জনজীবনের জরুরি ১৬ দফা দাবির ভিত্তিতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ সপ্তাহ পালন করবে সিপিআই(এম)। ২০ থেকে ২৬ আগস্ট দেশের সর্বত্র প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হবে। ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষকসভা, খেতমজুর সংগঠনগুলি মিলিতভাবে ৯ আগস্ট দেশব্যাপী যে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে, তাকেও সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি।
২৫-২৬ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়। এই প্রথম অনলাইনে এই সভা হয়। বৈঠকের পরে সোমবার বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর আকস্মিক, অপরিকল্পিত, একতরফা লকডাউনে দেশে মহামারীর বিস্তার ঠেকানো যায়নি। লকডাউনের দীর্ঘ সময়ে চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নতি, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা, ব্যাপক পরীক্ষা, পজিটিভ রোগীদের আইসোলেশনে রাখা, সংস্পর্শের অনুসন্ধান, কোয়ারান্টিন করার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি জোরদার করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। মহাভারতের তুলনা টেনে ২১ দিনের লড়াইয়ের প্রধানমন্ত্রীর বাগাড়ম্বর হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বরং লকডাউন দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে অবর্ণনীয় দুর্দশা ডেকে এনেছে। বিশেষ করে দলিত, আদিবাসী, মহিলা, প্রতিবন্ধীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিপুল কাজ খোয়া গেছে। জীবিকা ধ্বংস হয়েছে, বেড়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র। অবিলম্বে নগদ সাহায্য এবং বিনামূল্যে খাদশস্যের দাবি কেন্দ্রীয় সরকার মানেনি, মহামারী মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখন দায়িত্ব থেকে হাত তুলে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর লকডাউনের ঘোষণার ফলে তৈরি হওয়ায় সঙ্কটের বোঝা এখন রাজ্য সরকার এবং জনগণের কাঁধেই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, মহামারী মোকাবিলায় পূর্ণ মনঃসংযোগের বদলে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজেদের কর্মসূচি রূপায়ণ করে চলেছে। একদিকে জাতীয় সম্পদের অবাধ লুট ও অন্যদিকে শ্রমজীবী জনগণের ওপরে আক্রমণ নামিয়ে আনার মারণ-পথে অর্থনীতিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের আত্মনির্ভরতার নামে যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে তা আসলে দেশি-বিদেশি বেসরকারি পুঁজির কাছে দাসত্ব। দেশের অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে এফডিআই’র জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। রেল, কয়লা, খনি, বিমাও তার মধ্যে রয়েছে। রেল, অর্ডন্যান্স কারখানা, বিএসএনএল সহ অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। শ্রম আইন শিথিল করে শ্রমিকশ্রেণির কষ্টার্জিত অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কাজের সময়ও ৮ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টা করে দেওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করা হচ্ছে। দিল্লিতে আরএসএস-বিজেপি ও তাদের সহযোগীরা যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়েছিল তা আড়াল করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ সম্পূর্ণ মিথ্যা ভাষ্য তৈরি করছে। সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের, সাম্প্রদায়িক হিংসায় আক্রান্তদের দানবীয় ধারায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যারা দাঙ্গা ছড়িয়েছিল তাদের গায়ে হাত দেওয়া হচ্ছে না। উত্তর প্রদেশে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে বিপুল জরিমানা ও সম্পত্তি নিলাম করা হচ্ছে। মহামারীর মধ্যেও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মীদের আটকে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যের কারণে তাঁদের মুক্তি দেবার দাবিতে সরকার কর্ণপাতই করছে না। যে কোনও বিরোধিতাকেই ‘দেশদ্রোহিতা’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি সংবাদমাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো যে অল্প কয়েকজন রয়ে গেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা হচ্ছে। মহামারীর নামে বিজেপি সরকার সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত করছে। সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থানে নস্যাৎ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, রাজ্যগুলিকে তার দায় বহন করতে হচ্ছে। মহামারী মোকাবিলার দায়িত্ব পালন করছে রাজ্যগুলি অথচ তাদের আরও সম্পদ দেবার বদলে প্রাপ্য জিএসটি’র বকেয়াও দেওয়া হচ্ছে না।
স্বৈরাচারের পথে অভিযান সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটি জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, বিজেপি সরকার সমস্ত স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার বর্ধিত চেষ্টা চালাচ্ছে। সংসদের কাজ মারাত্মকভাবে খর্ব করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিচারবিভাগের কাজ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। ইডি এবং সিবিআই কেন্দ্রের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ফেলে দেবার চেষ্টা করছে বিজেপি। বিপুল টাকা খরচ করে বিধায়ক কেনাবেচা, দলত্যাগ ঘটিয়ে এই কাজ করা হচ্ছে।
একই সঙ্গে কেরালায় এলডিএফ সরকারকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াস সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর কনসুলেটের নামে পাঠানো ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে সোনা পাচারের ঘটনাকে নিয়ে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ এবং বিজেপি একই সঙ্গে এলডিএফ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করছে। কাস্টমস এই সোনা ধরেছে, রাজ্য সরকারের পরিধির মধ্যেই এই মামলা পড়ে না। মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন, এখন এনআইএ এই তদন্ত করছে। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। মহামারী মোকাবিলার সময়ে ইউডিএফ এবং বিজেপি’র এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টাকে কেরালার জনগণ প্রতিহত করবেন।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, ভারতের চিরায়ত স্বাধীন বিদেশনীতি পরিত্যাগ করে বিজেপি ভারতকে পুরোপুরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোটসঙ্গীতে পরিণত করছে। মার্কিন বিশ্ব রণনীতির অংশ হয়ে যাচ্ছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে তা ভালো নয়।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, বিরাট অংশের ছাত্রই অনলাইন শিক্ষায় অংশ নিতে পারছেন না। ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হচ্ছে। গ্রাম এলাকায় যথাযথ পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, পঠনপাঠন চালিয়ে যেতে ছাত্ররা যাতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে পারে তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। তা না করে ডিজিটাল পাঠ বা পরীক্ষা করা উচিত হবে না। ডিজিটাল শিক্ষা শারীরিক উপস্থিতিতে পড়াশোনার বিকল্প হতে পারে না।
কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, কোভিডের আগেই ভারতের অর্থনীতির বেহাল দশা ছিল। মহামারীর আগেও পার্টি সরকারি ব্যববরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তুলছিল। কিন্তু নয়া উদারনীতির পথে বাঁধা সরকার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে। অর্থনীতি মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। জিডিপি যে হারে কমবে বলে অনুমান করা হচ্ছে তা জনগণের শোষণকে আরও তীব্র করবে। সরকারের অর্থনৈতিক নীতি অর্থনীতির পুরুদ্ধার ঘটাতে পারবে না, জনগণের জীবনজীবিকার কোনও সুরাহাও করতে পারবে না। এই নীতি কর্পোরেটদের মুনাফা বৃদ্ধির নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্যকে অশালীন স্তরে নিয়ে যেতেই তা সাহায্য করছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি কৃষিক্ষেত্রে অর্ডিন্যান্সগুলির বিরোধিতা করে বলেছে, অত্যবশ্যকীয় পণ্য আইন তুলে নেওয়া হয়েছে, এপিএমসি আইন সংশোধন করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার পক্ষে এই পদক্ষেপ বিপজ্জনক। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে যেটুকু দাম কৃষকরা পাচ্ছিলেন তারও অবসান ঘটবে। গণবণ্টন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে। ভারতীয় কৃষিতে ঢুকবে বৃহৎ বহুজাতিক কৃষিবাণিজ্য, দেশের বড় কর্পোরেটরা। ভারতের কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার নীতি নেওয়া হয়েছে।
জম্মু কাশ্মীর সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারা বাতিলের এক বছর পরেও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা সহ হাজার হাজার মানুষ বন্দি হয়ে আছেন। মানুষের স্বাভাবিক সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা ব্যাহত, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, মহামারীর লকডাউনের আগেই রাজনৈতিক লকডাউন চেপে বসে আছে জম্মু কাশ্মীরের মানুষের ওপরে। ডমিসাইল মর্যাদার সংজ্ঞা বদলে কাশ্মীর উপত্যকায় জনগোষ্ঠীগত বিন্যাস বদলের চেষ্টা হচ্ছে। নতুন মিডিয়া নীতিতে সংবাদের ওপরে প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা ফিসারদের নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ২০১৯-র আগস্ট থেকে বন্দি সকলের মুক্তি, পূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা, জনগণের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।
কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ১৬টি নির্দিষ্ট দাবি জানিয়েছে সিপিআই(এম)। সেগুলি হলো: আগামী ছ’মাস আয়কর দেন না এমন সমস্ত পরিবারকে মাসিক নগদ ৭৫০০ টাকা দিতে হবে; আগামী ছ’মাস যাদের প্রয়োজন এমন সকলকে মাথাপিছু ১০ কিলোগ্রাম খাদশস্য বিনামূল্যে দিতে হবে; বর্ধিত মজুরি সহ রেগার কাজ ২০০ দিন করতে হবে, শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন চালু করতে হবে, সকল বেকারকে বেকার ভাতা দিতে হবে; আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন প্রত্যাহার করার পরিবর্তে তা আরও শক্তিশালী করতে হবে; স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ জিডিপি’র অন্তত ৩ শতাংশ করতে হবে; অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন এবং এপিএমসি আইন বাতিল ও সংশোধনের অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতে হবে; শ্রম আইন শিথিলের উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে; রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রেল, বিদ্যুৎ, পেট্রোলিয়াম, কয়লা, ব্যাঙ্ক, বিমা, প্রতিরক্ষা উৎপাদনে বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে; প্রধানমন্ত্রীর নামে বেসরকারি ট্রাস্টে সংগৃহীত অর্থ রাজ্যগুলিকে হস্তান্তর করতে হবে; বিপর্যয় মোকাবিলা আইন চালু থাকায় মহামারীতে মৃতদের পরিবারকে জাতীয় বিপর্যয় রিলিফ ফান্ডের বিধি মেনে এককালীন আর্থিক সাহায্য দিতে হবে; তফসিলি জাতি-আদিবাসী-ওবিসি ও প্রতিবন্ধী সংরক্ষণ কঠোরভাবে রূপায়ণ করতে হবে; পূর্বেকার সেমিস্টারের ফলাফলের ভিত্তিতে অন্তিম বর্ষের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রি দিতে হবে; জম্মু কাশ্মীরে ২০১৯-র আগস্ট থেকে বন্দিদের মুক্তি চাই; রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, পরিবেশ মূল্যায়ন ২০২০-র নির্দেশ প্রত্যাহার করতে হবে; দলিত,মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসা, আদিবাসীদের শোষণ বন্ধে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
সূত্র: গণশক্তি পত্রিকা
শেয়ার করুন