নীলোৎপল বসু
সে অনেক দিন আগের কথা। স্বাধীনতারও আগে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যান্টনি ইডেন মন্তব্য করেছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে কোন পথে ভারত হাঁটতে চলেছে সেই প্রসঙ্গে। ইডেনের সুর ছিল সদর্থক। ভারতের নেতারা এমন একটা রাস্তায় হাঁটতে চলেছেন যা অভুতপূর্ব। অবশ্যই ইঙ্গিতটা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র নির্মানের দিকে। প্রধানমন্ত্রী ইডেন স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেন এতো বিশাল জনসংখ্যার এবং এতো বৈচিত্র্যের কোনো দেশে এই মাত্রার প্রয়াস অশ্রুতপূর্ব।
ইডেনের অনুমান যে খুব একটা ভুল ছিলো না, তার প্রামানিকতা কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখ। অন্ততঃ ২০১৪ পর্যন্ত। প্রায় সাত দশক নিরবিচ্ছিন্নভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে স্বাধীন দেশগুলোতে সামরিক শাসন বা আমলাতান্ত্রিক স্বৈরশাসন কলঙ্কিত না হবার এই উদাহরণের কোনো সমান্তরাল অভিজ্ঞতা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অবশ্য এই কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে সংবিধান এবং আইনের শাসনের সার্বভৌমত্বের এই স্বীকৃতি কন্টকহীন ছিল। বিশেষতঃ সত্তরের দশকের দশকের জরুরি অবস্থা। আর পশ্চিমবঙ্গে তার আগে সত্তরের দশকের শুরুর থেকেই নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস।
কিন্তু ঐ সময়ের যে বিকৃতি গণতন্ত্রকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল মানুষ তার বিপুল জনসমাবেশে প্রতিহত করে এবং ১৯৭৭ সালে নির্বাচনে তারা ঐ বিকৃতি সংগঠিত করেছিল তাদের পর্যুদস্ত করেছিল। জণগনের অংশগ্রহণে সেই প্রতিরোধ এতোটাই কার্যকর হয়েছিল যে ওই স্বৈরাচারী রাজনীতির প্রবক্তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য জণগনের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য। সাময়িক সেই বিকৃতি কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে ভারতের গণতন্ত্র দুর্ভেদ্য নয়। সুতরাং গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা অবিভাজ্য
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম দেশের মানুষকে শিখিয়েছে ঐক্যবদ্ধ হতে। ধর্ম -বর্ণ-ভাষা- সংস্কৃতি নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে। সেই জন্যই দেশ স্বাধীন হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ঐক্যও একইরকমভাবে জরুরি। নতুন সংবিধান তাই স্পষ্ট ঘোষণা করেছিল যে সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের থাকবে স্বধর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। শুধু তাই নয়, সমস্ত ধর্মের মানুষের থাকবে সমান অধিকার। আর এর যে সমস্ত মানুষের ঐতিহাসিক ভাবে সামাজিক কাঠামোর জন্য, সামাজিক বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে , স্বাধীন রাষ্ট্র সেই বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি দিতে সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্যে সাংবিধানিক এবং আইনি রক্ষাকবচ।
গণতন্ত্রের সাম্প্রতিক বিপন্নতা
সত্তরের দশকের বিকৃতির পর নতুন করে বিপন্ন হয়েছে ভারতের গণতন্ত্র। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠার পর।
যে কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে অবাধ নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। সংবিধান সমস্ত বৈধ ভোটারদের ভোট দেবার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় সমস্ত স্বীকৃত রাজনৈতিক দলকে বৈষম্যমুক্ত সুযোগ। আর এই সমস্ত নীতিগুলিকে কার্যকর করবার জন্য স্বাধীন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবার সাংবিধানিক রক্ষাকবচ।
২০১৪ সালের পর যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আঘাত আসে নির্বাচনী খরচের জন্য গোপন কর্পোরেট চাঁদার আইনি ব্যবস্থা। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কোনো সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়নি কর্পোরেট চাঁদার। এই আইনি পরিবর্তন শুধু যে শাসক দলের হাতে সীমাহীন অর্থের যোগান নিশ্চিত করল তাই নিশ্চিত করল তাই নয়, যে কর্পোরেটগুলো চাঁদা দিয়ে ভোটে জিততে সাহায্য করল, তাদের মধ্যে পারস্পরিক দেওয়া নেওয়ার একটি সম্পর্ককেও বৈধতা দিয়ে দিল।
এই গোপন চাঁদা যে শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে বিকৃত করল তাই নয়, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলবদলের জন্য এই বিপুল অঙ্কের অর্থের ব্যবহারের রাস্তা খুলে দিল। সেই জন্যই এই আইন পরবর্তি পরিস্থিতিতে শুধু যে নির্বাচনে খরচের বহর একটি অশালীন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে তাই সরকার ভাঙ্গা গড়ার লক্ষ্যে কদর্য প্রকাশ ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সাথে সাথেই কর্পোরেট স্বার্থবাহী, বিশেষতঃ সরকার ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক আধিপত্যও স্পষ্ট।
মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার যে লক্ষ্যের প্রতি সংবিধানের ঘোষণা তা কার্যত অন্তর্হিত। সংসদের প্রতি যে অবজ্ঞা সাম্প্রতিক কালে সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য বৈশিষ্ট্য তার প্রধান কারণ এই আইনি পরিবর্তনের মধ্যেই নিহিত । সিবিআই বা ইডির মতো আইনি ভাবে স্বাধীন সংস্থাগুলোর যতেচ্ছ অপব্যবহার সাম্প্রতিক একটি ক্রমবর্ধমান প্রবনতা।
এর সঙ্গে সংবিধানের অন্য মৌলিক বৈশিষ্ট্য ধর্মনিরপেক্ষতার উপর নেমে এসেছে তীব্র আক্রমণ। অতীতে সব সময়েই সাম্প্রদায়িকতার চ্যালেঞ্জ কম বেশি হাজির থেকেছে। বিশেষ করে নির্বাচনী সাফল্য নিশ্চিত করতে। কিন্তু এখনকার এই আক্রমণ মৌলিকভাবে আলাদা। প্রত্যক্ষভাবেই সংবিধানের মৌলিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটা বদলে দেবার জোরালো প্রচেষ্টা নিয়ে।মূল লক্ষ্য হিন্দু ধর্মীয় পরিচিতির জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে নাগরিকত্বের চরিত্র'র দল মত জাত ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল তা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগারে যে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ আর নাগরিক তার মূলেই টান পড়েছে। ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ আর জাতি রাষ্ট্র এই ধারণা আমাদের সংবিধানে জায়গা পায় নি। আর এখন হিন্দুত্ব তাড়িত কর্পোরেট -সাম্প্রদায়িক জোট তাই উঠে পড়ে লেগেছে, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র নির্মানের লক্ষ্যে। মানবাধিকার আর নাগরিক স্বাধীনতা যে তীব্র আক্রমণের শিকার তাতো বলাই বাহুল্য! নতুন যে তথাকথিত সংহিতার খসড়ার প্রস্তাব সামনে এনেছে সরকার সংবিধানের মৌলিক সমস্ত ভিত্তিগুলির বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের ভূমিকা নেবে তাও স্পষ্ট।ফলে এটাও পরিস্কার যে গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ সামগ্রিকভাবে সংবিধানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা। আর দেশে বিদেশে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররাও ভারতের শাসনকে ' নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র ' হিসাবে।
উত্তরণের পথ
এটা স্পষ্ট, গণতন্ত্রের বিপন্নতা এবং চ্যালেঞ্জের উৎসমুখ সরকার। আরএসএসের পরিচালনাতেই চিত্রনাট্য। কুশীলব কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক জোট। তাদের পোষিত সংবাদ মাধ্যম। মূলস্রোতে, সামাজিক মাধ্যমে।
স্বভাবতই উত্তরণের সংগ্রামের অভিমুখও তাই নির্দিষ্টভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে। ব্যাপকতম ঐক্যের ভিত্তিতে সমাবেশ। জনগণের। যে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি এই সংগ্রামের শরিক হতে চায় তাদের সবাইকে শামিল করেই এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যারা দোদুল্যমান, যারা শেষ পর্যন্ত যাবার মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারবে না, সেটা চলার পথেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু সেইজন্য ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা এবং এই যাত্রাপথের অভিমুখ মিথ্যে হয়ে যাবে না। বরং ঐক্যের প্রয়োজন তার নিজস্ব গতিবেগ আর শক্তি উৎপাদন করবে।