রাজ্যের আদিবাসী জনগণের আর্থ সামাজিক অবস্থার করুণ বেহাল চিত্র উঠে এসেছে প্রতীচী ট্রাস্ট এবং এশিয়াটিক সোসাইটির যৌথ সমীক্ষাপত্র ‘লিভিং ওয়ার্ল্ড অফ আদিবাসীস অফ বেঙ্গল’। বুধবার এশিয়াটিক সোসাইটিতে গবেষণা পত্রটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
সমীক্ষাপত্রের ভূমিকায় অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘তৃতীয় খ্রীষ্টপূর্বের শাসক অশোক চিহ্নিত করেছিলেন বনবাসী জনগণের অধিকার সম্পর্কে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় মনোযোগ খুবই কমই বাস্তবায়িত হয়েছিল’। অমর্ত্য সেন ভূমিকাতে লিখেছেন আদিবাসী জনগণের বঞ্চনা, পিছিয়ে থাকার যাবতীয় সমস্যা দূর করা সম্ভব যদি তাঁদের দৈনন্দিন জীবন ও যাপনের সমস্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে।
সহ নাগরিক হিসাবে আদিবাসী জনজাতির অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার ব্যর্থতা থেকেই আদিবাসী উন্নয়নের নীতি এবং নীতি প্রয়োগের অনুশীলনে গুরুত্বপূর্ণ খামতি, বলেছে প্রতীচীর গবেষণা পত্র।
গবেষণা পত্রের প্রথম অধ্যায়েই ঠাঁই পেয়েছে ২০১৮’র নভেম্বরে ঝাড়গ্রামের বিনপুর ১ নম্বর ব্লকের জঙ্গলখাসে দু’সপ্তাহের মধ্যে একজন মহিলা সহ সাতজন শবর জনজাতির মানুষদের অনাহারে, অপুষ্টিতে মৃত্যুর প্রসঙ্গ। প্রতীচীর গবেষণাপত্র লিখেছে, অনাহারে মৃত শবরদের গড় বয়স ছিল ৪২, একজন ভারতীয়ের গড় আয়ুর থেকে ২৬ বছর তাঁরা কম বাঁচলেন! ময়নাতদন্ত ছাড়াই মৃতদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। অনাহারে মৃত্যু নিয়ে রাজ্য সরকারের বক্তব্যও উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসনের মত, শবর জনজাতির মানুষদের মৃত্যু হয়েছিল ‘টিবি অথবা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে’। প্রতীচীর গবেষণাপত্র লিখেছে, এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় হাতের কাছে পঞ্চায়েত, ব্লক অফিস, জেলা সদর থাকলেও তাঁরা কত বিচ্ছিন্ন, তাঁদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণই স্বীকৃত হয় না। প্রতীচীর ফিল্ড সার্ভেতে উঠে এসেছে অপুষ্টি-অনাহার থেকেই তাঁরা মদ্যপান করেন। তাঁরা মদ্যপান করেন খালি পেটে কারণ তাঁরা খাবার পান না।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে রাজ্যের আদিবাসী জনগণের মধ্যে সাক্ষরতার হার দেশের গড় হারের চেয়ে ১শতাংশ কম, ৪৭ শতাংশ। সাক্ষরতার ক্ষেত্রে জেলাওয়াড়ি পার্থক্য বা আন্তঃসম্প্রদায়ের পার্থক্যও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন মাঘ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮৮ শতাংশ অথচ গোরেত সম্প্রদায়ের মধ্যে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩২শতাংশ। আদিবাসী জনগণের ৪৭শতাংশ খেতমজুরির কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও ভিন্ন জনজাতির ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্নতর, যেমন তামাঙ জনজাতির মাত্র ৫শতাংশ খেতমজুরের কাজ করেন আবার খোণ্ড জনজাতির ৭০ শতাংশ খেতমজুরের কাজ করেন।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ৬বছর থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যের শিশুদের ৯৪শতাংশ স্কুলে গেলেও মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পায় মাত্র ৭.৬শতাংশ। উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনোর সুযোগ মেলে ৫.৯ শতাংশ আদিবাসী পড়ুয়াদের, আদিবাসীদের মধ্যে মাত্র ১.৮শতাংশ স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পায়, স্নাতকোত্তরে মাত্র ০.২শতাংশ।
২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী শিশুদের বাড়ি থেকে প্রাথমিক স্কুলের দূরত্ব হতে হবে এক কিলোমিটারের মধ্যে কিন্তু সাত শতাংশ অভিভাবক জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্কুলে যাওয়ার জন্য আদিবাসী শিশুদের এক কিলোমিটারের অনেক বেশি পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়। ৬থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সের ৬৬১জন শিশুর মধ্যে ৪১জন স্কুলের আওতার বাইরে, পরের ধাপের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২৯৩। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও সমীক্ষায় উঠে এসেছে করুণ চিত্র। ৬৮ শতাংশ শিশুর কেবল টিকাকরণ কার্ড রয়েছে, ৩১ শতাংশ শিশুর টিকাকরণ কার্ড নেই, সম্পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে ৫৮ শতাংশ শিশুর। আদিবাসী পরিবারগুলির শুধু মাত্র ৫১ শতাংশের শৌচাগার রয়েছে, ৪৪ শতাংশ আদিবাসী পরিবারের শৌচাগার নেই। দুই তৃতীয়াংশ আদিবাসী পরিবারের কোনও নিকাশি ব্যবস্থাই নেই।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ সরকারি চিকিৎসা পরিষেবায় ভরসা রাখেন? প্রতীচীর সমীক্ষা জানিয়েছে মাত্র ২৭শতাংশ। আদিবাসীদের ৬৬শতাংশই বেসরকারি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের কাছে যান চিকিৎসা করাতে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির বেহাল দশা উঠে এসেছে সমীক্ষায়, গ্রামের মধ্যে প্রাথমিক উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ২শতাংশ গ্রামে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৬শতাংশ গ্রামে। ৪৩শতাংশ গ্রামে উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ২ কিলোমিটার দূরে, ৫১ শতাংশ গ্রামের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র গ্রাম থেকে ৫ কিলোমিটারের বেশি দূরে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির অবস্থা কেমন বোঝা যায় একটি চিত্রেই, প্রতি ৫৪ জন শিশুর মধ্যে মাত্র ৩জন শিশু জন্ম নেয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে।
আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে কর্মসংস্থানের চেহারা কেমন?
২০১১’র জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবাংলায় কাজের অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, অথচ আদিবাসীদের ক্ষেত্রে কাজের অংশগ্রহণের হার ৪৭শতাংশ, প্রতীচীর ২০১৮ সালের সমীক্ষায় উঠে এসেছে কাজের অংশগ্রহণের হার ৫৩শতাংশ। কাজের অংশগ্রহণের হার দেশের ও রাজ্যের গড় হারের থেকে বেশি, এই তথ্য থেকেই স্পষ্ট হয় আদিবাসী পরিবারগুলির শিশু এবং প্রবীণরাও আয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। শিশুরা স্কুলে নাম লেখালেও স্কুল ছুট হতে বাধ্য হয়, পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয় আয়ের সন্ধানে।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে আদিবাসী মানুষদের মধ্যে ক্রমহ্রাসমান অরণ্যের অধিকারের প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে, জীবন জীবিকা রক্ষায় মাত্র ৪৫শতাংশ আদিবাসী মানুষ অরণ্যের উপর নির্ভরশীল। ২০০৬ সালের অরণ্যের অধিকার আইনটি সম্পর্কে জানেন মাত্র ১৪ শতাংশ আদিবাসী মানুষ। সমীক্ষার মতে, অরণ্যের অধিকার আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণেই আদিবাসীদের অরণ্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশ কমছে।
শেয়ার করুন