পার্থ মুখার্জি
সাধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অভিধানে বিপ্লব শব্দটির অর্থ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বহু তাত্ত্বিক ভাবনা থাকলেও ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রটি কিন্তু কেন্দ্রীয়। রাষ্ট্রক্ষমতা হরির লুটের বাতাসা নয়, রাস্তাঘাট থেকে তা কুড়ানো যায় না। শাসক শ্রেণী ক্ষমতা ছেড়ে কোন সকালী ভোরে বান প্রস্থে চলে যাবে এমন মনোভাব না থাকাই শ্রেয়। তাই স্বেচ্ছায় কোন শাসক শ্রেণী ক্ষমতা ছাড়ে না, বরং তা ধরে রাখার জন্য তৈরি করে অবিশ্বাস্য হিংস্রতা।
১৯৬৭ সালের ১৫ই অক্টোবর। কমরেড ফিদেল টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। দেশবাসীকে জানালেন কমরেড 'চে' মৃত্যুর খবর সঠিক। তিন দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালনের কথা তিনি ঘোষণা করেন, পাশাপাশি এও ঘোষণা করেছিলেন এই দিনটিকে ‘বীর গেরিলা দিবস’ হিসাবে স্মরণ করা হবে। মৃত্যুর আগে ‘চে’র শেষ কথা হয় ‘রোদরিগেসের’ সাথে। ‘চে’ কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘আপনি কি কোন বার্তা রেখে যেতে চান?’ উত্তরের ‘চে’ বলেছিলেন, ‘ফিদেল’কে বলবেন, আমেরিকাতে বিপ্লব জয়যুক্ত হবে’। ‘চে’কে যিনি গুলি করে হত্যা করেছিলেন তার নাম তেরান। গুলি করার পূর্বে তিনি আকন্ঠ মদ্যপান করেছিলেন। রোদরিগেস ‘চে’ এর মুখে গুলি চালাতে বারণ করেছিলেন। কারণ হিসেবে জানিয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে দেখাতে হবে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছেন। তখন ছিল বেলা একটা দশ।

১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর ৩৯ বছর বয়সে শহীদ হলেন মেজর চে। চে কিন্তু তার আসল নাম নয়। আসল নাম আর্নেস্টো গুয়েভারা। আর্জেন্টিনার গুয়ারানী অঞ্চলে আদিবাসীদের ভাষাতে ‘চে’ শব্দের মানে বিস্ময়, উল্লাস ,সমর্থন অথবা প্রতিবাদ। প্রতিবাদীরাই তার নাম রাখেন ‘চে’। ‘চে’র পিতা প্রথমে চা বাগানের মালিক ছিলেন পরে গৃহ নির্মাণ ব্যবসায় যুক্ত হন। অন্যদের ঠকিয়ে তিনি বড়লোক হতে পারেননি তাই অন্যরা তাঁকে ঠকিয়ে বড়লোক হয়ে গেছে। শিশু কাল থেকেই কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা। ভালোবাসতেন 'পাবলো নেরুদা'র কবিতা। ১৯৫৫ সালে জুন মাসের শেষে দুজন কিউবান চিকিৎসকের সাথে চে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। তার কিছুদিন বাদ রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয়।
সেখানেই তিনি ফিদেলের কথাটি শোনেন । ‘---------Condemn me, it doesn't matter. History will absolve me’ তিনি বিশ্বাস করতেন,'Ideas can not be killed.'চে র নিজস্ব বিশ্বাস ছিল বিপ্লবীদের অনেক বেশি সহজ-সরল থাকা উচিত, মেলামেশা করা উচিত প্রত্যেকের সাথে। শুধু বিলাসিতাই যেন ধর্ম না হয়ে ওঠে।বলতেন, পুঁজিবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রকে একসাথে মিলিয়ে দিও না। বিশ্বাস করতেন বারুদের গন্ধ না শুঁকে বা জনগণের জয়ধ্বনি না শুনে তোমার জীবন শেষ হবে না। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তাত্ত্বিক আলোচনা অপেক্ষা বাস্তব উদাহরণ জনগণের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।আমাদের মতো দেশ উদাহরণের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। ১৯৬৪র ডিসেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশনে যোগ দিতে চে রওনা হন। ফিরে আসেন ১৯৬৫ সালে ১৪ই মার্চ। এর পরেই তার অন্তর্ধান। এই অন্তর্ধানকে নিয়ে বহু কুৎসা হয়েছিল কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সংবাদপত্র মারফৎ ছড়ানো হয়েছিল কুৎসা। প্রচার ছিল ফিদেলের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ‘চে’ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন এই প্রশ্নের উত্তরে ফিদেল বলেছিলেন, এটা তার নিজের উপরে নির্ভর করছে। তিনি কোথায় আছেন,আমরা অন্যকে তার খবর দিতে বাধ্য নই।
১৯৬৫ র ৩রা অক্টোবর ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারাকে দেওয়া চিঠি উন্মোচন করেন যেখানে লেখা ছিল পার্টি নেতৃত্বের পদ থেকে, মেজরের পদ থেকে সরকারিভাবে পদত্যাগ করছি। সেই সঙ্গে কিউবার নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চাই। চিঠির সবশেষ লেখা ছিল কোন সম্পত্তি বা টাকা পয়সা রেখে যেতে পারলাম না কিন্তু আমি সরকারের কাছে কিছু চাই না। আমি জানি সরকার আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা করবেন। কমরেড ফিদেল’কে বারে বারে বলতেন অন্য দেশের মুক্তি সংগ্রামে যাব, তোমরা আমাকে আটকাতে পারবে না। সত্যিই তাকে আটকানো যায়নি।
বিশ্বাস করি চে মানে শেকল ছেঁড়ার গান।
চে মানে অন্ধ আবেগে ভালোবাসা। চে’র সেই কথা ‘রক্তের নদী বান ডাকলেও লড়াই বাড়ে আরো দুর্নিবার’। খোদ মার্কিন মুলুকেও আজও উঁকি মারে তার মুখ। আজও যুব সমাজের রোমান্টিক বিপ্লবী মুখ ‘চে’। কিউবা ছেড়ে যাওয়ার আগে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি তার স্ত্রী পুত্র কন্যাদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন এর মধ্যে একটি চিঠির কয়েকটি কথা উচ্চারণ না করলে চে’র অবমূল্যায়ন করা হয়। দেশ ছাড়ার আগে পুত্র ফেলিক্স সূয়ারেজ কে লেখা চিঠিতে বলেন ‘তুমি সর্বদাই সতর্ক থাকবে এবং উত্তম দৃঢ়তা উৎসাহের সঙ্গে বিপ্লবকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করবে। কারণ এই বিপ্লবের জন্য অনেক রক্তপাত হয়েছে আর এই বিপ্লব জনগণের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। সত্য যতই অপ্রিয় হোক না কেন তাকে সর্বদা আকড়ে ধরে থাকবে।’ সবশেষে বলেছিলেন ‘কখনো গোলামী বা তোষামদি করবে না এবং নিজেকে জাহির করবে না। তোমাকেই সর্বদা তোমার নিজের কঠোরতম সমালোচক হতে হবে.’ বলেছিলেন তোমার মাতৃভূমি জন্য একজন যোগ্য সন্তান হয়ে ওঠো। একজন বিপ্লবী হও, একজন কমিউনিস্ট হও।’