শেয়ার করুন
সিপিআই(এম) এন আর সি'র বিরোধিতা করছে
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে পাকিস্তান নিজেদের ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণা করলেও ভারত নিজের আত্মপ্রকাশ করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবেই। দেশভাগপূর্ব ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মুসলমান মানুষ ভারতকে নিজেদের মাতৃভূমি মনে করে এদেশেই থেকে যান। ১৯৪৭ সালের জনভিত্তিকে ধরে ১৯৫১ সালে প্রথম জনগণনা করা হয় ও নাগরিকপঞ্জী তৈরি করা হয়। ১৯৫৫ সালে প্রণীত নাগরিক আইনের বলে সেই সময়কার দেশের সীমানার ভিতরে বসবাসকারী সবাইকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে ১৯৬১ সালের ২০শে ডিসেম্বর করদ রাজ্যগুলিকে এবং ফরাসি ও পর্তুগিজ উপনিবেশগুলিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যে দিয়ে সেখানকার সকল বসবাসকারীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ই মে সিকিম ভারতে সংযুক্ত হয়। এছাড়াও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাথে চুক্তিভিত্তিক কিছু ছিট্ মহল বিনিময় হয়েছিল। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫ এবং ২০১৫ সালে সংশোধিত হয়েছিল। শেষ সংশোধন হয়েছে ২০১৬ সালে CAB বিলের নামে যা সম্প্রতি সংসদের দুই কক্ষে পাশ হবার পরে CAA (Citizenship Amendment Act) হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই আইনের প্রয়োগে ভারতে বসবাসকারী সবাইকেই নিজেদের নাগরিক হিসাবে প্রমান দিতে বাধ্য করতে চায় সরকার। সমস্ত ভারতীয়দের কাছে নিজেদের নাগরিকত্বের প্রমান হিসাবে ১৯৫১ অথবা ১৯৭১ সালের সময়কার দলিল চাওয়া হচ্ছে। এর ফলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বেন এদেশের গরিব মানুষ। ১০ বছর অন্তর এদেশে জনগণনা হয় যাতে নাগরিকদের সম্পর্কে সবরকম তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তা সত্ত্বেও জনগনের কাছে স্বাধীনতার ৭০ বছর বাদে নাগরিকত্বের প্রমান চাওয়ার নামে আসলে আর এস এস ও অন্যান্য হিন্দু মৌলবাদী শক্তির রাজনৈতিক মুখ হিসাবে বিজেপি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত করার স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছে। এদেশের সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ন আধারগুলির মধ্যে অন্যতম হল ধর্মনিরপেক্ষতা যা সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের গর্বেরও বিষয়। CAA আইন প্রয়োগ করার মাধ্যমে বিজেপি সরাসরি সেই সংবিধানকেই আঘাত করেছে। এরই ফলে এই আইনের বৈধতা নিয়ে যেমন সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়েছে তেমনই দেশজুড়ে বামপন্থি সহ সবকটি মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলি এই আইনের বিরোধিতা করছে এমনকি বিজেপির শরিক শক্তিগুলিও এই আইনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে। আসামে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নাগরিকপঞ্জীর কাজ করা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী আসামে নাগরিকপঞ্জীর কাজে ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর অবধি কেন্দ্রীয় সরকার মোট ১৬০২.৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছ। এত বিপুল অর্থবরাদ্দের পরেও যে নাগরিকপঞ্জী তৈরি হয়েছে তা ভুলে ভরা, ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে যাদের মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু। ভোটের আগে বিজেপি’র প্রচার ছিল NRC তে কোন হিন্দুর নাম বাদ যাবে না, ঠেকায় পড়ে এখন তারা বলছে ভারতীয় হয়েও যাদের নাম বাদ গিয়েছে তাদের পুরান নথি এবং প্রতিবেশি ৩ টি দেশের থেকে ধর্মীয় কারনে অত্যাচারিত হয়ে যারা এদেশে এসেছেন তাদের অত্যাচারের সার্টিফিকেট জমা দিলেই তারা এদেশে থাকতে পারবেন। এই সার্টিফিকেট তারা কিভাবে পাবেন তার কোন হদিস নেই, CAA তে এই সব শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেবার কোন উল্লেখ নেই। পশ্চিমবঙ্গে জমিহারা মানুষজন ৭৭ সালের পরে জমির মালিকানার দলিল হাতে পেয়েছেন, তারা কি করে ১৯৫১ অথবা ১৯৭১ সালের কাগজপত্র জমা করবেন? বামপন্থিরা এই অমানবিক আইনের বিরোধিতা করছে, আধুনিক যুগে কোন সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এক কলমের খোঁচায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া যায়না, ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে মানবাধিকার হরণ করা যায়না। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে। তৈল উৎপাদন, বিমান, রেল সহ গুরুত্বপুর্ণ সরকারি ক্ষেত্রগুলি নিলাম করে দেবার পাশাপাশি একের পর এক ঘোষণা করে কর্পোরেটদের বিপুল কর ছাড় দিতে ব্যাস্ত সরকার। অথচ এই কর্পোরেটই সরকারি ব্যাঙ্কের থেকে ১১ লক্ষ কোটি টাকা লোপাট করেছে। ধনিদের সুবিধা করে দিতে কর্পোরেট কর ছাড় দেওয়া চলছে অথচ সাধারন জনতার উপর নিত্যপ্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির বিপুল চাপ পড়ছে। শেষ ৫ দশকের হিসাবে বেকারির হার সর্বোচ্চ এখন। এই বাস্তবতার থেকে মানুষের চোখ ঘোরাতেই CAA, NPR এবং NRC’র মত অপ্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি নিচ্ছে সরকার যার ভিত্তি মানুষের মধ্যে ধর্মের নামে বিভেদ, জাতের নামে বিদ্বেষ, সম্প্রদায়ের নামে হানাহানি এবং ভাষার নামে ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া। সারা দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে এই ঘৃণ্য চক্রান্ত আমরা রুখবো।