ্নিত করছেন তাঁরা। হাইলাইটস লোকসভা ভোটের আগে রেলে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি শূন্যপদ প্রায় দেড় লক্ষ আবেদনকারী আড়াই কোটির বেশি এক বছর পরেও জানানো হচ্ছে না পরীক্ষার দিনক্ষণ সরকার কী সত্যিই নিয়োগ করতে চায়, নাকি সবটাই ছিল ভোটের গিমিক? পরীক্ষার ফি বাবদ প্রায় হাজার কোটি টাকা ঢুকেছে সরকারের ঘরে উঠছে দুর্নীতির অভিযোগ…
রেলের নিয়োগে ১০০০ কোটি টাকার তছরুপ!!!
Spread the word