Site icon CPI(M)

Change in Forest Acts for corporate Profiteering – Tapan Mishra





৩০ জুলাই ২০২৩ (রবিবার)

২০২৩ এর ২৬-এ জুলাই ভারতের অরণ্য সংরক্ষণের ইতিহাসে এক কালো দিন হয়ে চিহ্নিত থাকবে। স্বাধীনতার পরথেকে একটু একটু করে গড়ে ওঠা অরণ্য রক্ষার বিভিন্ন প্রয়াসের গোড়ায় সেদিন আঘাত করলো বিজেপি সরকার। দেশজুড়ে অরণ্য সংরক্ষণ আইন (Forest (Conservation) Act-1980) সংশোধনীর বিরুদ্ধে যে প্রস্তাবগুলি জয়েন্ট পার্লিয়ামেন্টারি কমিটি (JPC) তৈরি করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তার আগে বিলটি এই সংক্রান্ত পার্লিয়ামেন্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো দরকার মনে করেনি। এটাই স্বাভাবিক যে ৩১ জন সাংসদের জেপিসি তে শাসক দলের প্রতিনিধিদের আধিক্য ছিল। সারা দেশ থেকে শতাধিক সংশোধনী জমা পড়া যার মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজ্যসরকারের মতামত ও যুক্ত ছিল। মণিপুরের হিংসা নিয়ে লোকসভায় যখন বিতর্ক চলছে এমন এক সময়ে এই সমস্ত সংশোধনীগুলিকে উপেক্ষা করে ধ্বনি ভোটে বিলের উপর সামান্যতম আলোচনার সুযোগ না দিয়ে অরণ্য সংরক্ষণ বিলের এবং জৈববৈচিত্র বিলের সংশোধনী পাস করিয়ে নেওয়া হয়।  

প্রেক্ষাপট     

  ১৯৭২ সালের স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলনের সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক চাপ, অরণ্য থেকে খনিজ সম্পদ এবং কাষ্ঠ সম্পদ সংগ্রহের মরিয়া প্রয়াসের জন্য ক্রমাগত অরণ্য উচ্ছেদ রোধ করতে ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন সংসদে গ্রহণ করতে হয়। অরণ্য সংরক্ষণের এই আইনের পেছনে অরণ্যবাসীদের নিরন্তর আন্দোলনও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সারাদেশে সরকারি সহায়তা ব্যতিরেকে যৌথ বন পরিচালনের আন্দোলন আরাবাড়ি ছাড়িয়ে সরকারি সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।  

সরকারী হিসাব বলছে ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে, আমাদের দেশ ৪৩ লক্ষ হেক্টর (৪৩০০০ বর্গ কিলোমিটার) বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এর অর্ধেক পরিমাণ ধ্বংস হয়েছে শিল্প, খনি, জলবিদ্যুৎ, পুনর্বাসন ও কৃষির মতো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এবং বাকি অর্ধেক ক্ষয়ের কারণ অরণ্যে বেআইনি দখল। ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন এই ধরণের ব্যাপক অরণ্য ধ্বংসের পরিমাণে অভূতপূর্ব হ্রাস ঘটাতে সক্ষম হয়। বন উজাড় রোধ করার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালের আগে অরণ্য ধ্বংসের বার্ষিক হার ছিল  ১,৪৩,০০০ হেক্টর। আইন প্রবর্তনের পর এই হার কমে দাঁড়ায় বার্ষিক ৪০,০০০। কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ফরেস্ট আডভাইজরি কমিটি (FAC)-র অনুমোদন ব্যতিরেকে অরণ্য ভূমিকে অন্য কোন ভাবে ব্যবহারের উপর নেষেধাজ্ঞা  জারি হয়।

পাঠকদের সুবিধার জন্য বলা দরকার যে অরণ্যের বাইরে বৃক্ষাচ্ছাদন বাদ দিলে বর্তমান দেশের বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ শতাংশ (ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া -২০২১)। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন (FAO) এবং ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউট (WRI) যে স্যাটেলাইট সমীক্ষা করে, সেই সমিক্ষা অনুযায়ী আমাদের সরকারি হিসাবে দেখানও অরণ্যের পরিমাণ যে অনেক বেশি করে দেখনো হয় তার ইঙ্গিত রয়েছে। তা সত্বেও অরণ্য সৃজনের মধ্যদিয়ে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশে ‘নেট জিরো’ নির্গমন (বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কার্বনের নির্গমন ঘটবে তা শোষণ করবে অরণ্য ভূমি ) এক অলিক লক্ষ্যমাত্রা সরকার ঘোষণা করেছে।

এই সংশোধনীতে যে সর্বনাশের ইঙ্গিত আছে    

এই সংশোধনীর আসল উদ্দেশ্য হল দেশের বেশ কয়েকটি বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের বাইরে রাখা। এই বনাঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে –  

১। দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা (Line of Actual Control) থেকে দেশের ভিতর ১০০ কিলোমিটার অরণ্য ভূমি এই সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এই বনাঞ্চল বাস্তুতন্ত্র এবং জৈববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন সরকার যখন চাইবে তখনই বিভিন্নভাবে তা ব্যবহার করতে পারবে। এই ছাড়ের আওতায় পড়বে সম্পূর্ণ উত্তরপূর্ব ভারত, হিমালয়ের বিভিন্ন অংশের বনাঞ্চল এবং সুন্দরবন। উত্তরপুর্ব ভারত এবং হিমালয়ের বনাঞ্চল বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র হটস্পট। সারা পৃথিবীতে ৩৬টি জৈববৈচিত্রের হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে চারটি জীববৈচিত্র্যের হটস্পট রয়েছে। এই হটস্পটগুলি চিহ্নিত হয়েছে সেগুলির উচ্চ প্রজাতি বৈচিত্র, এন্ডেমিক প্রজাতির সংখ্যা এবং এগুলির ক্ষয় হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম বাদাবন। অর্থাৎ এই তিনটি অঞ্চলের বনাঞ্চল পরিবেশ রক্ষার দিক দিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল।

যে সমস্ত রাজ্যের সম্পূর্ণ বনাঞ্চল ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে আসবে সেগুলি হল ত্রিপুরা, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম, মেঘালয়, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং জম্মু ও কাশ্মীর। তা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সহ আরও কয়েকটি রাজ্যের আংশিক বনাঞ্চল ও এর মধ্যে থাকবে। চিন, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার এবং বাংলাদেশের সীমানার অজুহাতে অরণ্য সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা এই নতুন সংশোধনীতে রয়েছে। জাতিয় নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে এই ছাড় যেকোনো নির্মান কাজ কে উৎসাহিত করবে। ভাবটা এমন যে গত ৭৫ বছরে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবেননি। 
            ২। একইভাবে নিরাপত্তার নামে দেশের যেকোনো প্রান্তে ৫ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমি অধিগ্রহণ করে অরণ্য ধ্বংস করার ক্ষমতা সরকার এই সংশোধনীতে যুক্ত করেছে। এখানে বলা আছে যে বাম-চরমপন্থি দের সায়েস্তা করতে এই ব্যবস্থা সরকার যেকোনো সময়ে নিতে পারে। বাম-চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে দেশের যেকোন অংশের বনাঞ্চল যেমন পশ্চিম ঘাটের বর্ষা-বন বা মধ্য ভারতের শুষ্ক পর্ণমোচী বন সরকার ধ্বংস করে ফেলতে পারে।    

৩। এই সংশোধনী বিলের দ্বিচারিতা হল, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার জন্য অরণ্য-ভিত্তিক কার্বন সিঙ্ক (অরণ্যে কার্বন ভাণ্ডার) তৈরি করার কথাও বলা হয়েছে। এই কারণে ক্ষতিপূরণমূলক বনায়ন (compensatory afforestation)-এর ব্যবস্থা কথাও বলা হয়েছে। দ্বিচারিতা হল কখনোই প্রাকৃতিক অরণ্যের কার্বন শোষণের ক্ষমতা বৃক্ষ রোপণের মধ্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায়না। প্রাকৃতিক অরণ্যের অনেক ধরণের বাস্তুতান্ত্রিক উপযোগিতা রয়েছে। এগুলিকে অস্বীকার করে কেবল কার্বন শোষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া নির্বোধের কর্ম।

সরকারের দ্বিচারিতা      

২০১৫ সালে আমাদের দেশ আইএনডিসি (Intended Nationally Determined Commitment)-এর মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা হল ২০৩০ সালের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণ ও বনসৃজনের মাধ্যমে ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড  সমতুল্য একটি অতিরিক্ত কার্বন সিঙ্ক তৈরি করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বাস্তব হল অরন্য সংরক্ষণ আইন সংশোধন, বক্সওয়াহা, নিকবোর দ্বীপ ইত্যাদির মত সংবেদনশীল অরণ্যে যথেচ্ছ অরণ্য নিধন, উত্তর-পূর্ব ভারতের বেসরকারি বনাঞ্চলে পাম গাছ লাগানো ইত্যাদি হঠকারী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অরণ্যে জমে থাকা কার্বন সহ অন্যান্য বাস্তুতান্ত্রিক এবং জৈববৈচিত্রের উপযোগিতা গুলিকে নিঃশেষ করা হচ্ছে।      

            এই সংশোধনের মধ্য দিয়ে যে সমস্ত অরণ্য সংরক্ষণের আওতার বাইরে চলে যাবে সেগুলিতে অরণ্য অধিকার আইন (২০০৬) এর হাল কি হবে সে বিষয়ে সরকার নীরব। ভারত সরকারের পরিবেশ ও অরণ্য মন্ত্রণালয় (MoEFCC) বলছে যে সংশোধনীটি পেশ করার আগে আদিবাসী মন্ত্রণালয় (MoTA)-এর কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু যদি অরণ্যই না থাকে তবে আদিবাসি-বনবাসিদের অরণ্য অধিকার খর্ব হতে বাধ্য। পিছনের দর্জা দিয়ে বনবাসীদের অধিকার হননের সমস্ত উপায় গ্রহণ করেছে সরকার।  বিশ্বব্যাপী টেকসই অরণ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা যায় যে অরণ্যবাসীদের উদ্যোগে বা সহায়তায় যে অরণ্য পরিচালিত হয় সেই ব্যবস্থা সরকারি ব্যবস্থাপনা থেকে অনেকটাই উন্নত ম্যানের। 

         অত্যন্ত ধুর্ততার সঙ্গে এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে অরণ্যের সংজ্ঞা পরিবর্তন করলো সরকার। ১৯৯৬ সালে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট, টিএন গোদাবর্মন বনাম ভারত সরকার মামলায় অরণ্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করে। তার পূর্বে বা পরে সরকারি ভাবে অরণ্যের কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। সুপ্রিম কোর্ট বলে যে সরকারি অরণ্য ভূমির বাইরে যে সমস্ত অঞ্চলে বেসরকারি মালিকানায় অরণ্য রয়েছে সেগুলিকেও অরণ্য পরিচালন এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু এবারের সংশোধনী অনুযায়ী কেবল সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী যে বনভূমি আছে তাকেই অরণ্য হিসাবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব ভারত সহ বেশ কিছু রাজ্যে যে বেসরকারি অরণ্য রয়েছে সেগুলি আর অরণ্য হিসাবে পরিগনিত হবেনা।  

       ২০১৮ সালের পর কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে বার বার পরিবেশ ও অরণ্য রক্ষা সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন করা হয়। দেশের অরণ্য সম্পদকে আন্তর্জাতিক কার্বন বাণিজ্যের সুবিধার জন্য স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্টের যে চাহিদা দেখা দেয় সে কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রয়াস। ২০২০ সালে পরিবেশ অভিঘাত সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করে post-facto অনুমোদন (উদাহরণঃ আগে অরণ্য সাফ করে খনি তৈরি কর পরে পরিবেশ ও অরণ্য সংক্রান্ত অনুমোদন নিলে চলবে) ইত্যাদির মত অনেক ছাড় কর্পরেটদের দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।  সরকার এর লক্ষ্য হল সংরক্ষণের আওতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বেসরকারী উদ্যোগে (PPP model) বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে রাস্তা, রেল এবং পাইপলাইন পাতা, বিভিন্ন নির্মান কাজের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া। ইতিমধ্যে পূর্বতন অরণ্য আইন (Forest Act-1927) এবং বন নীতি (Forest Policy-1988) সংশোধন করে অরণ্যে পিপিপি মডেল এর ব্যবস্থা সরকার করে ফেলেছে।  কেবল অরণ্য সংরক্ষণ আইনের সংশোধন নয়, পর পর আইন পরিবর্তন করে দেশের সর্বনাশ করছে সরকার। এই সমস্ত পরিবর্তন কেবল দেশের পরিবেশ নয়, অরণ্য পরিচালনের ক্ষেত্রে  রাজ্যের অধিকার, আদিবাসী এবং অন্যান্য বনবাসীদের জীবন ও জীবিকার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একারণে এর প্রতিবাদ জরুরী হয়ে পড়েছে।

শেয়ার করুন