ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী) এর কেন্দ্রীয় কমিটি ২৭-২৯ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে নয়াদিল্লিতে বৈঠক করে নিম্নলিখিত বিবৃতি জারি করেছে:
ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
আইএমএফের মতে, বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলির মধ্যে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে দ্রুত। যখন মোদি সরকার এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক প্রচার করছে তখন তারা এই সত্যটি গোপন করছে যে ২০২১ অর্থবর্ষে ৯.১ শতাংশ বৃদ্ধি আসলে ২০২০-এর -৫.৮%-এর ভিত্তিতে করা হচ্ছে। যখন ২০১৯ কে ভিত্তি করা হয় যা একটি স্বাভাবিক প্রাক কোভিড অর্থবর্ষ তাহলে এই বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় বাস্তবে ৩.৮%। ২০২২ এবং ২০২৩ অর্থবর্ষে ভারত তার অর্থনীতিতে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে যেখানে আমেরিকা ১৩৯০ বিলিয়ন ডলার এবং চীন ১২৭৪ বিলিয়ন ডলার তাদের অর্থনীতিতে যোগ করেছে।সমস্ত বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতেই মাথাপিছু আয় সবচেয়ে কম। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩১ গুণ বেশি, চীন ৫ গুণ, ব্রাজিল ৪ গুণ, ইউনাইটেড কিংডম ১৮ গুণ, জার্মানি ২০ গুণ বেশি। ফলতঃ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম জিডিপি থাকা সত্ত্বেও আমাদের মাথাপিছু আয় অ্যাঙ্গোলা, আইভরি কোস্ট ইত্যাদি দেশের থেকেও কম।
বর্তমানে উৎপাদন ও শিল্পক্ষেত্র যদি না হ্রাস পেয়ে থাকে তাহলে স্থবির অবস্থায় রয়েছে। ৮টি মূল ক্ষেত্রের বৃদ্ধি ফেব্রুয়ারিতে ৭.২ শতাংশ থেকে মার্চ মাসে৩.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
ফলস্বরূপ, বেকারত্বের হার প্রায় ৮ শতাংশের রেকর্ড উচ্চতাতেই রয়েছে। কর্মরতদের সংখ্যাও প্রায় স্থির রয়ে গেছে - প্রাক-মহামারী সময়ে জানুয়ারি ২০২০-তে ৪১.১ কোটি এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সংখ্যাটা ৪০.৯ কোটি । গত ৮ বছরে গ্রামীণ মজুরি কার্যত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। যখন MGNREGS-এর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন বাজেটের বরাদ্দ এক-তৃতীয়াংশ কমানো হয় এবং বকেয়া মজুরিও দীর্ঘকাল ধরে দেওয়া হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে, কেন্দ্রীয় কমিটি কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজে ব্যাপক ব্যয়বরাদ্দের দাবি করেছে যা কর্মসংস্থান, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা এবং অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়াবে।
আদানি তদন্ত
আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তদন্ত করতে সরকার স্পষ্টভাবে অস্বীকার করার সাথে সাথে, SEBI তদন্তের একটি স্ট্যাটাস রিপোর্ট দাখিল করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ২ মে তারিখের সময়সীমা ছয় মাসের জন্য বাড়ানোর আবেদন করেছে।
এইসব অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্তের খাতিরে একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।
কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ
কেন্দ্রীয় কমিটি যৌন হয়রানির অভিযোগের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে ভারতের পদক বিজয়ী কুস্তিগীরদের প্রতিবাদে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। প্রাথমিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও, দিল্লি পুলিশকে রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি, বিজেপি সাংসদ ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি দাবি করেছে যে ডব্লিউএফআই সভাপতিকে এই পদ থেকে অপসারণ করতে হবে এবং পুলিশকে অবিলম্বে এফআইআরের উপর ভিত্তি করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
জম্মু ও কাশ্মীর
জম্মু ও কাশ্মীরে ২০১৮ সাল থেকে কোন নির্বাচিত বিধানসভা নেই। কেন্দ্র সরকার নির্বাচন আয়োজনের আগে তিনটি শর্ত পূরণ করতে বলেছিল – সীমানা পূনর্নিধারণ সম্পন্ন করা; ভোটার তালিকার সংশোধন এবং নির্বাচন আয়োজনের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা। সরকারের নিজের মতেই এই তিনটি শর্ত পূরণ করা হয়েছে। তারপরও নির্বাচন করতে অরাজি হওয়া স্পষ্টভাবে দেখায় যে ক্ষমতাসীনরা তাদের পছন্দের সরকার গঠনের ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। এটা জনগণের মৌলিক সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
কেন্দ্রীয় কমিটি অবিলম্বে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায়।
বন সংরক্ষণ আইন সংশোধন
সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রবর্তিত এই সংশোধনীটি ভয়ঙ্কর, এটা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলা করা আরো কঠিন করে তুলবে এবং এর প্রভাব ইতিমধ্যে দেশে অনুভূত হচ্ছে। এই সংশোধনীগুলি গ্রামসভার সাংবিধানিক এবং আইনগত অধিকারগুলিকে, তাদের এলাকায় কোন প্রকল্পের জন্য সম্মতি প্রদান বা আটকানোর অধিকারকে খর্ব করে; বনভূমির পরিবর্তনের জন্য নিয়ম লঘু করে; বনের বেসরকারীকরণকে ত্বরান্বিত করা এবং বনের উপর রাজ্য সরকারের অধিকারগুলিকে হ্রাস করার পাশাপাশি কেন্দ্র সরকারকে আরও ক্ষমতা দেয়। এটি আদিবাসী এবং ঐতিহ্যবাহী বনবাসীদের অধিকারের উপর আরও একটি আক্রমণ এবং বিদ্যমান বন অধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।
এই সংশোধনী প্রত্যাহার করতে হবে।
ত্রিপুরা
কেন্দ্রীয় কমিটি ক্ষমতাসীন বিজেপির দ্বারা অব্যাহত বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী হিংসার তীব্র নিন্দা করছে।শারীরিক হামলা ছাড়াও ব্যাপক তোলাবাজি হচ্ছে এবং দাবি করা টাকা না দিলে তাদের সম্পত্তি, দোকানপাট, জীবিকার উপায় যেমন অটোরিকশা ইত্যাদি ধ্বংস করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নষ্ট হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি অবিলম্বে এই হিংসা বন্ধ এবং সংবিধানের শাসন কঠোরভাবে মেনে চলার দাবি জানিয়েছে; দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি করছে।
বিরোধীদের অবস্থান
কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্ব্যক্ত করেছে যে দেশ ও জনগণের সামনে প্রধান কাজ হল বিজেপিকে বিচ্ছিন্ন করা এবং পরাজিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, সিপিআই(এম) ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সাথে সহযোগিতা করবে এবং একসাথে কাজ করবে৷
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ করার মতো জাতীয়স্তরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে; ঘৃণা ও হিংসার বিষাক্ত প্রচার; আদানি কেলেঙ্কারি; কেন্দ্রীয় সংস্থার অপব্যবহার; একটি জাতিভিত্তিক আদমশুমারি পরিচালনা; যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আক্রমণ;এ ধরনের বিষয়গুলিকে সামনে রেখে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলোর সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। জনগণের জীবন-জীবিকার ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিটা রাজ্যের নিজস্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদের ঐক্য গড়ে তুলে লড়াই আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে এবং একই সাথে বিজেপি বিরোধী ভোটকে পরিকল্পনামাফিক একত্রিত করতে হবে।যেহেতু পরিস্থিতিগুলি রাজ্যভিত্তিতে আলাদা তাই এই ব্যবস্থাগুলি অবশ্যই রাজ্য নির্দিষ্ট হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বান
কেন্দ্রীয় কমিটি দেশ ও জনগণের জীবিকার তাৎক্ষণিক উদ্বেগের বিষয়গুলিতে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য বাম দলগুলির সাথে পরামর্শ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সাথে আলোচনার ভিত্তিতে প্রকাশ্য কর্মসূচীর মাধ্যমে জাতীয়স্তরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি উত্থাপন করা হবে।
সংগঠন
ক্ষেতমজুর আন্দোলনের নেতা বিক্রম সিংকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে শূন্যপদ পূরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।