Site icon CPI(M)

Dalit Resistance And The Role Of The Left (Part – 2)

Dalit Movement - Part 2

‘দ্য লেফটওয়ার্ড ব্লগ’ – এ ২০১৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর Dalit Resistance And The Role Of The Left শিরোনামে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড বৃন্দা কারাতের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ডঃ বি আর আম্বেদকরের জন্মদিবস উপলক্ষে সেই প্রবন্ধেরই সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ দুটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশ করা হল।

দলিত সংগ্রাম এবং বামপন্থার ভূমিকা

দ্বিতীয় পর্ব

অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াইতে প্রাসঙ্গিক বাম বিকল্প

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল গুজরাটে দলিতদের নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের পিছনে প্রধান শক্তি হল দলিত অস্মিতা – দলিত আত্মমর্যাদা যা তাদের জীবন জীবিকা এবং জমির প্রশ্নের সাথে জড়িত। এই সমস্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব দলিতদের পরম্পরাগত ‘কাজ’ ত্যাগ করার আহ্বান রেখেছেন। পরম্পরার নামে ঐ সকল ‘ কাজ ‘ দলিতদের মর্যাদা হনন করে। দলিতদের আন্দোলনে একটি জোরালো প্রতীক ব্যবহার করা হয়, বিভিন্ন সরকারি দফতরের সামনে মৃত গবাদি পশুর দেহাবশেষ ছুঁড়ে ফেলা হয়। ‘উনা’র ঘটনার পরে দলিতদের আন্দোলনে প্রধান দাবিগুলির একটি হয়ে উঠেছে ভুমিসংস্কার। আন্দোলনের স্লোগান হিসাবে সম্প্রতি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে “তোমরা নিজেদের গবাদি পশুর পুচ্ছ সামলাও, আমাদের জমি ফেরত দাও”। অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলনে এই দাবি ভূমিসংস্কারের প্রশ্নে বামেদের এতদিনকার দাবিকেই সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রভাগে এনে হাজির করেছে। ৭০ এর দশকে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের বিকল্প অর্থনৈতিক – সামাজিক পরিকল্পনা এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ৩০ লক্ষ কৃষক পরিবারের হাতে প্রায় ১২ লক্ষ একর জমি বণ্টন করেছিল, জমি প্রাপকদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ তফসিলি জাতির মানুষ ছিলেন।এরই ফলে গ্রাম বাংলায় তফসিলী জাতির মানুষের ক্ষমতায়নের ভিত তৈরি হয়, পরে তফসিলী সম্প্রদায়ের অনেকেই বিভিন্ন পঞ্চায়েতে যথোপযুক্ত নেতৃত্ব দেন। ভূমি সংস্কার এবং স্থানীয় স্তরে স্বশাসনের বন্দোবস্ত গ্রাম বাংলায় জাতিভেদ ব্যবস্থার কোমর ভেঙে দেয় এবং বর্নভেদের বিরুদ্ধে বামেদের বহুবিধ প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিকল্প প্রণয়ণের পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।

গুজরাটে দলিতদের আন্দোলনে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টিও সামনে আনা হয়েছে। মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সারাদেশে উন্নয়নে র প্রশ্নে গুজরাট অন্য সবার থেকে এগিয়ে রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রশ্নে আদানি, আম্বানি দের মতো ধনী ও ধান্দাবাজ কর্পোরেট রাই সেই ঘোষিত উন্নয়ণের সুবিধাপ্রাপ্ত। গুজরাট মডেলে উচ্চ পর্যায়ের পুঁজি নিবিড় শিল্পক্ষেত্রে নতুন কাজের সুযোগ ক্রমশ কমানো হয়েছে, বেতন কম রাখা হয়েছে। দলিত রা এই ব্যবস্থার চরম নিপীড়নের শিকার। সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত প্রথাসম্মত কাজ ব্যতীত দলিতদের অন্য কোনো কাজের সুযোগ না দেওয়ার ঘটনায় সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।

নবসর্জন নামের একটি গুজরাটে দলিত সম্প্রদায়ের সংগঠন একটি সমীক্ষা চালায়, সরকারি তথ্যেই জানা যায় সারা রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি দফতরে ৬৪০০০ শূন্যপদে দলিতদের নিয়োগ আটকে রয়েছে। মার্টিন ম্যাকোয়ান, নবসর্জনের ডিরেক্টর এই ঘটনাকে ‘ সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ব্যবস্থাকে বজায় রাখার জন্য দলিতদের বিরুদ্ধে এ আসলে এক চক্রান্ত – যাতে মলমূত্র পরিষ্কারের কাজ কিংবা মৃত পশুর দেহাবশেষ থেকে চামড়া নিষ্কাশনের কাজ ইত্যাদি যা সাধারণভাবে দলিতদের সামাজিক পরিচয়, সেটি কোনোভাবে না বদলায়।”

গুরুত্বপূর্ণ হল দলিতদের আন্দোলনে জীবন জীবিকা, জমির অধিকার এবং বেতন – মজুরি ইত্যাদি প্রসঙ্গ সামনের সারিতে উঠে আসছে। আগে এই সমস্ত দাবীকে সামাজিক দাবী আদায়ের লড়াইয়ের পরিসরের বাইরে রাখা হত, এখন সেই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এ এক ইতিবাচক পরিবর্তন, বাম গনসংগঠনগুলির সাথে বিভিন্ন দলিত সংগঠন যদি আন্দোলনে একে অন্যের সহযোগী হয় তবে আমরা সেই ঐক্যকে স্বাগত জানাই। বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং কৃষক সংগঠনগুলিকে এই ঐক্যের ক্ষেত্রে প্রধান সহায়কের ভূমিকা পালন করতে হবে।

ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা এবং সংশ্লিষ্ট বিদ্যায়তনের ভূমিকা

সংকটের দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ থেকে শুরু করে জ্ঞানচর্চার উচ্চতম ক্ষেত্রগুলি যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য পেশাভিত্তিক পড়াশোনার ক্ষেত্রসহ) বৈষম্যের মনোভাব উল্লেখ্য। রহিত ভেমুলা এমন বৈষম্যেরই শিকার হয়েছিল। বিভিন্ন বিদ্যায়তনে বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে অধ্যাপক শুকদেও থোরাটের বিস্তারিত গবেষণা রয়েছে। ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে অধ্যাপক থোরাট “The Committee to Enquire into the Allegation of Differential Treatment of SC/ST Students in AIIMS, Delhi” – এর সমীপে যে প্রতিবেদন জমা দেন তাতে দেখা যাচ্ছে একাধিক শিক্ষাঙ্গনে দলিত ছাত্রছাত্রীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের সমস্যা নিরসনে বারে বারে সমানাধিকার সংক্রান্ত বিভাগ ((Equal Opportunity Office) চালু করার সুপারিশ রয়েছে। এই সুপারিশ যে শুধু এইমসের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, সারা দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যবস্থার বাস্তবিক প্রয়োজন আছে। ২০০৭ সালে এই প্রতিবেদন জমা করা হলেও এখনও অবধি কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয় নি।

হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এমনই হয় যাতে রোহিত ভেমুলাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতে হল। এই ঘটনায় মোদী সরকার এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তৎকালীন মানবসম্পদ মন্ত্রকের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। তাদের এহেন আচরণ দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীদের রহিত ভেমুলার সাথে হওয়া অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সংহতিমূলক ঐক্য গড়ে তোলার কারন। বিভিন্ন বিক্ষোভ মঞ্চ থেকে দলিত ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা সম্পর্কিত রোহিত ভেমুলা নামাঙ্কিত আইনের দাবী উঠে আসে। এই দাবী অধ্যাপক থোরাটের সুপারিশ সমূহের সাথে মিলে যায়, আর তাতেই আরও স্পষ্ট হয় বিভিন্ন বিদ্যায়তনে দলিত বৈষম্যমূলক আচরণের হকিকত।

এ ধরনের আইন প্রণয়ন সম্পর্কে সিপিআই(এম)-র সমর্থন রয়েছে। দেশজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাম ছাত্র সংগঠনগুলো যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের উপরে ঘটে চলা বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে এবং তাদের প্রতি তাদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছে তা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। এক্ষেত্রেও একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে, কিছু জায়গায় সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।

দলিতদের উপরে হিংসার ঘটনা

আন্দোলন-সংগ্রামের তৃতীয় ক্ষেত্রটি সারা দেশ জুড়ে দলিত সম্প্রদায়ের উপরে ঘটে চলা বিভিন্ন আক্রমণের ঘটনায় প্রতিবাদ সংগঠিত করা সম্পর্কিত। আক্রমণের ঘটনাগুলিতে সর্বদা উচ্চবর্ণেরই কেউ জড়িত আছে এমন নয়, মন্ডল কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কিছু কাজ হবার ফলে যারা বর্তমানে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে সেই ওবিসি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা দুর্বৃত্তরা ও এমন আচরণ করছে। সারা দেশ ঘটনায় কেঁপে উঠেছে, হরিয়ানার সুনপদে উচ্চবর্ণের লোকজন শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে একটি দলিত পরিবারের উপরে আক্রমন করে যার পরিণতিতে সেই পরিবারের দুজন শিশুর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। এর উত্তেজনা আরো বেড়ে যায় যখন মোদি সরকারের একজন মন্ত্রী শিশুদুটির মৃত্যুর ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চুপ থাকা প্রসঙ্গে কুকুরদের স্বাভাবিক মৃত্যুর উপমা দেন।

তপশিলি জাতি বর্গের উপর আক্রমণের ঘটনা শেষ এক দশকে বেড়েছে, শেষ কয়েক বছরে সেই তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাকে দেখা যাচ্ছে ২০১৩ সালে তপশিলি জাতি বর্গের উপরে ৩৯,৪০৮ টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে, ২০১৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৭,০৬৪ টি। ২০১১ সালের মতো ২০১২ সালেও দলিতদের উপরে আক্রমনের মোট ৩৩,৬৫৫ টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সারা দেশের ১০ টি রাজ্যে দলিতদের উপরে আক্রমণের ঘটনা সার্বিক অপরাধের জাতীয় গড়কেও পিছনে ফেলে দিয়েছে। বহু ক্ষেত্রে দলিত মহিলার ধর্ষনের শিকার হলেও তারা অভিযোগ জানতে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন, এর কারণ সেই নিপীড়নের পরিবেশ যার ফলে অভিযোগ জানানো হলে ভবিষ্যতে আরো বেশি দুর্দশার শিকার হবার আশঙ্কা কাজ করছে।

অত্যন্ত আশঙ্কার বিষয় উল্লিখিত সমস্ত ক্ষেত্রেই শাস্তি ঘোষণা হয়েছে এমন ঘটনার তুল্য হার ভয়াবহ, ২০১৪ সালে সেই হার মাত্র ৩.৭ শতাংশ।

বুর্জয়া রাজনৈতিক দলগুলির এই সমস্যা সমাধানে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তারা ভীষণরকম জাতি সম্পর্কিত পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট, তাদের চেতনায় ভোট ব্যাংকের রাজনীতি থাকার কারণে কোনো যথাযথ পদক্ষেপ নিতে অনীহা থাকে। এর ফলে দলিতদের আরো বেশি হিংসার কবলে পড়তে হচ্ছে। এমন আক্রমণের ঘটনা বন্ধ করতে প্রয়োজন সমাজের সব অংশের জোরদার ঐক্য। বাম রাজনৈতিক সংগঠন গুলি, বিশেষ করে তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় অনেক বছর ধরেই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে সামনের সারিতে থেকে কাজ করছে। এই উদ্দেশ্যেই দলিত শোষণ মুক্তি মঞ্চের স্থাপনা করা হয়েছে, এই উদ্যোগ মূলত সিপিআই(এম) – এর হলেও এতে বৃহত্তর সমাজের অন্যান্য অংশকেও (এমনকি আন্তঃ রাজ্য স্তরেও) দলিতদের অধিকারের দাবিতে সামনে রেখে যুক্ত করা হয়েছে।

জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের রাজনৈতিক অভিমুখ

একথা স্পষ্ট যে দলিতদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে প্রতিরোধ এবং সার্বিক ঐক্যের একান্ত প্রয়োজন। যদিও এখনও কিছু কিছু দলিত সংগঠনের মধ্যে বাম এবং বামপন্থী গণ সংগঠনের প্রতি বৈরিতার মনোভাব রয়ে গেছে। বিভিন্ন দলিত সংগঠনের মধ্যে বাম আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবার প্রশ্নে পরস্পর বিরোধী অবস্থান রয়েছে। তাদের কেউ কেউ এমনও মনোভাব প্রকাশ করেছেন যেন অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে বামেদের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হবে, সেই মনোভাব থেকেই তারা বামেদের সাথে হাত মিলিয়ে কোন আন্দোলনে যাওয়ার বিরোধিতা করেছেন। যদিও সমস্ত বামদল এবং বিশেষভাবে সিপিআই(এম)-কে এধরণের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারনাকে দূরে সরিয়ে রেখে যারা একজোটে আন্দোলনে যুক্ত হতে চায় তাদের সাথে হাত মিলিয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই লড়াইতে আমাদের সবাইকেই নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। মার্কসবাদী হিসাবে আমাদের কর্তব্য শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেনীর লড়াইকে জাতিভেদ প্রথা অবসানের লক্ষ্যে পরিচালিত করা, তাকে শক্তিশালী করে তোলা – সেই কাজের তাত্বিক এবং ফলিত চর্চায় আরও বেশি মনোনিবেশ করা। বিপ্লবোত্তর সময়ের জন্য ফেলে রাখা যায় এমন সাধারণ কোনও উপরিকাঠামোগত সমস্যা নিরসনের কর্মসূচী হিসাবে জাতিভেদে প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইকে বিচার করলে ভুল হবে। সিপিআই(এম)-এর কর্মসূচিতেই পার্টির রণকৌশলগত লাইন নির্ধারণের প্রসঙ্গে জাতিভেদ প্রথা বিলোপের লড়াইকে আমাদের দেশের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক এবং শ্রেণীভিত্তিক দুই ক্ষেত্রের সংগ্রাম হিসাবেই ব্যখ্যা করা হয়েছে। ভারতে আরথ-সামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী শ্রেনিসংগ্রামের প্রসঙ্গে শহর এবং গ্রামাঞ্চলে সর্বহারা শ্রেণী, কৃষিমজুরদের লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করার সাথে একই গুরুত্ব দিয়ে সর্বহারা শ্রেণীর ধারনায় নিপীড়িত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষকে যুক্ত করতেই হবে। একজন সর্বহারা মেহনতি মানুষকে শুধুমাত্র তার দলিত পরিচয়ের জন্য যে নিপীড়নের শিকার হতে হয় তার বিরুদ্ধে সমস্ত মজদুর সংগঠন এবং কৃষক সংগঠনগুলি একযোগে লড়াই – সংগ্রাম – আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেলে তবেই শ্রেণী ঐক্যের স্লোগান পূর্ণতা পাবে। 

বাম সংগঠনের একাংশের মধ্যে সামাজিক শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়টি শ্রেণী আন্দোলনের স্বাভাবিক সহযোগী বিষয় হিসাবে বিচার করার উপযুক্ত রাজনৈতিক বোধের অভাব রয়েছে- এটা দুর্বলতা। শ্রেণী সংগ্রামের আগুনে নিজে থেকেই সামাজিক নিপীড়নের শিকল ভেঙ্গে পড়বে এমন মনোভাব আসলে রাজনীতিকে যান্ত্রিকভাবে দেখার ফল। এতে দলিতদের যে নির্দিষ্ট শোষণ- বঞ্চনার শিকার হতে হয় তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ভারতে জাতিভেদ প্রথা শ্রমিকদের মধ্যেও স্পষ্ট বিভাজন রেখা সৃষ্টি করেছে। একজন দলিত সর্বহারাকে যে দ্বিগুন শোষণের (পুঁজি এবং সামাজিক) শিকার হতে হয়, দলিত মহিলা মেহনতিদের জন্য সেই শোষণের চেহারা হয় তিনগুন (পুঁজি, সামাজিক এবং লিঙ্গবৈষম্য) তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হয়, সমাধান করতে হয়।

দলিত মেহনতিদের নির্দিস্ট সমস্যাকে শ্রেণী ঐক্যের নামে চাপা দেওয়া সঠিক রাজনীতি নয়। যতদিন না আমরা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সাথে দলিত সর্বহারাদের নির্দিষ্ট অধিকারের লড়াইকে যুক্ত করে নিতে পারছি ততদিন সেইসব দলিত- মেহনতি মানুষজন কিভাবে বাম সংগঠনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবেন? শ্রেণী রাজনীতির বৃহত্তর মঞ্চে দলিতদের জীবনের নির্দিষ্ট সমস্যাসমূহকে মূল আলোচনার বিষয়ের সাথে না যুক্ত করেই শুধু ‘পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি’ (Identity Politics) – এর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলে চলবে না। এই লক্ষ্যে সফল হতে গেলে আমাদের গনসংগঠনগুলির ভিতরে জাতিভেদের পক্ষে যেকোনো প্রকারের সহানুভূতির মনোভাব একেবারে নির্মূল করে দিতে হবে।

সিদ্ধান্তসমূহ

পুঁজিবাদের পক্ষে ভারতে জাতিভেদ সংক্রান্ত সমস্যাকে সমাধান করতে না পারা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। বরং বলা চলে মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা পুঁজিবাদ এদেশে নিজেদের স্বার্থেই জাতিভেদ প্রথাকে আরও বিস্তৃত করেছে, শক্তিশালী হতে সাহায্য করেছে। ভারতের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণী এবং জাতি উভয়েই একে অন্যের সাথে জড়িয়ে রয়েছে – একথা স্পষ্ট যে জাতিভেদই হল সেই হাতিয়ার যা ব্যবহার করে দলিত এবং শুদ্রদের বেগার খাটিয়ে মুনাফা কামানো হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি এদেশে মহিলাদের শ্রমশক্তিকে ইচ্ছাকৃত অবমুল্যায়িত করে রেখেছে, তফসিলি কিংবা দলিত মহিলাদের ক্ষেত্রে সেই শোষণের মাত্রা আরও তীব্রতর।

বর্তমানে মোদী সরকারের আমলে হিন্দুত্বের শক্তি চেষ্টা করছে বৃহত্তর হিন্দু ঐক্যের নাম করে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক স্লোগান নির্ভর বিষময় রাজনীতির সাহায্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানা করতে, সেই কাজে দলিতদের যুক্ত করতে চায় তারা।

ভারতে জাতিভেদ প্রথা কিভাবে কার্যকর তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে যথাযথ তাত্বিক বোঝাপড়া গড়ে উঠবে যদি আমরা তাদের রোজকার জীবন সংগ্রামের সাথে যুক্ত হতে পারি। সেই বৃহত্তর ঐক্যের জন্য বিভিন্ন গনসংগঠনের মাধ্যমে তফসিলি এবং দলিত সম্প্রদায়ের সাথে যথোপযুক্ত যোগাযোগ বজায় রেখে সঠিক রাজনৈতিক ইস্যুকে সামনে এনে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি। সেই লক্ষ্যে এগোতে নতুন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগকে কার্যকরী করে তোলার দায়িত্ব আমাদের। এই প্রবন্ধে উল্লিখিত তিনটি লড়াইয়ের প্রসঙ্গ এবং সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে অন্যান্য সমস্ত ন্যায্য দাবীর ভিত্তিতে এক বিপ্লবী সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে সামনে রেখে আমাদের এগোতে হবে।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

শেয়ার করুন