বর্তমান সমাজ কাঠামোয় আমরা প্রত্যেকে আয় করে থাকি অন্যের প্রয়োজনীয় জিনিস উৎপাদন করার মধ্যে দিয়ে। অর্থাৎ আমার শ্রমের সামাজিক উৎপাদনে ভূমিকা স্বীকৃত হওয়ার একমাত্র উপায় হল আমি যা উৎপাদন করছি, পণ্য বা পরিষেবা যাই হোক না কেন, তা অন্য কোনো মানুষ বা সংস্থা অর্থের বিনিময় কিনতে রাজি। এই একটি মাত্র উপায়ে সমাজে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে থাকি এবং আয় উপার্জনের মধ্যে দিয়ে এটা স্বীকৃত হয়। এই প্রক্রিয়া সার্বজনীন হওয়ার কারণে পুঁজিবাদে উৎপাদিত আয় ও সম্পদ বন্টনের একটি মাত্র উপায় হল নিজেদের শ্রমশক্তিকে সমাজে বিক্রয় যোগ্য করে তোলা, যাকে এক কথায় কর্মসংস্থান বলা হয়ে থাকে। কর্মসংস্থান শুধুমাত্র কাজ তৈরি করে না, একই সাথে সামাজিক আয় ও উৎপাদনের বন্টনের যুক্তি ও নৈতিক আধার তৈরি করে থাকে। আপনি কোনো না কোনো কাজ করে আয় করছেন এটাই সমাজের কাছ থেকে নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার নৈতিক আধার।
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। শিশু অথবা অসুস্থ মানুষ অথবা বৃদ্ধ মানুষ যাদের কর্মক্ষমতা নেই তাঁদের দায়িত্ব সমাজকেই নিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এই অংশের মানুষের সরকারের উপরে নির্ভরশীলতা সহজেই অনুমান করা যায়। সরকার যে নানা ধরনের কর ও করবর্হিভূত আয় অর্জন করে থাকে তার থেকে একটি অংশ ওই মানুষদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য ব্যয় করতে পারে। ওই নির্ভরশীল মানুষদের কাছে হস্তান্তরিত আয় আসলে নতুন কোনো উৎপাদনজনিত আয় নয়, বরং উৎপাদিত আয় ও সম্পদের এক ধরনের হস্তান্তর মাত্র। অর্থাৎ কর্মক্ষম উপার্জনশীল মানুষের থেকে নির্ভরশীল মানুষের প্রতি আয়ের হস্তান্তর। অতএব সমাজে মোট হস্তান্তরিত আয় সব সময় উপার্জিত আয়ের দ্বারা সীমিত। তার সম্ভাব্য পরিমান অনন্ত নয়। কর্মসংস্থান ও তার মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ না বাড়লে নির্ভরশীল মানুষের প্রতি সমাজের আয় হস্তান্তরের পরিমাণও ক্রমাগত কমে আসতে বাধ্য।
দ্বিতীয়ত, যে দৃষ্টিভঙ্গিটি এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তা হল কর্মসংস্থান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আয় বন্টনের একমাত্র উপায়। এই বন্টন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরী তার কারণ পণ্য ও পরিষেবা শুধুমাত্র উৎপাদন করলেই হবে না, এই উৎপাদনের কাজে যারা যুক্ত হয়েছেন তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার বিনিময়ে আসলে একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য বিনিময় মূল্য মানুষের পকেটে পৌঁছে দেওয়ার হয়। মজুরি বা বেতন হিসেবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের পকেটে অর্থ পৌঁছলে সমাজে উৎপাদিত পণ্য ও পরিষেবার ক্রেতা তৈরি করা সম্ভব হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও শ্রমিক শোষণে যে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয় তা মুনাফায় রূপান্তরিত হবে তখনই যখন উৎপাদক তার পণ্য ও পরিষেবা বাজারে বিক্রি করতে পারবে। বাজারের এই ক্রেতা তৈরি হয় কর্মসংস্থান ও তার থেকে আয়ের বিনিময়ে। আয়ের হস্তান্তর সমাজে চাহিদার রকম ফের ঘটাতে পারে কিন্তু নতুন আয় তৈরি করতে পারেনা। আসলে অর্থটা উপার্জনশীল মানুষের হাত থেকে সরকারের হাত হয়ে একজন নির্ভরশীল মানুষের পকেটে যায় মাত্র। ওই আয় নতুন কোন মূল্য সংযোজনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়নি। অতএব আমাদের সমাজে উৎপাদনে অংশগ্রহণকারী মানুষ এবং পণ্য পরিষেবার ক্রেতা এই দুয়ের মধ্যে খুব বেশি একটা পার্থক্য নেই। উৎপাদন সংগঠিত করার জন্য যেমন শ্রমিক দরকার, তা দক্ষ বা অদক্ষ যে ধরনেরই হোক না কেন, সেরকম ওই শ্রমিকের আয় সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়ে উৎপাদক তার ক্রেতা তৈরি করতে পারে। এই কারণেই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে বন্টনের সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সমাজে সৃষ্ট সম্পদ কিভাবে বন্টিত হচ্ছে তা অর্থনীতির বৃদ্ধির গতিকে নির্ধারিত করবে, আবার একই সাথে আর্থিক বৃদ্ধির মাত্রা বন্টনের প্রকৃতিকেও প্রভাবিত করবে। অতএব অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রশ্নটি একটা আনুষাঙ্গিক ব্যাপার নয়, কাউকে উপকার করার প্রশ্নও না, তা আসলে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক সময়ে কর্মসংস্থানহীন বৃদ্ধিও যাকে জবলেস গ্রোথ বলা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে বিপদের বিষয়টি হল বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ক ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসা। দেশের গরীব নিম্নবিত্ত মানুষের আয় বাড়লে তারা যে ধরনের জিনিস কিনবে তা আমাদের দেশের পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়িয়ে তুলবে। খাবার দাবার, জুতো জামা ওষুধপত্র, গেরস্থালি সরঞ্জাম, সাইকেল, টিভি, স্কুটার এসবের চাহিদা বাড়বে। আবার অন্যদিকে বড়লোকেদের আয় বাড়লে তাদের যেহেতু এই ধরনের জিনিসের চাহিদা প্রায় মিটে গেছে বললেই চলে, তাই তাদের আয় বৃদ্ধির ফলে যে ধরনের জিনিসের চাহিদা বাড়ে, তা মূলত আমদানি নির্ভর পণ্য ও পরিষেবা যা আমাদের দেশের উৎপাদকদের জন্য কোনও চাহিদা তৈরি করে না। এছাড়া ধনীদের আয় বৃদ্ধিতে আরেক প্রকার জিনিসের চাহিদা বাড়ে, তা হল ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাসেট যা তাদের ভবিষ্যতের আয়কে সুরক্ষিত করে। তারা জমির কাগজ কিনতে পারে, বিভিন্ন বন্ড বা কোম্পানির শেয়ার কিনতে পারে, মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে পারে ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটিতেই পণ্য ও সাধারণ ব্যবহার্য পরিষেবার অনুপাতে কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। অতএব দেশে বৈষম্য বাড়লে, আয়ের বেশিরভাগ অংশটি যদি পুঁজিপতিদের মুনাফায় রূপান্তরিত হয় তাহলে আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্পর্কটি ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসে।
২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা করেছিলেন বছরে দু’কোটি চাকরির ব্যবস্থা করবেন। অর্থাৎ গত দশ বছরে আমাদের দেশে কম করে কুড়ি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবটা হল, গত পাঁচ বছরে আমাদের দেশে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭০ লক্ষ ৩২ হাজারের মত। অর্থাৎ ২০১৬-১৭ সালে আমাদের দেশে কর্মরত জনসংখ্যা ছিল ৪১.৩ কোটি। ২০২২-২৩ সালে আমাদের দেশে কর্মরত জনসংখ্যা হল ৪০.৬ কোটি। এই একই সময়কালে আমাদের দেশে ১৫ বছর বয়সের উপরে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ কোটি ৭২ লক্ষ্য। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কর্মরত মানুষের সংখ্যা গত পাঁচ বছরে বিপুল পরিমাণে কমে গিয়েছে। এর সাথে লক্ষণীয় গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষের শ্রম বাজারে অংশগ্রহণ ক্রমাগত কমে এসেছে। দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার মাত্র ৪১-৪২ শতাংশ মানুষ শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করে থাকেন। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কর্মক্ষম মানুষ কর্মসংস্থানের আশাই হারিয়ে ফেলেছেন। ২০২২-২৩ সালে দেশের শ্রমবাজারে কাজের জন্য প্রত্যাশী বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩.৩ কোটি।
সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছর ধরে আমাদের দেশে গড় বেকারির হার ৪.৭ শতাংশ এবং উল্লেখযোগ্য হলো ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে বেকারির গড় হার ছিল ১৪.২ শতাংশ। শহরাঞ্চলে বেকারির হার তুলনামূলকভাবে বেশি, প্রায় ৭ শতাংশ। মনে রাখা দরকার যে আমাদের দেশে বিগত দশকগুলিতে গড় বেকারির হার ২-৩ শতাংশ ছিল। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ১৫ থেকে ২৯ বছরের শহুরে জনসংখ্যার মধ্যে বেকারির হার ১৮.৭ শতাংশ ছিল। শহরে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মহিলা কর্মপ্রার্থীদের মধ্যে বেকারির হার আরও বেশি, ২৪.৩ শতাংশ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’র তথ্য অনুযায়ী ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে গত পাঁচ বছরে গড় বেকারির হার ছিল ৩৪ শতাংশ। ওই সংস্থা দেশে প্রতিমাসের বেকারির তথ্য দিয়ে থাকে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমাদের দেশে গড় বেকারির হার ছিল ৮.১ শতাংশ, পুরুষদের মধ্যে এই গড় হার ছিল ৭.২ শতাংশ আর মহিলাদের মধ্যে ১৫ শতাংশ। শহরাঞ্চলে মহিলাদের মধ্যে বেকারির হার আরও বেশি ছিল ১৯.৭ শতাংশ। গত পাঁচ বছরে গড় বেকারি ৭ শতাংশের কাছাকাছি হলেও স্নাতক ও তার চেয়ে বেশি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে বেকারির হারের গড় ছিল ১৬ শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের ডিপ্লোমা ও টেকনিকাল সার্টিফিকেট হোল্ডারদের মধ্যে গড় বেকারির হার ছিল ১৪.২ শতাংশ।
বেকারির এই ভয়াবহ হার ভারতবর্ষের আজকের সময়ে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক এই কারণে যে, আমাদের দেশের জনসংখ্যার এখন বেশিরভাগ মানুষই অল্পবয়সী। আমাদের দেশের জনসংখ্যার গড় বয়স এখন ২৮.৪। পৃথিবীর মোট যুববয়সী মানুষদের একের পঞ্চমাংশ ভারতে বসবাস করেন। যে কোনও দেশের জনসংখ্যার বিন্যাসে যখন বেশিরভাগ মানুষ অল্প বয়সী হয় তখন সেই মানুষকে কাজে লাগিয়ে সেই দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তার কারণ জনসংখ্যায় নির্ভরশীল মানুষের অনুপাত কম থাকে। আমাদের দেশে বর্তমানে ১৫ থেকে ৫৯ এই বয়সের কর্মক্ষম জনসংখ্যা হল মোট জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ। অবশ্য জনসংখ্যার এই বিশেষ সুবিধাজনক পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির গতি দ্রুত করার সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব তখনই, যখন অল্পবয়সী মানুষদের কাজে নিযুক্ত করা সম্ভব হয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই জনসংখ্যার বিন্যাসের সুবিধা আগামী দেড় দশক পর্যন্ত থাকবে। তারপরে ধীরে ধীরে নির্ভরশীল জনতার অনুপাত বাড়তে থাকবে। কিন্তু অল্পবয়সী মানুষের অনুপাত বেশি হওয়া সত্ত্বেও কার্যত নির্ভরশীল জনতার অনুপাত বৃদ্ধি পাওয়ার অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে আমাদের দেশে। কারণ অল্পবয়সী যুবক-যুবতীরাও বৃদ্ধ ও শিশুদের মতই ক্রমাগত নির্ভরশীল জনতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। তাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাজ নেই এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বাবা-মা বা পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এই অবস্থাটি যে কোন দেশের ক্ষেত্রেই লজ্জাজনক।
এর ফলে দেশে আয় বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৫০ শতাংশ মানুষের চেয়ে ২০ গুন বেশি আয় করে থাকে। দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৫৭ শতাংশ এই ধনী ১০ শতাংশের অধিকারে, আর ৫০ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ অর্ধেক ভারতবাসীর অধীনে দেশের জাতীয় আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ। এই বৈষম্য বৃদ্ধির নানা কারনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল আমাদের দেশের আর্থিক বৃদ্ধির ধরন। ধনীদের মুনাফার পরিমান ক্রমাগত বেড়ে চলেছে আর অন্যদিকে বিপুল অংশের মানুষের প্রকৃত মজুরি গত এক দশক ধরে প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছে, আর অন্য দিকে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে বেকারি।
এইটাই অনুদানের রাজনীতির বিস্তৃত পরিসর তৈরি করছে। নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা যত বাড়ছে সরকারি হস্তান্তরের মাধ্যমে ন্যূনতম বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, জ্বালানি, বাসস্থান ইত্যাদির ন্যূনতম সংস্থানের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা সব ধরনের শাসকদলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাড়ির নতুন প্রজন্মের সদস্যরা যখন কর্মহীন, আমাদের মত দেশে বিশেষত যেখানে বৈষম্য ক্রমবর্ধমান, সেখানে বাকি পরিবারের সদস্যদের খাবারের সংস্থানও সংকটগ্রস্থ হয়ে পড়ে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন গর্বের সাথে ঘোষণা করেন যে ৮০ কোটি মানুষ আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত, এটা আদৌ খুব একটা আনন্দের বিষয় নয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর বাদে দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ যদি ভাত, রুটির জন্য সরকারের ওপরে নির্ভরশীল হয়, তার মানে দেশের বেশিরভাগ মানুষই তাঁদের নিজেদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার সংস্থান করার মত জায়গায় নেই। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার তাই সরকারি কোষাগার থেকে বিভিন্ন অংশের মানুষের জন্য নানা ধরণের অনুদানের ব্যবস্থা করে চলেছে। একদিকে সার্বজনীন অধিকারগুলি খর্ব করে গত তিন দশক ধরে সরকারি ব্যয় সংকোচ চলছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিস্ফোরণ রুখতে নানা ধরনের অর্থ হস্তান্তরের স্কিম চালু করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে আম্বানি-আদানিদেরদের কর ছাড় দেওয়ার চাইতে সরকারি কোষাগার থেকে কোনোভাবে যদি গরিব মানুষদের পকেটে অর্থ সরকারি অনুদানের মাধ্যমে যায় তা অবশ্যই স্বাগত ও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু একথাও মনে রাখা দরকার কাজের মাধ্যমে আয় ও অনুদানের মধ্যে দিয়ে জীবন চালানোর একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। অনুদানের পয়সা মানুষের করের টাকা থেকে এলেও এই অর্থ যেহেতু কোন কাজের বিনিময় অর্জিত নয় তাই এই আয়ের সাথে কোন দাবি বা অধিকারের সম্পর্ক নেই। তাই অনুদানের অর্থ কমে গেলে বা বন্ধ হয়ে গেলেও এর পক্ষে কোন সামাজিক মতামতের কলরব শুনতে পাওয়া যায় না। মানুষ মনে করে যেটা পাচ্ছিলাম সেটাই অতিরিক্ত, না পেলে দাবি করার কিছু নেই। অতএব একটা বিপুল অংশের মানুষের বাঁচার আকাঙ্খাকে একটি ন্যূনতম মাত্রায় সীমিত করে রাখা সম্ভব হয় অনুদানের রাজনীতির মধ্যে দিয়ে। এই বিপুল সংখ্যক জনতার রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত।
সমাজে রাজনৈতিক অধিকার শুধু ভোটদানের মধ্যে দিয়ে কার্যকরী হয় না, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও তার মধ্যে দিয়ে নিজেদের প্রাপ্যকে সুনিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে। এটা বাদ দিয়ে প্রতি ভোটে আপনি পছন্দমত কোন দলকে নির্বাচিত করতেই পারেন কিন্তু ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাজের কাছ থেকে আপনার কিছু প্রাপ্য প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন। দেশের বেশিরভাগ মানুষকে যদি ক্রমাগত নির্ভরশীল করে তোলা যায় তাহলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয় শাসকশ্রেণীর কারণ তারা বিপুল সংখ্যক গরিব জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। অনুদানের রাজনীতির সুবিধা হল মানুষ কর্মহীনতার পরিপ্রেক্ষিতে যা পাচ্ছে তাতেই খুশি থাকে। মানুষের আর্থিক অবস্থা যত খারাপ হবে তত কম অনুদানেও সে খুশি হতে বাধ্য হবে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আসলে জনসংখ্যার মধ্যে একটা কাঠামোগত বিভাজন প্রকট হতে থাকবে। একদল মানুষ যারা শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছে তারা যেখানে কাজ পাবে সেখানে চলে যাবে। আরেক দল বিস্তীর্ণ অংশের মানুষ যাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি কেনার ক্ষমতা নেই, ক্রমাগত বেসরকারিকরণের কারণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা বা দক্ষতা অর্জন করার সুযোগও নেই, সেই মানুষ ক্রমাগত তলানির দিকে চলে যাবে। কাজ নেই, মানে সামাজিক সম্পদ তৈরি করায় কোন অংশগ্রহণের স্বীকৃতি নেই, তার মানে শিরদাঁড়া সোজা করে সমাজ থেকে কিছু দাবি করার নৈতিক অধিকারও এ সমাজে থাকে না। সমাজের সুস্থ সবল প্রাণবন্ত যৌবনকে যারা বৃদ্ধ বা শিশুদের মত নির্ভরশীল করে রাখতে চায় তারা আসলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে অধিকারের নৈতিকতাকেই খতম করতে চাইছে। এই শিরদাঁড়া ভাঙা সমাজ নির্মাণের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে হবে। দেশের আশি ভাগ মানুষ ভাতের জন্য সরকারের উপরে নির্ভরশীল - এটা একেবারেই ‘অমৃতকাল’ নয়। সেটা তখনই হবে যখন আমাদের দেশের প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষ নিজের বাঁচার সংস্থান তাঁরই যোগ্যতার ভিত্তিতে নিযুক্ত কাজের বিনিময়ে আয় করার মধ্যে দিয়ে নিজেই করতে পারবেন।