Ahmedabad Plane Crash

ডবল ইঞ্জিন বিপর্যয় : প্রশ্নে উড়ান সুরক্ষা

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস

ড্রিমলাইনার আর স্বপ্নের উড়ানের নাম নয়. বরং দেশের মানুষের চোখে দুঃস্বপ্নের উড়ান হয়ে উঠেছে এই উচ্চপ্রযুক্তির অভিজাত বিমান ড্রিমলাইনার। আমেরিকার বোয়িং সংস্থার তৈরি এই বিমানের অন্যতম আধুনিক সংস্করণ ড্রিমলাইনার B-787-8 দিনে দুপুরে ভেঙে পড়েছে আমেদাবাদ বিমানবন্দরে আকাশে ওড়ার অব্যবহিত পরেই। ৬৮৫৯ কিলোমিটার দূরত্বের লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যে পেটের মধ্যে প্রায় সোয়া লক্ষ লিটার জ্বালানি ভরা ওই বিমান আমেদাবাদ বিমানবন্দর লাগোয়া মেঘানি এলাকায় এক বহুতল ডাক্তার হোস্টেলের ওপর ভেঙে পড়ায় বিমানের যাত্রী থেকে বিমান কর্মী , পড়ুয়া থেকে পথচারী সমেত নিহত হয়েছে ২৬৪ জন। সেই অর্থে এটি স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় বিমান বিপর্যয় । স্বভাবতই এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোকাহত মানুষের মনে তৈরি হয়েছে হাজারো প্রশ্ন তার কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়েই।

This image has an empty alt attribute

ড্রিমলাইনারের ব্ল্যাকবক্স

এদেশে পথ দুর্ঘটনায় প্রতি ৪ মিনিটে একজন করে মানুষ প্রাণ হারায় কিন্তু বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রতি ১০ লক্ষ উড়ানের একটি যদি দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে সেটি হয়ে ওঠে আতঙ্কের বিষয়, বিপদের মাপকাঠি। ইতিমধ্যে এই বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সবাই চেয়ে রয়েছেন বিমানের ব্ল্যাকবক্সের দিকে। ব্ল্যাকবক্স হলো সেই সুরক্ষিত প্রযুক্তিনির্ভর কাঠামো যার মধ্যে বিমান চালনা সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য এমনকি বিপর্যয়ের আগে ককপিটে চালক , সহচালকের কথোপকথন নথিভূক্ত করা থাকে। এই প্রেক্ষিতে দুর্ঘটনাগ্রস্থ বিমান ড্রিমলাইনারের ব্ল্যাকবক্স থেকে যেমন বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান জরুরী তেমন জরুরী ড্রিমলাইনার সৃষ্টির ইতিহাস অন্বেষণ এই সুরক্ষা বিতর্কের প্রেক্ষিতেই।

কারণ এই অভিজাত বিমান তৈরীর শুরুর দিন থেকেই সেটির সুরক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সেই বোয়িং সংস্থার এক মার্কিন সুরক্ষা আধিকারিক জন বার্নট । বার্নটের তোলা বহু অভিযোগের মান্যতা স্বীকার করে আমেরিকার উড়ান নিয়ন্ত্রন সংস্থা ফেডারেল এভিয়েশন এজেন্সি ( FAA) অবধি মান্যতা দিয়েছিল। কিন্তু পুঁজির দাপটে প্রযুক্তির আপোষের পথ খোলা রেখেই বিমান নির্মাণকারী সংস্থা বোয়িং , বার্নটের তোলা বহু অভিযোগ উপেক্ষা করেই তাদের অভিজাত ড্রিমলাইনার মডেল বাজারে ছেড়েছিল । বিশেষত বোয়িং বিমান সুরক্ষার ক্ষেত্রে তার হাইড্রোলিক সিস্টেম, জ্বালানি প্রবাহ , তার ডানা মেলা ব্যবস্থা সম্পর্কে অতীতে যে যে অভিযোগ উঠেছিল সংস্থার কর্মীদের থেকেই কার্যত তার অধিকাংশ এবারের ড্রিমলাইনার বিপর্যয় বিতর্কে সামনে এসেছে। এমন প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সেই হুইসিল ব্লয়ারের রহস্যজনক মৃত্যু ঐ বিমানের যান্ত্রিক সুরক্ষা নিয়ে আরও বেশি সন্দেহ দানা বাঁধাচ্ছে। ড্রিমলাইন বিমানের সুরক্ষা নিয়ে উৎকণ্ঠা কেবল সেই সংস্থার কর্মী আধিকারিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উপরন্তু এদেশের যোজনা কমিশন ওই প্রযুক্তিগত সুরক্ষার খামতির কারনে ড্রিমলাইনার কেনায় আপত্তি জানিয়েছিল। এতদসত্ত্বেও সেই বিতর্কিত বিমান কেনা চূড়ান্ত হয় সরকারি উড়ান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য।

নগরায়নের গ্রাসে বিমানবন্দর

দেশে-বিদেশে বিমান বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হল বিমানের ইঞ্জিন বিকল হওয়া। বিমান ওঠা কিংবা নামার সময় অল্প উচ্চতায় বিমানের ইঞ্জিনে পাখির ধাক্কায় ইঞ্জিন বিকল হওয়াও বিমান দুর্ঘটনার এক অন্যতম কারণ। সেই নিরিখে এদেশের জনবহুল শহরের মধ্যে অবস্থিত বিমানবন্দরগুলিতে এমন বিপদ তুলনায় বেশি। বিমান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিমানের ওঠা (টেক অফ ) কিংবা নামার (ল্যান্ডিং) পর্বেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি তুলনায় বেশি। ফলে বিমানের রানওয়েতে ওঠা নামার উড়ান পথ জুড়ে কোন প্রতিবন্ধকতা কাম্য নয় বিমান সুরক্ষার স্বার্থেই। কিন্তু এ সত্ত্বেও দেশের আইনের ফাঁক গলে বাজার অর্থনীতির হাত ধরে বিমানবন্দর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই গড়ে উঠছে জনবসতি এবং বহুতলের সারি। বেড়ে চলেছে বিমানবন্দরের আশেপাশের জমির দাম এবং জনঘনত্ব। এখানে উল্লেখ্য বিমানবন্দর যেমন কলকাতায় চালু হয় ১৯২৪ সালে তেমনি আমেদাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৭ সালে। ফলে শতাব্দী প্রাচীন এমন বিমানবন্দরগুলি প্রতিষ্ঠালগ্নে সেগুলি শহরের উপকণ্ঠে থাকলেও বাজার নির্ভর নগরায়নের দাপটে সেগুলি উত্তরোত্তর মূলনগরের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ফলে রানওয়েতে বিমানের ওঠা নামার পথে বাড়ি কিংবা নির্মাণ কাঠামোর উচ্চতার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ন্ত্রণ জারি থাকলেও বিমান চলাচলের সার্বিক নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হচ্ছে ।

This image has an empty alt attribute

বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে সেখানে বাড়ছে দোকান বাজার কিংবা জঞ্জালের স্তুপ , যেগুলি পাখিদের বেড়ে ওঠার অন্যতম কারণ। ফলের বিমানবন্দর সংলগ্ন জমিতে জনঘনত্ব বাড়ার কারণে কাক, চড়াই থেকে শুরু করে চিল, শকুন জাতীয় পাখির সংখ্যা বাড়ছে। আর কালে কালে সেগুলি হয়ে উঠছে বিমান যাত্রার অন্যতম বিপদ। এই প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের বিমান সুরক্ষার ক্ষেত্রে এ দেশের জনবহুল শহরগুলিতে বিকল্প বিমানবন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা জরুরি। এরাজ্যেও কলকাতার উপকণ্ঠে ভাঙড়ে বামফ্রন্টের সময় যে বিকল্প বিমানবন্দরের গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেটি বাতিল করতে হয় জমিজটের কারণে। আর সেই জমিজটের ঘোঁট পাকিয়েছিল রাজ্যের তৎকালীন বিরোধী জোট , যেমনটা ঘটেছিল সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের শিল্পায়ন রুখতে।

বিমান : প্রযুক্তির স্বনির্ভরতা

বিমান পরিবহনের ক্ষেত্রে বিমানের যান্ত্রিক সুরক্ষা যাচাই সবচেয়ে জরুরী । মনে রাখতে হবে উন্নত প্রযুক্তির অভিজাত গাড়ি, ট্রেন কিংবা বিমান সবেরই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ কর্মী বাহিনী ও উপযুক্ত প্রযুক্তি পরিকাঠামো। অথচ বাণিজ্যের কারণে ওই চড়া দামের ড্রিমলাইনার বিমান কেনার পর সেগুলিকে দিনে কম করে ১৭-১৮ ঘণ্টা ছুটতে হয় যাত্রী নিয়ে। ফলে সারাদিনে যাত্রী ও পন্য ওঠানামার পর হাতে থাকা নামমাত্র যতটুকু সময় মেলে তাতেই সারতে হয় বিমানের সবচেয়ে জরুরি সুরক্ষা যাচাইয়ের কাজ। ফলে এমন রুটিনে বিমানের সুরক্ষা যাচাইয়ের মান নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়। যেমনটা উঠে থাকে বন্দেভারত কিংবা শতাব্দী এক্সপ্রেস জাতীয় ট্রেনগুলির রক্ষনাবেক্ষনের ক্ষেত্রেও। মনে রাখতে হবে

ড্রিমলাইনার বিমান তৈরি হয় নটি দেশের থেকে আমদানি করা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ দিয়ে। এমন একটি বিমানে সিটবেল্ট থেকে উইন্ড স্ক্রিন কিংবা ইঞ্জিন থেকে চাকার মতো তেইশ লক্ষ যন্ত্রাংশ প্রয়োজন একটা আস্ত বিমান তৈরি করতে। এমন যন্ত্রাংশগুলি একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। ফলে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে যে বিমানতৈরিতে যেমন বিপুল যন্ত্রাংশের মেলবন্ধন প্রয়োজন তেমনি তার সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে প্রয়োজন উচ্চপ্রযুক্তি এবং উপযুক্ত সংখ্যার দক্ষ কর্মী বাহিনী । কিন্তু এদেশে বিমান মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ৯০% নির্ভরশীল আমদানি করা প্রযুক্তি সম্বলিত যন্ত্রাংশের উপরে। এমন প্রেক্ষিতে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন ছিল আমাদের অভিষ্ঠ লক্ষ্য। অথচ আত্মনির্ভর ভারত কিংবা ‘ Make in India’ গড়ার বিজ্ঞাপনী ডাক দিয়ে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে এক ইঞ্চিও এগোতে পারেনি দেশ গত দশ বছরে। ফলে এদেশে উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রাংশের ব্যবহার বাড়লেও তার সুরক্ষা কিংবা ত্রুটিবিচ্যুতি সঠিকভাবে যাচাইয়ের স্বনির্ভর ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি এদেশে। ফলে এমন উচ্চপ্রযুক্তির বিমান আকাশে ওড়ার পর কোন পূর্বাভাস ছাড়াই তিরিশ সেকেন্ডে ভেঙে পড়লে সেটির সুরক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বৈকি !

This image has an empty alt attribute

বেসরকারি হাতে সুরক্ষিত এয়ার ইন্ডিয়া ?

ইতিমধ্যে ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন পাখির ধাক্কায় বিমানের ইঞ্জিন বিকল্পের সম্ভাবনা খারিজ করেছে। ফলে ইঞ্জিন বিকলের ক্ষেত্রে বিমানের অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক গোলযোগের পাল্লাই ভারী এই মুহূর্তে । কারণ দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমান চালক যথেষ্ট দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ছিলেন। ফলে সেক্ষেত্রে চালকের বিমান চালনার ত্রুটির সম্ভাবনা যথেষ্টই কম। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রকাশিত যে এদেশে বিমান চালানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে বিমানের ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা এবং সুরক্ষা । এছাড়াও বিমান সারাইএর যন্ত্রাংশের যোগান। সাম্প্রতিক কালে বিমানের ইঞ্জিন খারাপের কারণে বহু ক্ষেত্রেই বিমান সংস্থাগুলিকে সুরক্ষার স্বার্থে উড়ানের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হয়েছে। ফলে উত্তরোত্তর অলাভজনক হয়ে উঠেছে সেই পরিষেবা ।

ইতিমধ্যে বাজার অর্থনীতির পথ ধরে সরকারি উড়ান সঙ্গস্থা ‘ এয়ার ইন্ডিয়া ‘ বেসরকারি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। উপরন্তু দেশের সরকারি নীতি অনুযায়ী দেশের ছোট বড় যাবতীয় বিমানবন্দরগুলির সুরক্ষা ও পরিষেবার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে শাসকঘনিষ্ঠ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির হাতে। এক্ষেত্র আমেদাবাদ বিমানবন্দরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সরকার ঘনিষ্ঠ আদানির সংস্থাকে ও বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া সরকারের থেকে জলের দরে কিনেছিল টাটা গোষ্ঠী। ফলে পরিসেবা সরকারি থেকে বেসরকারি হাতে গেলে পরিষেবা যে ম্যাজিকের মতো উন্নত সুরক্ষিত হবে এই ধারণা ভেঙে দিল আমেদাবাদের বিমান বিপর্যয় । ড্রিমলাইনার বিমানের দুর্ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে রেল থেকে বিমান, বাণিজ্যের খাতিরে বেসরকারি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটলেও যাত্রী সুরক্ষা ও স্বাচ্ছন্দের ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি জরুরি। বেসরকারি সংস্থা দায়বদ্ধ লাভের কড়ি দ্রুত ঘরে তুলতে । ফলে সেক্ষেত্রে কর্মী সংকোচন কিংবা সুরক্ষার ক্ষেত্রে এমন বেসরকারি সংস্থাগুলিকে দায়বদ্ধ রাখতে প্রয়োজন সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ। সেটাই হবে আমেদাবাদের ডবল ইঞ্জিন সরকারের আমলে বিমানের ডবল ইঞ্জিন বিপর্যয় থেকে মোক্ষ লাভ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন