চে গ্যেভারাঃ যে মতাদর্শের মৃ্ত্যু নেই

সমন্বয় রাহা

আজ ৯৫ বছর হল বিপ্লবী চে-র। আজ থেকে ৯৫টা বছর আগে আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্ম চে গ্যেভারার। গোটা পৃ্থিবীতে এই উদাহরণ বিরল বললেও কম বলা হয়, যে এমন একজন পৃথিবীর ইতিহাসে আছেন যিনি একদেশে জন্মেছেন এবং অন্তত দুটো মহাদেশের বিস্তৃত এলাকায় বিপ্লবী এবং প্রগতিশীল কাজের সাথে লিপ্ত থেকেছেন। শুধুমাত্র এই উদাহরণ দেখিয়েই চে গ্যেভারা’কে বর্তমান প্রজন্মের কাছে একজন বিপ্লবী হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত করানো যায়।

সালটা ১৯৬৭, ৮ই অক্টোবর। চে’কে হত্যা করার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে ফেলেছে বলিভিয়া সরকার। যদিও তখনও আমেরিকা হাতে চাইছে গ্যেভারা’কে। বলিভিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল সরকার তখনও চায় না তাঁকে কারোর হাতে হস্তান্তর করতে। লোকচক্ষুর আড়ালেই খুন করতে চায় চে-কে। কারণ গোটা বিশ্বের সামনে চে-কে খুন করলে যে সহানুভূতির হাওয়া বইবে চারপাশে, তাতে উড়ে যেতে পারে বলিভিয়ার তখনকার প্রতিক্রিয়াশীলরা।

ফলত শুরু হল এক অসম লড়াই।ভোরের বলিভিয়া জেগে ওঠার আগেই, গগনভেদী আওয়াজ দুর্গম পাহাড়ের জঙ্গলের ভেতর থেকে। চারপাশে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় সঙ্গী সাথী দের লাশ পড়ে আছে। রাইফেলের গুলি জঙ্গলের গাছগাছালিকে এফোড় ওফোড় করে বেরিয়ে যাচ্ছে। হাত থেকে ছিটকে হারিয়ে গেছে দীর্ঘদিনের সঙ্গী রাইফেল। আসতে আসতে চারপাশ দিয়ে এগিয়ে আসে বলিভিয়ার সেনাদল।

শিকারের খোঁজে উন্মত্ত হায়নার মতো অবস্থা হয়েছিল বলিভিয়ার সেনাদলের। যে মুহূর্তে চে ধরা পড়েন, তখন তিনি রক্তাক্ত অবস্থায়। পা ক্ষতবিক্ষত। হাঁটতেও পারছেন না। সেই অবস্থায় ইউরো গিরিখাতের জঙ্গল থেকে টানতে টানতে মাইল চারেক দূরে লা হিগুয়েরা শহরেরও বাইরে এক স্কুল বাড়ি তে নিয়ে আসা হয় চে’কে। বলিভিয়ার বর্তমান প্রগতিশীল সরকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসা চে-র শেষ এই রাস্তা টার নামকরণ করেছে "রুটা দেল চে" অর্থাৎ চে রুট।

সেই স্কুলবাড়ি তেই চলে টানা জিজ্ঞাসাবাদ।সঙ্গে চলছিল অকথ্য গালিগালাজ এবং অত্যাচার। হাত পা বাঁধা,মাথার চুলে জট লেগে গেছে, গোটা গায়ে ধুলো মাখামাখি অবস্থা। গায়ের জামাও প্রায় ছিন্নভিন্ন অবস্থা। হাজার প্রশ্ন এবং অত্যাচারও তাঁর মুখ খোলাতে পারেনি। তাঁর সাথী দের সম্পর্কে একটা খবরও বের করা সম্ভব হয়নি।

উলটে প্রশ্নকর্তার দিকে ছিল স্থির চাহনি।

এই হচ্ছে বিপ্লবী গোপনীয়তা। যা বিপ্লবের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস (Conviction) না থাকলে সম্ভব নয়।

এই স্কুলবাড়ির পুরো ঘটনা জানা যায় সেখানে উপস্থিত বলিভিয়ান এয়ার ফোর্সের পাইলট  জাইমে নিনো ডি গুজমান এর সাক্ষাৎকার থেকে। নিজের প্রিয় তামাক শেষ হয়ে গেছিল চে-র। পাইলটের কাছে চাইলে পাইলট তাঁকে তামাক জোগাড় করে দেন। নিনোর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় পাইপে তামাক ঠাসতে ঠাসতে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি চে।

পরের দিন সকাল। অর্থাৎ ৯ই অক্টোবর।

গ্যেভারা চেয়েছিলেন ওই গ্রামের কয়েকজন স্কুল শিক্ষকের সাথে। দেখা করতে এসেছিলেন কয়েকজন শিক্ষকের একটা দল। তার মধ্যে ছিলেন ২২বছরের একজন শিক্ষিকা।নাম জুলিয়া কোর্তেজ। পরবর্তী কালে জানা যায় জুলিয়ার কাছ থেকে ভেতরের কাহিনী। শান্ত ভাবে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন চে। স্কুলবাড়িটি ছিল পরিত্যক্ত প্রায় অবস্থায়।

ওই অবস্থায় চে স্কুলবাড়ির অবস্থা দেখিয়ে জুলিয়া কে বলেন গভর্মেন্ট অফিসারেরা মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িতে ঘুরে বেড়ান, আর স্কুলবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায়। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন জুলিয়ার দিকে বলিভিয়ার ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

উত্তর দিতে পারেননি জুলিয়া।

ওই দিনই বলিভিয়ার সরকার তাঁকে হত্যার আদেশ দেয়। যে সেনা দলের হাতে শেষ কয়েক ঘন্টা ছিলেন চে। তার কম্যান্ডার ছিল কিউবান। তবে CIA এর এজেন্ট। কারণ আমেরিকা চাইছিল চে কে পানামা নিয়ে যেতে।আর বলিভিয়ার সরকার চাইছিল সেখানেই হত্যা করতে। তাই রচনা করেছিল এক গল্পের। তারা গোটা দুনিয়ার সামনে জানাতে চেয়েছিল যুদ্ধের মধ্যেই প্রান গেছে চে-র। হত্যার কিছু আগেও CIA এর এজেন্ট ফেলিক্স রড্রিগেজের প্রশ্নের সামনেও নিরুত্তর ছিলেন চে। আহত চে-কে হত্যার আগে স্কুলবাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হয় সেনাদলের সাথে ছবি তোলার জন্য।

হত্যার কয়েক মিনিট আগেও তাঁর প্রতি প্রশ্ন ছিল তিনি তাঁর অমরত্বের কথা চিন্তা করছেন কিনা!!

সাথে সাথেই বিদ্যুতের বেগে উত্তর এসেছিল, ‘না,আমি বিপ্লবের অমরত্বের কথা চিন্তা করছি।’

সেই বিপ্লবের অমরত্বের চিন্তা নিয়েই সার্জেন্ট টেরানের গুলি’তে মৃত্যু হয় চে-র।

দুপুর ১টা ১০মিনিটে বলিভিয়া সরকার তাঁর মৃ্ত্যুসংবাদ দেয়। বিবিসি প্রচার করে গেরিলাদের সাথে বলিভিয়ার সেনাদের যুদ্ধে মৃত চে।

মৃ্ত্যুর পর হাত দুটো কব্জি থেকে কেটে নেওয়া হয়েছিল। যাতে তাঁর আঙুলের ছাপ দেখিয়ে বিশ্বাস করানো যায় বিশ্বকে, তিনি মৃত।

তাঁর মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক বাদে কিউবায় লক্ষ লক্ষ জনগণের সামনে তাঁর বন্ধু। কমরেড। কিউবার বিপ্লবের ক্যাপ্টেন। কমানদান্তে ফিদেল কাস্ত্রো বলে উঠেছিলেন, ‘যারা ভাবছে গ্যেভারার মৃ্ত্যু তাঁর মতাদর্শের পরাজয়। তারা ভুল ভাবছে। চে এবং তাঁর মতাদর্শ অমর।’

মতাদর্শের মৃ্ত্যু নেই

নয়া উদারবাদী বিশ্ব চে-কে এক ভয়ঙ্কর উন্নাসিক, নেশাতুর, ক্যাসানোভা কিংবা হঠকারী হিসেবে তুলে ধরতে চায়।

নয়া উদারবাদ হেরে যায় তখনই, যখন গোটা লাতিন আমেরিকার নব্বই শতাংশ দেশেই চে-র মতাদর্শের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যখন আফ্রিকার কোনো এক স্কুলবাড়িতে মাদিবার পাশে জায়গা করে নেন চে। যখন ভিয়েতনামে স্কুলের সিলেবাসে জায়গা করে নেন চে। যখন এই উপমহাদেশের ছাত্র-যুব আন্দোলন ভগৎ সিং এর মতন চে-র সংগ্রামী জীবন দেখেই স্বপ্ন দেখে সমাজ পরিবর্তনের।

বিপ্লবের সাথে কোনো আপোষ নয়। বিপ্লবে রক্তক্ষয় হবেই। তাই আপোষহীন সংগ্রামই হোক চে-র জন্মদিনে আমাদের শপথ।

সূত্র:

১। https://youtu.be/oySd38eLOSo

২। ‘Che Guevara: A Revolutionary Life’ Jon Lee Anderson


শেয়ার করুন

উত্তর দিন