People's Democracy ১৪.০৩.২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত
সিপিআই (এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের জন্য বামপন্থীদের কী কৌশল অবলম্বন করা উচিত সে সম্পর্কে কিছুদিন ধরেই গণমাধ্যমে তাঁর মতামত প্রকাশ করে চলেছেন।
তিনি বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে একই পঙক্তিতে বসানো এবং বিজেপি এবং টিএমসি উভয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দেওয়ার জন্য সিপিআই (এম) এবং বামফ্রন্টের সমালোচনা করছেন।
তিনি ৮ ই মার্চ তারিখে 'দ্য হিন্দু'কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে সিপিআই (এম) -র নেতৃত্বাধীন জোটের নেওয়া রাজনৈতিক লাইনটি “সংকীর্ণ, অদূরদর্শী, আত্মঘাতী”।তিনি আরও বলেছিলেন যে বামফ্রন্ট "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং টিএমসিকে নিশানা করে বিজেপির বিপদকে খাটো করছে।" এই "ভ্রান্ত" লাইনের বিপরীতে, সিপিআই (এম এল) সিপিআই (এম) -র নেতৃত্বাধীন ফ্রন্ট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে একা চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রিপোর্ট অনুসারে, সিপিআই (এমএল) ১২ টি আসনে লড়াই করবে, সম্ভবত ১২ থেকে ১৫টি আসনে বামফ্রন্টকে সমর্থন করবে এবং বাকী আসনে, বিজেপিকে পরাস্ত করার জন্য প্রচার করবে, যার অর্থ ২০০ টিরও বেশি আসনে তাদের সমর্থন রয়েছে টিএমসি-এর পক্ষে।
সিপিআই (এমএল) যা অভিযোগ করেছে , সিপিআই (এম) এবং বামফ্রন্ট বিজেপি ও টিএমসিকে একই সারিতে রেখেছে, সেটা মোটেও সত্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বড় বিপদ এই আশঙ্কার কোন অবমূল্যায়ন করা হয় নি। রাজ্যে হিন্দুত্ববাদী শক্তি আক্রমণাত্মক অবস্থানে রয়েছে এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল তাদের অগ্রগতি এবং বিপদটি দেখিয়েছিল।তবে এর অর্থ এই নয় যে, তৃণমূল কংগ্রেস এবং তার নৃশংস সরকার যে কোনও উপায়ে, সিপিআইয়ের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক যে কথা বলেছে, সেই “ফ্যাসিবাদী আক্রমণ” এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশীদার বা মিত্র হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের ভূমিকা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের চরিত্র সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকা দরকার। টিএমসি পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট বিরোধী ও বাম বিরোধী শক্তির মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল।ফ্যাসিস্ট সুলভ হিংসা এবং লুম্পেন রাজনীতি দ্বারা তারা সিপিআই (এম) এবং বামফ্রন্টকে নিশানা করে এবং বাম আন্দোলনকে শারীরিকভাবে নিকেশ করার চেষ্টা করেছিল। গত এক দশকে, সিপিআই (এম) ও বামপন্থীদের ২২০ জনের বেশি কর্মী এবং সমর্থক নিহত হয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন, লক্ষাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং বহু অংশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। টিএমসি বিজেপির মিত্র হিসাবে তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিল এবং ২০১৪ সালের শেষ পর্যন্তও নরেন্দ্র মোদী টিএমসিকে একটি সম্ভাব্য মিত্র হিসাবে দেখেছিলেন। টিএমসির শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বামপন্থীদের দমনই বিজেপির উত্থানে সহায়ক হয়েছিল। সিপিআই(এমএল) যা বিশ্বাস করে বাস্তবে একটি অগণতান্ত্রিক,লুম্পেন রাজনৈতিক দলের দ্বারা 'ফ্যাসিবাদ' রোখা সম্ভব নয়।
টিএমসিকে বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির অনুরূপ বিবেচনা করা ভুল হবে।ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে আপনি শয়তানকে সমর্থন করতে পারেন না। টিএমসি এবং মমতার সরকার শ্রমিক শ্রেণির সাধারণ ধর্মঘট এবং শ্রমজীবী জনতার লড়াই আন্দোলনের উপর আক্রমণ ও দমন-পীড়ন অব্যাহত রেখেছে,এমনকি মোদি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটেও তাদের এই ভূমিকাই ছিল। নৃশংস নির্যাতনের একটি করুণ উদাহরণ হলেন মইদুল মিদ্যা, ছাত্র-যুব প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালীন পুলিশী মারধরের কারণে গুরুতর আহত হয়ে তিনি মারা যান।
সিপিআই (এমএল) তৃণমূল শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অসন্তোষের গভীরতাকে খাটো করে দেখছে। এটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। বামফ্রন্ট যদি তৃণমূল সরকারের পরাজয়ের জন্য দৃঢ়তার সাথে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে লড়াই না করে, এই তৃণমূল বিরোধী বিপুল অসন্তোষের একটি বড় অংশ বিজেপির অনুকূলে যাবে।এমনকি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও টিএমসির স্বৈরাচারী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে বেশিরভাগ মানুষ বিজেপির পক্ষে ভোট দিয়েছেন, কারণ তারা বিবেচনা করেছিলেন যে বামফ্রন্ট কার্যকরভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারবে না।
পশ্চিমবঙ্গের আজ পরিস্থিতি হ'ল এমন জনগণকে বিজেপির ভয়ানক পরিকল্পনাগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নিজেদের তৃণমূল বিরোধী দৃঢ় অবস্থানের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই (এমএল) যে নির্বাচনী কৌশল নিয়েছে তা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং তালিকায় সিপিআই (এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদকও রয়েছেন। এটা দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে সিপিআই (এমএল) বিভ্রান্তিকরভাবে তৃণমূলকে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি উন্নত রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বিবেচনা করছে।