জন্মদিবসে কার্ল মার্কস - কেন পুনঃস্মরণ?
ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
“যথেষ্ট মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই সাহসি। ১০ শতাংশ মুনাফা থাকলেই তা যে কোনো জায়গায় ব্যবসা করতে পারে; ২০ শতাংশ মুনাফা তার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়; ৫০ শতাংশ মুনাফার জোরে আসে নিশ্চিত ঔদ্ধত্ব; ১০০ শতাংশ মুনাফা হলে তা মানবিকতার নীতিগুলিকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে চলে যায়; ৩০০ শতাংশ মুনাফার সম্ভাবনা থাকলে এমন কোনো অপরাধ নেই যা পুঁজি করবে না, এমন কোনো ঝুঁকি নেই যা নেবে না এমন কি মালিককে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতেও দ্বিধা করবে না” .... টি জে ডানিং (ব্রিটিশ অর্থনিতিবিদ)
Capital গ্রন্থের পাতায় ফুটনোট হিসাবে এই উক্তিটিকে ব্যবহার করেছেন কার্ল হাইনরিখ মার্কস; যার সম্পর্কে আলোচনায় Theoritician শব্দের পরিভাষা করতে গেলে সূত্রস্থপতি বলতে হয়। স্থপতি কারণ পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক-সামাজিক-ঐতিহাসিক রূপান্তরের (যদিও স্থানভেদে তার প্রাবল্যের পার্থক্য হয়) “বিজ্ঞান” নির্মাণ করে মানবজীবনের সাথে বিপ্লবের বা আরও সহজ কথায় সমাজ বদলের এক চিরায়ত গাঁটছড়ার চক্রাকার সিঁড়িভাঙ্গা সত্য আবিষ্কারই শুধু নয়, সেই সূত্রের প্রয়োগে ভবিষ্যতের মানবসমাজ চিনতেও শিখিয়েছেন তিনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষকে আসলে খাটো করে রাখা হয়েছে – মুনাফাকে মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া আর্থ-রাজনৈতিক ব্যাবস্থায় তাদের চেতনা, কর্মক্ষমতা, সৃষ্টিশীলতা এবং সর্বোপরি মানুষের উপযুক্ত জীবনযাপনের ন্যায্য অধিকার সবকিছু সম্পর্কেই বেশিরভাগের কোন মানসিক চাহিদাই তৈরি হতে পারে না, নিরন্তর নিজেকে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামেই তারা ব্যাস্ত থাকতে বাধ্য হয় – এবং সেই অবস্থার সুযোগে প্রচলনের অজুহাতে শোষণের চাকা আরও চেপে বসে। গোষ্ঠীবদ্ধ আদিম জীবন ত্যাগ করে একের পর এক ক্রমান্বয়ী উন্নত ব্যাবস্থার মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে মানবসমাজ – কিন্তু শ্রমবিভাজনকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট হিসাবে তৈরি হয়েছে শ্রেণীবিভাজন যা নিজেই নিজেকে এক অমীমাংসিত, সমাধানযোগ্যতাহীন দ্বন্দ হিসাবে পরিচয় দিয়েছে – বিমূর্ত বিচারকের আসনে রাষ্ট্রের আসীন হওয়াতেও সেই সমাধান আজও মেলেনি, মিলতে পারেনা; ফলত গোটা ব্যাবস্থাটা বৈরিতামূলক সম্পর্কে দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে – একদিকে মালিক (অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়সমুহের মালিকানা যাদের হাতে এবং মজুরি শ্রমের নিয়োগকর্তা যারা) অন্যদিকে মজুরি শ্রমিক (অর্থাৎ নিজেদের শ্রমশক্তির অন্যায্য বিনিময়ে কোনমতে বেঁচে থাকার ন্যুনতম সংস্থানটুকু ক্রয় করতে বাধ্য হওয়া মানুষ) এবং এই বৈরিতার সমাধান হিসাবে শ্রমিকশ্রেনীর নিজেদের অবস্থা বদলানোর লড়াইটুকুই শেষ নয় বরং আগাগোড়া অসাম্যের শিকড়কে উপড়ে ফেলে এক নতুন পৃথিবী গড়ে নেওয়াই তাদের প্রকাশ্য কর্মসূচি। স্বর্গচ্যুত হয়ে ধরাধামে নরকবাসে অসহায়ের মতো সমর্পণ নয়, বরং অন্যায়-অবিচারের চোখে চোখ রেখে বস্তুবাদী জীবনবোধের প্রতিস্পর্ধায় সজ্জিত হয়ে এই নরক সাফ করে স্বর্গাভিমুখে যাত্রাই মানুষের লক্ষ্য - এই ঐতিহাসিক সত্যপোলব্ধিই হল মার্কসবাদের অনন্যতা। গোটা মানবসমাজের অভিমুখ ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতায় ঘেরা বস্তুগত অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল, তার মুক্তির সম্ভাবনা একইসাথে বহুমাত্রিক আবার এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যের প্রতি নিশানায় বাঁধাও বটে। সেই নিশানারই প্রাথমিক নাম সমাজতন্ত্র – আরও পরিসর বাড়িয়ে নিলে সেখান থেকেই কমিউনিস্ট বা সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার ঊষালগ্ন আমাদের সকলের জন্য অপেক্ষারত – এইটুকু বাস্তবোচিত স্বপ্ন দেখেন বলেই মার্কসবাদীরা আর সব পরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে সবশেষে বিপ্লবী – যেমনটা মার্কস নিজেও ছিলেন। আর সেইজন্যেই সারা পৃথিবীর দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে তার অসামান্য টিপ্পনি আজও প্রাসঙ্গিক – “Philosophers have interpreted the world in various ways, the point however, is to change it.” – “এযাবৎকাল অবধি দার্শনিকরা জগৎকে শুধু ব্যাখ্যাই করে এসেছেন - আসলে প্রয়োজন, তাকে বদলানোর”।
মানবেতিহাস দুভাবে সত্যরূপ পরিগ্রহ করে - প্রথমত এটি বিষয়গত সত্য (Objective Truth – irrespective Of Human Desire): কারণ শ্রমজাত চেতনা, যার পুনঃ পুনঃ প্রয়োগে মানুষ সামনে এগিয়েছে পারিপার্শ্বিকতাসৃষ্ট নেতির নেতিকরণ করে এবং দ্বিতীয়ত এটি বিষয়ীগত সত্য (Subjective Truth–Needs Conscious Human Intervention): বেঁচে থাকার রসদের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অভাব ও তার বিপরীতে মানুষের উদ্যম (spirit) - যাকে আশ্রয় করে কেবলমাত্র মানুষই ইতিহাস রচনা করেছে প্রত্যেকবার। “মার্কসবাদ” বলে যে নির্দিষ্ট সাম্যবাদী বিশ্ববিক্ষা (World Outlook)’র নামকরণ করেছেন ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস, তার নির্যাস এটাই। এই উদ্যমেই স্পার্টাকাস লড়েছিলেন, প্যারির সৈনিকরা কমিউন গড়ে তুলেছিল - নাৎসিক্লীবদের বীভৎস আক্রমণের মুখে স্তালিনগ্রাদের প্রতিটি পরিবারের হাতে গরম জল ভর্তি ডেকচি হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের হাতিয়ার, চীনের জনগণের মুক্তিযুদ্ধে লং মার্চের রণকৌশলও সবশেষে Concrete Analysis Of The Concrete Condition – যা সেই মানবিক উদ্যমেরই মূর্তরুপ। ইতিহাসকে উচ্চমার্গের পল্লবগ্রাহি কিংবদন্তি উপমাযুক্ত রাজা-রাজড়াদের কষ্টকল্পনানির্ভর ব্যাখার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে মার্কস তাকে সোজা করে টেনে নামান মাটির উপরে – একেবারে মানুষের সামনে – এই কাজ তিনি ফয়েরবাখের দর্শনের ক্ষেত্রেও করেছিলেন। এরই ফলে এতদিন ধরে শুধুই সভ্যতার অসামান্য শৈল্পিক নিদর্শন বলে যা কিছু আমাদের মুগ্ধ করত সেই সব স্তাপত্যই যে আসলে মৃত শ্রম (Dead Labour) সেই সারসত্য আমাদের চোখ খুলে দেয়।
অর্থনীতি’কে এক বিশেষ বিজ্ঞান হিসাবে গড়েপিটে নেওয়ার কাজ প্রথম থেকেই শুরু থেকেই হয়েছে। মার্কসীয় অর্থশাস্ত্র আসলে একটা ভনিতাহীন রাজনৈতিক অর্থনীতির কথা তুলে ধরে। সেই অভিজ্ঞানের মূল কথা হল যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তি হল অর্থনৈতিক বোঝাপড়া এবং একই সাথে যে কোন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে নির্দিষ্ট শ্রেণীর রাজনীতি। এ সেই শ্রেণী উৎস প্রতিটি সমাজবদ্ধ মানুষ যার হাতে বাঁধা পড়ে থাকে – প্রচলিত ব্যবস্থায় কিছুটা বাড়তি প্রাপ্তির কারনে অন্যদের তুলনায় সামাজিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন যারা তাদের অনেকরই মনে এক ভ্রান্তি থাকে যে তারা বেশি যোগ্য তাই তাদের বেঁচে থাকার পরিসর পর্যাপ্ত। আসলে সামাজিক শ্রেণীবিভাজন মানুষের অস্তিত্বের উপরে এমনভাবেই চেপে বসে থাকে যেখানে খুব কম জনই সমাজ পরিচালন পদ্ধতির গোড়ায় যে অন্যায়টুকু রয়েছে, যে অন্যায্যতা একেবারে শিকড় অবধি তাকে টপকে সত্যের সন্ধান পান। মার্কস সেরকমই এক সত্যের সন্ধান করেছিলেন –সেই সত্য আজও পুঁজিতান্ত্রিক অর্থশাস্ত্রীদের যম! তাকেই বলা হয় উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ব (Theory Of Surplus Value)। একেবারে গোড়া ধরে টেনে যেমন মার্কস দেখিয়েছেন ঐতিহাসিকভাবে সম্পদশালী রাষ্ট্রগুলির ( যেমন ইংলন্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকা) সম্পদের ভীতটাই হল এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলির উপরে বহু বছর ধরে সংগঠিত লুঠ এবং অত্যাচার। তেমনই তিনি প্রমান করেছেন মালিকের ঘরে যে সম্পদ প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে, যার বলে বলিয়ান হয়ে সে নিজে অনেকের উপরে প্রভুত্ব কায়েম করতে পারছে সেই সম্পদের কারণ আসলে একটা বিরাট চুরি। সেই চুরি করা হয় সমস্ত মেহনতিদের ঠকিয়েই – রোজ; এর পিছনে মালিকের কোন বাড়তি যোগ্যতা নেই বরং বলা যায় অনেকটা বাড়তি অসততাই রয়েছে। শ্রমিকের দক্ষতা অনুযায়ী প্রযুক্ত (Skilled Or Unskilled) নির্দিষ্ট শ্রমক্ষমতা (Concrete Labour Power) উৎপাদিত পন্যের ব্যবহারমূল্য (Use Value) তৈরি করে আর সেই একইসময়ে প্রয়োগ হওয়া গড় সামাজিক বিমূর্ত মানবিক শ্রমক্ষমতা (Abstarct Social Necessary Average Human Labour Power) তৈরি করে পণ্যের বিনিময় মূল্য (Exchange Value)। এই মানবিক শ্রমক্ষমতা নিয়েই কাজের খোঁজে চাহিদার বাজারে হাজির হয় সর্বহারা (Proletariat) আবার ঐ মানবিক শ্রমক্ষমতাকেই পণ্য হিসাবে খরিদ করে বুর্জোয়া মালিক (Bourgeois)। এক্ষেত্রে বরাদ্দ খরচ হয় মালিকের খাতায় পরিবর্তনশীল পুঁজি (Variable Capital) – ঐ খাতে কাঁচা মাল (Raw Material) এবং আরও কিছু খরচ যুক্ত হয় যা পরে ঘুরে এসে মালিকের ঘরেই ঢোকে। নির্দিষ্ট কাজের সময়ে মজুরি-শ্রমিক যতটা উৎপাদনের কাজ করে তার মূল্য (Price Value) হিসাব করলেই বোঝা যায় কিভাবে তাকে তার কাজের সময়ের একটা বড় অংশ বেগার খাটতে হয় যার কোন মজুরি নির্ধারিত নেই। দিন হিসাবে কোন মজুরি-শ্রমিকের আয় ১০০ টাকা হলে দেখা যায় আটঘন্টার সময়ে তাকে দিয়ে যে মুল্যের উৎপাদন করিয়ে নেওয়া হয়েছে তা ঐ ১০০ টাকা মজুরির অন্তত দুই কি তিনগুন কিংবা আরও বেশি। এভাবে মজুরি দেবার অছিলায় বাড়তি মূল্য উৎপাদনে শ্রমিককে খাটিয়ে নেওয়া চলতেই থাকে সারাজীবন ধরে সেই থেকেই বুর্জোয়া মালিকের ঘরে সম্পদের পাহাড় জমা হয়। শ্রমিকের পকেট কেটেই আসলে মালিকের ফুলে-ফেঁপে ওঠা – বুর্জোয়া মালিকের (Bourgeois) বিশাল সম্পত্তির উৎস খুঁজতে গিয়ে এই সহজ সত্যিটুকু বহু গবেষণার পরেও পুঁজিবাদী অর্থশাস্ত্রীরা বের করতে পারেন নি, মার্কস সেই আবিষ্কার করেছেন। তাই তো দুনিয়াজূড়ে মার্কসের কোন ব্যাক্তিগত শত্রু না থাকলেও তার মতবাদের যথাসাধ্য বিরোধিতায় পূঁজির আন্তর্জাতিক চরিত্র স্পষ্ট হয়।
উল্লিখিত উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ব (Theory Of Surplus Value) ছাড়াও পুঁজিবাদী অর্থনীতির মুখোশ খুলে দিতে মার্কসের আরো দুটি অতিগুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে।
প্রথমঃ পুঁজিবাদী ব্যাবস্থায় মজুরি-শ্রমিকের উপরে শোষণের হার নির্ধারণ – বুর্জোয়া মালিক দিনের শেষে নিজের লাভের হিসাব কম করে দেখাতে ব্যবহার করে নিচের সুত্রটি
Rate Of Profit = Generated Surplus Value ÷ (Constant Capital + Variable Capital)
অথচ এই Constant Capital এর জন্য পূর্বনির্ধারিত Depreciation’র হিসাব কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের দামের মধ্যেই ধরা থাকে! এর মানে হল ইচ্ছাকৃত মুনাফার হার কম দেখানোর জন্যই Constant Capital কে হিসাবের মধ্যে দুবার নিয়ে আসা হয় এবং আসলে লোক ঠকানো হয়।
মার্কস দেখালেন এই Rate Of Profit’ই হল পুঁজিবাদী সমাজের সারসত্য – এখানেই তারা মানুষের মাথাটা গুলিয়ে দিয়ে নিজেদের চুরি ঢেকে রাখতে চায়। আসলে লুটেরা মালিক যেটা দেখাতে চায় না তা হল
Rate Of Surplus Value Generation = Generated Surplus Value ÷ Variable Capital
এই হিসাব করলেই আগের অংকের একই মূল্যমানে উৎপাদিত পণ্যের সাথে মালিকের মুনাফার আসল উত্তরটি বেরিয়ে আসে। এইভাবেই বোঝা যায় কিভাবে শ্রমিকদের মজুরির নামে আসলে ঠকানো হচ্ছে, লুট করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ঃ নিজেদের মুনাফা বাড়াতে পুঁজিবাদ কয়েকটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি বারে বারে ব্যবহার করে। সেগুলি হল
১. কাজের জন্য নির্ধারিত সময় বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফার অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটানো (ওভারটাইমের মজুরির হিসাবকেও উপরের যুক্তিতেই অপর্যাপ্ত প্রমান করা যায়)।
২. মুনাফা কম হচ্ছে বলে প্রচার করে মজুরির কাট-ছাঁট করে (এর জন্য শ্রম আইনের বারে বারে সংশোধনের নামে আসলে সেই আইনকে দুর্বল করে তোলা হয়)।
৩. নির্দিষ্ট সময়ে বাড়টি কাজের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ( এর জন্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গবেষণা খাতে পুঁজিবাদ বিপুল অর্থের বিনিয়োগ করে। মুনাফা করা যাবে না সেইসব বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ ফিরেও তাকায় না, তা সেই গবেষণা যতই মানুষের কাজে লাগুক না কেন!)।
এইসবকিছুই আসলে একটি দার্শনিক সত্যকে আবার সামনে নিয়ে আসে – সেই সত্য হল পুঁজিবাদ সর্বদা এমন এক অতি উৎপাদনের সংকটে জর্জরিত থাকে যাকে সে কখনো সমাধান করতে পারে না, এড়িয়ে যেতে পারে না। এই অতি উৎপাদন কিন্তু মানুষের মোট প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি নয় – আসলে মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন করা হয় বলে পুঁজিবাদে চিরকাল এক অসাম্য চলে। এর জেরে ক্রমশ পণ্যের বাজার সংকুচিত হয় (কারণ বেশিরভাগ মানুষ পণ্য কিনতে অপারগ) আর তার পাল্টায় একদিকে আরও বেশি দাম চাপিয়ে মুনাফার হার বজায় রাখতে গিয়ে বাজার আরও ছোট হয়ে যায় এবং উৎপাদন বন্ধ রেখে খরচ কমানোর ফলে (লকআউট ইত্যাদি করে) সমাজে আরেকবার ভয়াবহ বেকারি এবং দারিদ্রের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া চলতে থাকে। আসলে যে মূলগত অসাম্য পুঁজিবাদের প্রানভোমরা তা হল এই ব্যবস্থায় উৎপাদনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত বিস্তৃতরুপে সামাজিক কিন্তু সেই উৎপাদনের ফলে যে পণ্য এবং মুনাফা পাওয়া যায় তা মুষ্টিমেয়র ব্যাক্তিমালিকানাধীন। ফলে গোটা সমাজটা পূর্বোল্লিখিত মতে বৈরিতামূলক দুই শিবিরের মাঝে বিবদমান। এই সংকটের সমাধানে হয় পুঁজিবাদ আবার একবার পৃথিবীজোড়া যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে নতুন বাজার কব্জা করতে সফল হবে নাহলে প্রলেতারিয়েত (Proletariat) ব্যাপক জনগণকে সাথে নিয়ে এই অবস্থার সমাধানকল্পে বিশ্ববিপ্লবের আহ্বানকে নিজেদের কর্মসূচি হিসাবে নিয়ে দেশে দেশে ক্ষমতা দখলের নিজেদের অভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলবে। এই ভয়ে আজ আর শুধু ইউরোপ নয় সারা পৃথিবীর সব শক্তিধর রাষ্ট্রই ভুত দেখছে।
নিজের মেয়েদের ইচ্ছামত এক নাতিদীর্ঘ আত্মজিজ্ঞাসা লিপিবদ্ধ করে গেছেন মার্কস – সেখানে তাকে জানতে ছাওয়া হয়েছিল Your Favourite Maxim? মার্কস এর উত্তরে এক রোমান-আফ্রিকান নাট্যকার Publius Trentius Afer’র একটি রচিত একটি সংলাপ বলেন – “Nihil humani a me alienum puto” বা ইংরেজি তর্জমায় “Nothing human is alien to me”। এই কথার বাংলা করলেই মানুষটির সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ হয়ে যায় “মানবিক কোন কিছুই আমার অনাত্মীয় নয়”। সারাজীবন স্বামী কার্লের পাশে স্ত্রী জেনি একজন প্রকৃত কমরেডের মতোই ছিলেন, মার্কসের বহু লেখাই দিনের আলোয় আসতে পারত না কলম হাতে পাঠযোগ্য হাতের লেখা নিয়ে জেনি না থাকলে, তিনি ছিলেন মার্কসের লেখনির প্রথম পাঠক অথবা শ্রোতা – বহু ঝড়ঝাপটা, বহু কষ্টের সাথি দুজনেই একসাথে। শতকষ্ট স্বীকার করেও এই জেনি ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে না থাকলে কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স হয়ত কখনো মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না।
কার্ল হাইনরিখ মার্কস'কে এইসব তত্বের যুক্তিজাল বিস্তার না করেও সারা পৃথিবীতে মানুষ শ্রদ্ধা জানাবেন যিনি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সত্যের অনুসন্ধানে নিজের গোটা জীবনটুকুই চরম দুঃখ-দারিদ্র-লাঞ্ছনার কবলে নিয়ে গেছেন কিন্তু মানুষের স্বার্থের পরিপন্থি কিছু মাথা নামিয়ে মেনে নিয়ে অথবা প্রচলনের সাথে আপোষ-রফা করে কখনো নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেন নি। অনেকেই এই কঠিন পরীক্ষায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েও পরে হেরে যান। আর তাই মার্কসবাদকে নিজেদের জীবনের চর্চায় প্রয়োগ করেন যারা সেই কমিউনিস্টদের মুল্যায়ন একমাত্র মৃত্যুর পরেই হয়। আর তাই ২০৩ তম জন্মদিবসে তাকে স্মরন করতে গিয়েও মার্কসের মৃত্যুর পরে হাইগেটে তার সমাধিক্ষেত্রে বন্ধু, কমরেড ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস’র বলা সেই কথা আমাদের স্মরনে রাখতেই হবে “ An immeasurable loss has been sustained by the militant proletariat of Europe and America , and by historical science, in the death of this man, The gap that has been left by the departure of this mighty spirit will soon enough make itself felt….. and I make bold to say that, though he may have had many opponents, he had hardly one personal enemy”।
ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ