চন্দন দাস
বাংলায় লেখা একটিই বই দু’বার নিষিদ্ধ হয়েছিল অবিভক্ত পাকিস্তানে। অন্যতম ‘কারন’ — সূর্য সেন!
বাংলাদেশের তখনও জন্ম হয়নি। বইটির নাম ‘ভাসানি যখন ইউরোপে।’ লেখক খোন্দকার মহম্মদ ইলিয়াস। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম প্রধান জননেতা মওলানা ভাসানির ইউরোপ যাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই বই। ১৯৫৪-তে ভাসানি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বার্লিনে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে। কিন্তু ইউরোপে গেলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকদের বাধায় সেই সম্মেলনে মওলানা ভাসানি যোগ দিতে পারেননি।
তাঁর সেই সময়কার ইউরোপ যাত্রার বিবরণ, বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য এবং পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়েই সেই বই লেখা হয়েছিল। যা দু’বার নিষিদ্ধ হয় — ১৯৫৮ এবং ১৯৬৫।
আমরা মূলত ১৯৫৮-তেই সীমাবদ্ধ থাকব প্রসঙ্গের স্বার্থে। প্রসঙ্গ কী? সূর্য সেন। আজ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সেই সর্বাধিনায়কের ১২৮তম জন্মদিন। ভাসানিকে নিয়ে লেখা বইয়ের সঙ্গে সূর্য সেনের কী সম্পর্ক? তা বেশ চমকপ্রদ। বইটির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য ঢাকার হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেছিলেন কয়েকজন। হাইকোর্ট রিট পিটিশন অগ্রাহ্য করে। নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আকবর খান রনো ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ-দ্বিতীয় খন্ড’-এ লিখছেন,‘‘হাইকোর্টের রায়ে এক জায়গায় বলা হয়েছে যে, লেখক খন্দকার ইলিয়াস সূর্য সেনের প্রশংসা করেছেন। হাইকোর্ট বলেন, সূর্য সেন হলেন একজন ডাকাত, খুনী ও রাষ্ট্রদ্রোহী। তাই হাইকোর্টের মতে যে বইয়ে এমন ব্যক্তির প্রশংসা করা হয়েছে, তা নিষিদ্ধ করাই উচিত।’’
সূর্য সেন শহীদ হয়েছেন তাঁর ২৪ বছর আগে। তাঁর এবং তারকেশ্বর দস্তিদারের মৃতদেহ মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ফাঁসির পরে। তবু দেশের স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াই করা এক অসাধারণ সংগঠকের প্রতি ঘৃণা হারায়নি মৌলবাদী শক্তি। এই ঘৃণা জন্ম নেয় ভয় থেকে।
শুধু সূর্য সেন নয়, ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের দাবিদার মৌলবাদীরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের সেনানীদের এমন চোখেই দেখতেন। তৈরির কয়েক বছরের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক মিত্র হয়ে ওঠা পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শাসকরা সেই জঘন্য মনোভাব দ্বারাই পরিচালিত হয়েছেন।
কোথাও কী সাদৃশ্য আছে হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে ? আছে। অনেকটা আছে। আরএসএস-র চোখে সূর্য সেন কেমন, তা দেখার আগে একবার দেখা যাক চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক কেমন ছিলেন। তাঁর সংগঠন গড়ে তোলার পথে ধর্মের ভূমিকা আদৌ কেমন ছিল? ১৯১৮-তে মাস্টারদা এবং তাঁর সহযোগীরা একটি সংবিধান তৈরি করেন দলের। সঙ্গীদের মত নিয়ে সংবিধানটি লিখেছিলেন অনুরূপচন্দ্র সেন। যিনি বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগনার বুড়ুলে আত্মগোপনকালে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। পরে ব্রিটিশরা তাঁকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে। বারাণসীতে অন্তরীণ থাকাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়। কমরেড প্রভাস রায়, পলাশ প্রামাণিকরা তাঁরই অনুপ্রেরণায় বিপ্লবের লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
সেই সংবিধানে ধর্মীয় ভাবাবেগের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ছিল ‘সবাই মিলে একসঙ্গে বসে আলোচনা’ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্কল্প। যে বিপ্লবী পরিষদ এই সংবিধান রচনা করেছিল, তার প্রথম পাঁচজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হলেন— সূর্য সেন, অনুরূপচন্দ্র সেন, নগেন্দ্রনাথ সেন তথা জুলু সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী এবং চারুবিকাশ দত্ত। প্রথম সারির সদস্যরা ছিলেন— আসরাফউদ্দিন, নির্মল সেন, প্রমোদরঞ্জন চৌধুরি, নন্দলাল সিংহ, অবনী ভট্টাচার্য তথা উপেনদা, অনন্তলাল সিংহ এবং গণেশ ঘোষ। প্রত্যেককে শপথ নিতে হয়েছিল। কী ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন? গীতা নয়— তাঁরা গোপন সেই সংবিধান ছুঁয়ে শপথ নেন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার।
১৮ এপ্রিল, ১৯৩০-এ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সোচ্চার ঘোষণায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কেঁপে উঠল। ‘চট্টগ্রাম’ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক অনবদ্য অধ্যায় রচনা করল। শুধু আত্মত্যাগের মহিমায় নয়। নতুন পথ দেখায় সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখা। অস্ত্রাগারের বিরাট লোহার গেট দেওয়াল থেকে ভেঙে ধসিয়ে দেওয়ার পর কী স্লোগান উঠেছিল? ১৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পূর্ণেন্দু দস্তিদারের অভিজ্ঞতায়,‘‘…উল্লসিত বিপ্লবীদের গগনবিদারী ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ ও ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে চট্টগ্রামের নৈশ-আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।’’
এই দুটি স্লোগান, একই সঙ্গে, বারবার আমরা উচ্চারিত হতে দেখব ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির অভিযানে। এমনকি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মৃতদেহের পাশে উদ্ধার হওয়া তাঁর শেষ আহ্বানেও সেই দুটি স্লোগান।
গ্রামের গরিবদের মধ্যে চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগ্রামীদের দুর্দান্ত প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিরল উপাদান।
একাধিক ঘটনা আছে। যেমন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মী কামালউদ্দিন যুব বিদ্রোহের সেনানী বিধুভূষণ সেনকে জানিয়েছিলেন যে, পুলিশ কানুনগো পাড়া ঘিরে ফেলার পর কামালউদ্দিনের পরিবার তাঁদের উঠোনের বাঁধানো কবরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মাস্টারদাকে। উপরে তাঁর নানি চাটাই পেতে বসে ঝিমোতে শুরু করেন। পুলিশ ঢুকে খানাতল্লাশি করে এবং ব্যর্থ হয়। কারণ তারা ভাবতে পারেনি সূর্য সেনের মতো এক হিন্দুকে নিজেদের কবরে ঢুকিয়ে দিতে পারে গ্রামীণ মুসলমান!
সেই সূর্য সেন ধরা পড়ে গেছিলেন একজনের বিশ্বাসঘাতকতায়। বেইমানের নাম? নেত্র সেন। বিশ্বাসঘাতকের কোনও ধর্ম হয় না। চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের এও এক শিক্ষা। গরিব হিন্দু অথবা মুসলমান — গ্রামের অথবা শহরের — সূর্য সেন এবং তাঁর বাহিনী ছিল তাঁদের আত্মীয়। সেই সূর্য সেন হলেন ‘বেইমান’! মাস্টারদার ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির প্রত্যেক সদস্য ‘জাতির শত্রু।’ ‘বিশ্বাসঘাতক’ সতীশ পাকড়াশি, ভগৎ সিং। কে মনে করেছেন এই কথা? আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, মমতা ব্যানার্জি যাদের ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ বলে ঘোষণা করেছেন, সেই সংগঠনের ‘গুরুজী’র এটিই মত, উপলব্ধি— এবং তা তিনি লিখেওছেন। স্বাধীনতার আগে লিখেছেন। পরেও লিখেছেন।
লোকটি কে? মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)’র দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক। তাঁর এই উপলব্ধি রেখে গেছেন ‘উই অর আওয়ার ন্যাশানহুড ডিফাইনড’ বইয়ে। বইটি মূলত দেশ, জাতীয়তাবোধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সমাজ সম্পর্কে গোলওয়ালকারের বীভৎস ধারণার আকর। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৩৯-এ। প্রথম প্রকাশের মুখবন্ধে গোলওয়ালকার জানিয়েছেন যে, ১৯৩৮-র নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বইটির পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ছাপতে দেরি হয়েছে।
ততদিনে মাস্টারদার ফাঁসি হয়ে গেছে। ফাঁসি হয়ে গেছে তারকেশ্বর দস্তিদারের। তাঁদের দেহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভাসিয়ে দিয়েছিল সাগরে।
তবু নিজের সেই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে গোলওয়ালকার লিখছেন,‘‘শুধুমাত্র সেই আন্দোলনগুলিই সত্যিকারের ‘জাতীয়’ যেগুলি বর্তমান অসাড়তা থেকে হিন্দু ধারণার পুনর্গঠন, পুনর্জাগরণ এবং মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত। তারাই জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক, যারা, হিন্দু জাতিকে এবং রাষ্ট্রকে হৃদয় দিয়ে গৌরবান্বিত করার উদ্দীপনায় কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন এবং লক্ষ্যপূরণে সংগ্রাম করছেন। বাকি সবাই হয় জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতক অথবা শত্রু, অথবা, দাতব্য ধারণার বশবর্তী, বোকা।’’
১৯৩৭-’৩৮-এ হিন্দুত্ববাদী, সাভারকারের গুণগ্রাহী লোকটির এই ক্রোধের কারণ কী? কিছুটা জবাব আছে সতীশ পাকড়াশির আত্মজীবনীতে। ‘অগ্নিদিনের কথা’য় সতীশ পাকড়াশি লিখছেন, ‘‘প্রথমটায় আমরা স্বদেশি দলের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে মধ্যযুগীয় চিন্তাধারাই পেয়েছিলাম। ভারতের গৌরবময় অতীতের সনাতন সভ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। রাম-রাজ্য স্থাপনের পটভূমিকায় ছিল আমাদের লক্ষ্য পথের সাধনা। দেশীয় রাজ্যের কোনও রাজাকে ভারতে সিংহাসনে নির্বাচন করার আলোচনাও চলত। পরে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপনের আলোচনা হতো।’’ অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রামীদের একাংশের মধ্যে নির্দিষ্ট আদর্শের অভাবে পুনর্জাগরণবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ধারণায় পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা ছিল।
সূর্য সেন এবং তাঁর সহযোগীরা গোড়া থেকেই ভিন্ন মতের পথিক। তাঁরা স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ দেশের জন্য লড়েছিলেন। প্রাণ দিয়েছিলেন। তাই দুই সাম্প্রদায়িক শক্তিরই শত্রু সূর্য সেন।
আর তাই, কোনও সন্দেহ নেই যুব বিদ্রোহের সর্বাধিনায়কের জীবন আমাদের অনুপ্রেরণা — চিরকালের।