রবিকর গুপ্ত
ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী - ঝাঁসির রানী ব্রিগেডের নেত্রী, সুভাষচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী। কমরেড লক্ষ্মী - ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর নেত্রী, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। লক্ষ্মী সেহগল (স্বামীনাথন)-এর জীবন সম্পর্কে যাঁদের কিছুমাত্র ধারণা রয়েছে, এই দুটি পরিচয় সম্পর্কেই তাঁরা জানেন। কিন্তু কীভাবে লক্ষ্মী প্রথম থেকে দ্বিতীয় পরিচিতিতে এলেন, তার কাহিনি অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত। প্রথমেই যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে, তা হল ক্যাপ্টেন থেকে কমরেড লক্ষ্মী হয়ে ওঠার মাঝে দীর্ঘ কয়েক দশকের ব্যবধান। আসলে যে মানুষের রাজনৈতিক চেতনা তৈরি হয়েছে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটে সুহাসিনী চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে, যিনি ডাক্তারি পড়ার পাশাপাশি সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ নিয়ে যে বই পেতেন সেই বইই পড়ে ফেলতেন, যাঁর মনে গভীরতম রেখাপাত করেছিল এডগার স্নো-এর ‘Red Star over China’, সেই ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দেওয়া সত্যিই বিস্ময়কর।
কেন এমন হল? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সুভাষ-কমিউনিস্ট বিরোধের জন্য ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নিজে মতাদর্শের দিক থেকে কমিউনিস্ট হলেও হয়তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাননি - এইরকম কেউ মনে করতে পারেন। কিন্তু আদত ইতিহাস এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। ক্যাপ্টেন সেহগল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন -
‘যাইহোক, এত কাজ সত্ত্বেও আমার মধ্যে একটা ছটফটানি ছিল, সেটা প্রধানত রাজনৈতিক। যে-ভাবে কাজকর্ম চলছে তাতে আমি একটুও সন্তুষ্ট ছিলাম না। স্বাধীনতার ফলভোগ করছে কেবলমাত্র কয়েকটি লোক। শ্বেতকায়দের জায়গা দখল করেছে কৃষ্ণকায়রা। নিয়ম সব একই রকম রয়েছে, যদি এর পরিবর্তন না হয় তবে অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকবে। আমার নিজের বিশ্বাস ছিল, এখনও আছে, যে কেবলমাত্র আমাদের মূল্যবোধের সঙ্গে খাপ খেতে পারে এমন সমাজতন্ত্র আমাদের সমস্যার সমাধান করার সাহায্য করতে পারে। বার্মা থেকে ফেরার পর থেকে আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, রাজনৈতিক কাজ করার জন্য। কিন্তু তাঁরা আমায় (ফ্যাসিস্ট) জাপানী যোগাযোগের জন্য এড়িয়ে চলেছেন।’
কংগ্রেসের নেতা ও সমর্থকরা তাঁকে আরও জঘন্য ভাবে অপমান করেছিল, তার বিস্তৃত বিবরণও তাঁর স্মৃতি কথায় আছে। ভারতীয় জনসঙ্ঘের রাজনীতিকে তিনি প্রবল অপছন্দ করতেন। সোশ্যালিস্ট রাজনীতিতেও তাঁর ভরসা ছিল না। তিনি শুরু থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরাই তাঁকে এড়িয়ে চলেছিলেন দীর্ঘকাল। সুভাষচন্দ্রের স্মৃতির প্রতি কমরেড লক্ষ্মী দায়বদ্ধ ছিলেন। 'যা করেছি ভুল করেছি' এই মুচলেকা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঠিক এই কারণেই ইচ্ছা থাকলেও দীর্ঘকাল লক্ষ্মীর পক্ষে সম্ভব হয়নি ক্যাপ্টেন থেকে কমরেড হয়ে ওঠা।
সুযোগ হল পার্টি ভাগের পর, বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে। নবগঠিত সিপিআই(এম)-এর আই.এন.এ এবং সুভাষচন্দ্র প্রসঙ্গে ছিল নতুন মূল্যায়ন। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে স্বয়ং জ্যোতি বসু ক্যাপ্টেন সেহগলকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করলেন কলকাতায় পিপলস রিলিফ কমিটিতে যোগ দিতে। লক্ষ্মী অভিমান করতে পারতেন, কমিউনিস্টদের পূর্ববর্তী শীতলতার, প্রত্যাখ্যানের শোধ নিতে পারতেন। তিনি তার ধারে কাছ দিয়ে গেলেন না, কমিউনিস্টদের তিনি চিরকালই আপন মনে করে এসেছেন, কমিউনিস্টরাই তাঁকে নিজেদের লোক মনে করেনি। যখন এই ব্যবধান দূর করার সুযোগ এল, তিনি সানন্দেই নিলেন। প্রথমে পিপলস রিলিফ কমিটি পরে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সদস্যদের নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে তিনি যা কাজ করলেন তা অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই প্রেক্ষিতে তাঁকে সদস্যপদ দেওয়ার কথা হয়। লক্ষ্মী অবশ্য সিপিআই(এম) পলিটব্যুরোর সদস্যদের সঙ্গে একবার দেখা করেছিলেন পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগে। সেখানে সুভাষচন্দ্র আর আই.এন.এ নিয়ে পার্টির নেতাদের মতামত কি সেটা বুঝে নিয়ে তারপরই পার্টিতে যোগ দেন। সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করে না, এমন দলে তিনি যোগ দিতে আগ্রহী ছিলেন না।
ক্যাপ্টেন সেহগলের আজ প্রয়াণ দিবস। তিনি বারবার বলেছিলেন, স্বাধীনতা তিন ধরণের হয় - রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক। ভারতে শুধু আমরা প্রথম স্বাধীনতাটি অর্জন করেছি। বাকি দুই স্বাধীনতা এখনও অর্জিত হয় নি। সেই অর্জনের পথে যে বিরাট পাহাড় আছে, তাতেই আমাদের হাতুড়ির ছোট ছোট ঘা মেরে যেতে হবে। একদিন পাহাড় ভেঙে রাস্তা দেখা যাবেই। ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করতেন এই কথা। আমাদেরও বিশ্বাস করতে হবে।