ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি ২০২৫ সালের ১৭-১৯ জানুয়ারি কলকাতায় বৈঠক করে নিম্নলিখিত বিবৃতি জারি করেছে:
গাজায় যুদ্ধবিরতি
কেন্দ্রীয় কমিটি ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে, যা ১৯ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হচ্ছে। পনেরো মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজায় ইসরায়েল গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালাচ্ছিল, যার ফলে ৪৬,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত এবং ১,২০,০০০ এরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে।
এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল, প্রথম পর্বের যুদ্ধবিরতি ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হওয়ার পর এটি বাড়িয়ে শান্তি এবং রাজনৈতিক সমাধান প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর রাখা। ভারত সরকারকে কূটনৈতিকভাবে কাজ করতে হবে যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একটি স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
একযোগে নির্বাচন সংক্রান্ত বিলসমূহ
কেন্দ্রীয় কমিটি মোদি সরকারের দুটি বিলের বিষয়টি লক্ষ্য করেছে, যা লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির একযোগে নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। প্রথমটি হল সংবিধান (১২৯তম সংশোধনী) বিল, যা সংবিধানের তিনটি বিদ্যমান ধারা সংশোধন এবং একটি নতুন ধারা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। এই সংশোধনগুলির মধ্যে একটি হল যে, যদি লোকসভা তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ভেঙে দেওয়া হয় বা ভেঙে যায়, তবে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন শুধুমাত্র অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য হবে। একই সংশোধনী রাজ্য বিধানসভাগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই পদক্ষেপটি সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে। এটি রাজ্য বিধানসভার মেয়াদ সংকোচন করবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত নামিয়ে আনবে এবং নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভার আইনপ্রণেতাদের অধিকারগুলির উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই দুটি বিল আরও গভীর পর্যালোচনা এবং বিচার বিবেচনার জন্য একটি যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।
সিপিআই(এম) ইতোমধ্যেই 'এক দেশ, এক নির্বাচন' ব্যবস্থার বিপক্ষে আন্দোলন করছে। যারা গণতন্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মূল্যবান মনে করেন তাদের উচিৎ সংবিধান সংশোধনী বিলটির বিরোধিতা করা ।
মসজিদ-মন্দির বিতর্ক
১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন (Places of Worship Act) লঙ্ঘন করে বিভিন্ন মসজিদের চরিত্র নিয়ে স্থানীয় আদালতে আবেদন দায়ের করা হয়েছে যে সেগুলির নিচে মন্দির থাকতে পারে এবং জরিপ তথা খননের আবেদন করা হয়েছে। এটি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের সাম্বলে ঘটেছে, যেখানে আদালত আবেদন দায়ের হওয়ার দিনেই জরিপের নির্দেশ দিয়েছিল। এর পরবর্তী ঘটনাক্রমে প্রতিবাদ করা হয় এবং যা পাঁচজন মুসলিম যুবকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, দেখিয়েছে যে রাজ্য সরকার এবং জেলা প্রশাসন কীভাবে হিন্দুত্ববাদী শক্তির এজেন্ডা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পরবর্তীকালে, আজমেরে, একটি স্থানীয় আদালত আজমের শরীফ দরগা সম্পর্কে জরিপের জন্য একটি আবেদন গ্রহণ করেছে।
সুপ্রীম কোর্ট ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন (বিশেষ বিধান) কে চ্যালঞ্জ জানিয়ে করা কিছু হিন্দু সংগঠনের আবেদনের শুনানি চলাকালীন নিম্ন আদালতে চলতে থাকা এই সংক্রান্ত সমস্ত মামলা ও জরিপের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে।
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সুপ্রিম কোর্টের কাছে উপাসনাস্থল আইনের বৈধতা বহাল রাখার এবং ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে বিরোধ উত্থাপনের যে কোনও প্রচেষ্টায় কোনও শিথিলতা ছাড়াই এই আইন প্রয়োগ করার নির্দেশ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইউজিসি খসড়া বিধিমালা
কেন্দ্রীয় কমিটি ২০২৫ সালের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) খসড়া বিধিমালার তীব্র বিরোধিতা করেছে, যা রাজ্য পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নির্বাচনের বিষয়ে রাজ্যের অধিকারগুলির উপর সরাসরি আক্রমণ। এই নির্দেশিকাটি রাজ্যপাল-তথা-আচার্যকে একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচক কমিটি গঠনের ক্ষমতা দেয়, যেখানে আচার্য মনোনীত ব্যক্তি কমিটির সভাপতির পদে থাকবেন। রাজ্য সরকার নির্বাচক কমিটিতে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন তা নিয়ে কোনও মতামত দিতে পারবে না। এক ধাক্কায়, এই নির্দেশিকাগুলির মাধ্যমে কেন্দ্র তার পছন্দমতো উপাচার্যদের রাজ্য পরিচালিত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপাল-তথা-আচার্যদের মাধ্যমে নিয়োগ করতে পারবে। এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি কীভাবে রাজ্যপালরা মনমতোভাবে তাদের আচার্য পদ ব্যবহার করে সমস্ত নিয়ম উপেক্ষা করে বিজেপি-আরএসএস শিবিরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকা উপাচার্যদের চাপিয়ে দিচ্ছেন। এটি একটি বিপজ্জনক বিধান, যার বিরোধিতা করা উচিত। যদি খসড়াটি চূড়ান্ত আকারে অনুমোদিত হয়, তবে সংশ্লিষ্ট অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলোর জন্য এই বিধিমালাগুলি সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠবে।
খসড়া জাতীয় কৃষি বিপণন নীতি
এই নীতি তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইনের কিছু দিক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা, যা কৃষক আন্দোলনের কারণে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। খসড়াটি প্রস্তাব করছে বেসরকারি পাইকারি বাজার স্থাপনের, কর্পোরেট প্রক্রিয়াকরণকারী এবং রপ্তানিকারক দ্বারা সরাসরি কৃষি জমি থেকে পণ্য কেনার, ঐতিহ্যবাহী বাজারের জমি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে পরিবর্তন, কর্পোরেট গুদাম এবং সাইলো স্থাপন এবং একটি সমন্বিত রাজ্যব্যাপী বাজার ফি ও ট্রেডিং লাইসেন্স ব্যবস্থা চালু করার। খসড়াটি প্রস্তাব করছে যে এপিএমসি বাজারগুলিকে পাশ কাটিয়ে, বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি কৃষক সভা এবং সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার দ্বারা খসড়া নীতির বিরুদ্ধে শুরু করা আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। এটি তার সমস্ত পার্টি ইউনিটকে এই নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সাংগঠনিকভাবে একত্রিত করতে আহ্বান জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন আইন
নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে নির্বাচনী বিধিতে পরিবর্তন ঘোষণা করেছে, যা রাজনৈতিক দল, প্রার্থী এবং সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের বৈদ্যুতিন রেকর্ড, ভিডিও এবং অন্যান্য ডিজিটাল তথ্যের পর্যালোচনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। নির্বাচন কমিশনের এই পশ্চাদপসরণী পদক্ষেপ নির্বাচন প্রক্রিয়ার ন্যায্যতার উপর আরও একটি আক্রমণ।
কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন কমিশনকে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সভা আহ্বান করতে এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি
কেন্দ্রীয় কমিটি ২৪তম পার্টি কংগ্রেসের জন্য 'খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব' নিয়ে আলোচনা করেছে, যা ২০২৫ সালের ২-৬ এপ্রিল মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত হবে। কেন্দ্রীয় কমিটি খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। এটি ২০২৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পার্টির সকল স্তরে আলোচনা করার জন্য প্রকাশিত হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি ২২-২৩ মার্চ সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্টি কংগ্রেসের জন্য 'খসড়া সাংগঠনিক রিপোর্ট' চূড়ান্ত করার জন্য।