সূর্য মিশ্র
কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এমন একজন মানুষ ছিলেন যাঁর মনের ভিতর ঢুকতে না পারলে তাঁকে চেনা কঠিন ছিল। তাঁকে না চিনতে পারলে ভুল বোঝার সুযোগ ছিল। ভুল বুঝেছেন অনেকে। যেটা করতে হবে বলে ঠিক করতেন, সেটা করতে হবে, এমনই ছিল তাঁর ভিতরটা। সোজা, স্পষ্টভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতেন। তাতে দৃঢ়তা থাকতো, কিন্তু রুক্ষ হননি কখনও। পরিবার থেকে পার্টি অথবা সরকার — প্রতি ক্ষেত্রে তাঁর ছিল গণতান্ত্রিক মনোভাব। অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কখনও করতেন না। আবার মতাদর্শগতভাবে ছিলেন দৃঢ়। কিন্তু বিতর্কে কখনও বিরূপ হননি।
১৯৯১-এ আমি বিধায়ক হই। পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয় পার্টির পক্ষ থেকে। পরের বার তার সঙ্গে যুক্ত হয় ভূমি ও ভূমিসংস্কার। সেই সময় বুদ্ধদা আমাকে বলেন, আপনাকে একটি লেখা লিখতে হবে ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত নিয়ে। সেটি তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর পুস্তিকা হিসাবে প্রকাশ করবে। সেটা আমি লিখি। এরপর আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ভূমিসংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে বলতে, বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা জানতে যেতে হয়েছে। বুদ্ধদাই আমাকে প্রথম বিদেশে নিয়ে যান, ভিয়েতনামে। ভিয়েতনামে আমরা অনেক গ্রামে গেলাম। দেখলাম কীভাবে ওরা গ্রামোন্নয়ন-বিকেন্দ্রীকরণের কাজ করছে। শহর এবং শিল্পাঞ্চলেও গিয়েছিলাম আমরা। ফিরে আসার পরেও আমাকে বললেন ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা লিখতে হবে। লিখলাম। গণশক্তিতে প্রথম একটি লেখা প্রকাশের পর বললেন, এত ছোট কেন? আমি বললাম, আমার একটি লেখায় হবে না। তিন-চারটি কিস্তিতে লিখতে হবে। বললেন, ভালো। সেই লেখা বেরোল। তারপর উনি আমাকে এনে দিলেন একটি বই। চীনে ভূমিসংস্কার বিষয়ে। সেটি আবার বাংলায়। বাংলাদেশের সরকার একসময় মাও-পরবর্তী চীনের ভূমিসংস্কারের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রচার করেছিল। আমি চীনে ভূমিসংস্কার বিষয়ে সেই বই পড়ে আমার মতামত দিয়েছিলাম বুদ্ধদাকে। তা মেনেও নিয়েছিলেন। দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য সহ অনেক বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা ছিল। উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে এত এত খুঁটিনাটি জানতেন যে, আমরা কোথাও আটকে গেলে ওঁকে জিজ্ঞেস করতাম। আমার সঙ্গে বুদ্ধদার মিলের অন্যতম জায়গা স্তালিনের ভূমিকা সম্পর্কে। কমরেড স্তালিনের গৌরবোজ্বল ভূমিকা সম্পর্কে ছিলেন অকুন্ঠ। মতাদর্শগত বোঝাপড়া ছিল খুব প্রখর এবং স্পষ্ট। বুদ্ধদা মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আমরা যা পরিকল্পনা করেছিলাম তাতে শিশুমৃত্যুর হার কমেছিল। ভূমিসংস্কার, বিকেন্দ্রীকরণ থেকে নগরায়ন, শিল্প, সংস্কৃতি এমন অনেক ক্ষেত্র ছিল যাতে তাঁর ভূমিকা ছাড়া আমরা এগোতে পারতাম না। আমরা তিনজন, নিরুপমদা মন্ত্রীসভায় যুক্ত হওয়ার পর, আমাদের একটি দৃঢ় বোঝাপড়া ছিল। আমরা তার কিছুদিন আগে থেকেই বুঝেছিলাম যে, গ্রামে কাজের অভাব হচ্ছে। তার জন্য শিল্পের দরকার। একইসঙ্গে আমরা বুঝেছিলাম ক্ষমতার আরও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। পঞ্চায়েতকে মানুষের আরও কাছে নিয়ে যেতে হবে। কৃষিতে অগ্রগতি জন্য, পঞ্চায়েত এবং বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতেও শিল্প করতে হবে। জ্যোতি বসু প্রথম থেকেই শিল্পায়নের কথা বলে এসেছেন। উদারনীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলবে, কিন্তু উদারনীতির কারণে লাইসেন্সিং এবং মাশুল সমীকরণ উঠে যাওয়ায় আমাদের তার সুবিধা নিতেই হবে। বুদ্ধদাও সেই কথাই বারবার বলেছেন। সিঙ্গুর, শালবনী হলে আমরা অনেকগুলি ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প আনতে পারতাম। আবার নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে ২০০৭-র ফেব্রুয়ারিতে বুদ্ধদাই বলে এসেছিলেন যে, মানুষ না চাইলে এক ছটাক জমিও আমরা নেবো না। যখন আমরা শিল্পের উদ্যোগ নিয়েছি, সেই সময়েই রাজ্যের ৪৬১২টি পিছিয়ে থাকা গ্রামকে আমরা চিহ্নিত করেছি, মিড ডে মিলে জোর দিয়েছি। এমন বেশ কিছু কাজ আমরা সেই সময়ে করেছি, যে ক্ষেত্রগুলিতে বুদ্ধদা’র বিশেষ নজর ছিল। আমাদের মধ্যে পার্টিতে কিছু বিষয়ে ভিন্ন মত হয়েছে। কিন্তু তাতে আমাদের বোঝাপড়া, কাজে কোনও অসুবিধা হয়নি। চন্ডীগড় পার্টি কংগ্রেসে আলোচনার সময় বলেছিলাম, বারবার বলা হচ্ছে গণতন্ত্রের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ। ঠিক। কিন্তু গণতন্ত্রের অগ্রবর্তী ঘাঁটি কী থাকতে পারে, যদি তার লাগোয়া এলাকাগুলিতে শক্তি না বাড়ানো যায়? আমি নামতেই বুদ্ধদা বলেছিলেন, ভালো বলেছেন।
তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে ছিল অগাধ জ্ঞান। বিশ্ব সাহিত্য অনুবাদ করেছেন। আবার সুকান্ত ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে জয়দেব বসু — সবার লেখা পড়া ছিল। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা কী বলবো? তাঁর লেখা বুদ্ধদা অনর্গল বলে যেতে পারতেন। সব মিলিয়ে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন এক বহুমাত্রিক প্রতিভা।
আজ গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত