Site icon CPI(M)

“…but people never forgive themselves and so they would always be dangerous.”:The Pegasus Comes Alive!

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

প্রথম পর্ব

ভারতের সংসদে হইচই!

কি ব্যাপার!

দেশের সরকার – মোদী সরকার নাকি আড়ি পাতে!

শেষ দু তিন মাস ধরে সত্যি লকডাউন নাকি লকডাউন নয় সবটা বুঝে কিংবা আদৌ কিছুই না বুঝেও ঝাঁপ বন্ধ রেখেছিল এমন একটা চায়ের দোকানে সকালের খবর কাগজে প্রথম পাতায় খবর! ইতস্তত লোকজন কিছুটা ট্যারা চোখে সেইদিকে তাকাচ্ছে আর চায়ের কাপ কিংবা ভাঁড়ে চুমুক চলছে – মোদী সরকার নাকি লোকজনের ফোনে আড়ি পাতে!

এমনিতেই বেলা হলে পাড়ার অনেকের জন্য ভ্যাকসিনের লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কোমরে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে গোবিন্দর, লকডাউনে গোবিন্দর কাজ নেই, মানে চলে গেছে – আজকাল লাইন দেওয়ার কমিউনিটি সার্ভিস দিয়ে রোজগারের সুযোগ খুঁজছে। ইউটিউবে গোবিন্দ দেখেছে কোভিড পরিস্থিতিতে এভাবেও আয়ের সুযোগ রয়েছে বলে বাজার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন। এই গোবিন্দের হাতে রয়েছ চলে যাওয়া কাজের জায়গা থেকে দেওয়া মোবাইল ফোন। সেটার দিকে দেখে ওর মনে প্রশ্ন “আমার ফোনেও কি তাহলে. . .?”

না… গোবিন্দদের ফোন ট্যাপ হচ্ছে না… অন্তত এখনো হচ্ছে না। কাদের ফোনে হচ্ছে জানেন? রিপোর্টে প্রকাশ অন্তত ৩০০ জন বিশিষ্ট ভারতীয়ের ফোনে এমনটা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরা। ভারতের একটি রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রয়োজনে ব্যবহার হওয়া মোবাইল নম্বর এই নজরদারির আওতায় ছিল বলা খবর ফাঁস হয়েছে। অধ্যাপক থেকে শুরু করে ভারতে কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা অবধি নাকি এহেন নজরদারির শিকার! এরা প্রত্যেকে যে স্মার্টফোন ব্যবহার করেছেন বা করছেন তাতেই ইজরায়েলী সংস্থা এন এস ও নির্মিত স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ পাঠিয়ে নজরদারি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ। গোপনে নজরদারির উদ্দেশ্যে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে অন্তত চল্লিশ জন সাংবাদিকের ব্যাক্তিগত তথ্য অবধি চুরি করা চলছে বলেও খবরে প্রকাশ হয়েছে।

দু বছর আগেই হোয়াটস্যাপ সংস্থার প্রকাশিত তথ্যে স্পষ্ট হয়েছিল ভারতে নজরদারি চালানোর উদ্দেশ্যে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করা হচ্ছে। তখন মোদী সরকারকে প্রশ্ন করা হলে তারা স্পষ্ট করে জানাতে পারেনি যে ভারত সরকার এন এস ও’র সাথে চুক্তিবদ্ধ নয়, শুধু জানিয়েছিল কোনপ্রকার “বেআইনি নজরদারি” চালানো হচ্ছে না। অথচ ইজরায়েলের সংস্থা এন এস ও’র প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তার শুধুমাত্র কোন দেশের সরকার অথবা সরকারী কর্মক্ষেত্রের সাথেই চুক্তির ভিত্তিতে এই সফটওয়্যার ব্যবহার করার সুযোগ দেয়।

আমাদের দেশের আইনে কারোর স্মার্টফোন হ্যাক করে অথবা স্পাই-সফটওয়্যার দ্বারা কারোর ব্যক্তিগত তথ্য জেনে নেওয়া নিষিদ্ধ, এমনকি ভারত সরকার চাইলেও সেই কাজ করা যায় না। কেন্দ্রীয় সরকার কোন আইনের বলে এহেন নজরদারি চালাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংক্রান্ত আইনকে কার্যকরী করতে গিয়ে সত্যের অপলাপ ঘটাচ্ছে একথা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

এই অভিযোগের ভিত্তিতেই সংসদের বাদল অধিবেশন জূড়ে হইচই’এর পূর্বাভাষ।

স্মার্টফোন হাতে থাকলেই আমরা স্মার্ট হয়ে যাই এমনটা না ভাবাই ভাল, ওসব পণ্য বিকিকিনির স্লোগানে লেখা হয়ে ঠিকই কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যায় আসলে সবার হাতে স্মার্টফোন তুলে দেবার পিছনে রাজনীতির যোগটা কতদূর। একদিকে একটা গোটা প্রজন্মকে ইন্টারনেট প্রজন্ম বলে দাগিয়ে দিয়ে বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে দেওয়া চলে, স্মার্টফোন এবং উপযুক্ত ইন্টারনেট কানেকশন খরিদ করার সুযোগ না থাকলে মেধাবী হওয়া সত্বেও আজকের ভারতে শিক্ষার্থী হবার সুযোগ কেড়ে নেওয়া চলে, আধার নম্বরের সাথে সংযোগ না হওয়া মোবাইল নম্বর বাতিল করে আসলে বাধ্য করা হয় পুরানো টেলিযোগাযোগ বন্দোবস্তকে বাতিল ঘোষণা করে সবাইকে এক সুতোয় নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে। পুঁজিবাদ বলুন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলুন বা সাম্রাজ্যবাদ বলুন এরা চিরকাল সব মানুষকে এক গোয়ালের গরুই বানাতে চেয়েছে – বিভিন্নতা, বিসদৃশতা এবং বৈচিত্র্য মানব সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট হলেও এগুলি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্যতম অন্তরায়। তাই সবাইকে এক হিসাবে দেখানোর বেনিয়াবৃত্তিকেই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত উন্নতিসাধনের একমাত্র পরিচয় বলে প্রচার করা হয় – “ মেরা আধার, মেরি পহেচান” ভুলে গেলে চলে না। যদিও আমরা অনেকেই ভুলে যাই এই ব্যবস্থায় বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বেশিরভাগ গবেষণা অবধি সেইদিকেই হয় যেদিকে মুনাফার গন্ধে মাছির মো মো বেশি! আর সেই বিশাল মুনাফা লুটের ভরপুর সুযোগ পেতে পুঁজিবাদকে খুশি করতে হয় রাষ্ট্রকে বা বলা ভালো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে – পারমানবিক শক্তির ব্যবহারে বোমা বানানো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আজকের দিনে একইভাবে কাজ করছে তথ্যপ্রযুক্তির গবেষণা, এই নিবন্ধের তিনটি পর্বে আমরা বিজ্ঞান – প্রযুক্তির পুঁজি নির্ভরশীল চরিত্রের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকবো না, কিন্তু যেহেতু আলোচনার বিষয় স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ তাই স্পাইওয়্যার আসলে কি, কিভাবে কাজ করে এসব কিছুটা জেনে নেওয়া জরুরী।  

স্পাইওয়্যার কি?

ইন্টারনেটে স্পাইওয়্যার লিখে সার্চ করলে সাধারনভাবে আট ধরণের সংজ্ঞা মিলবে। ইন্টারনেট প্রযুক্তি সম্পর্কিত পরিচিত কিংবা এই সংক্রান্ত খোঁজখবর রাখেন এমন কেউ যদি সেইসব পড়েন তবে দেখবেন স্পাইওয়্যারকে মূলত অ্যাডওয়্যার হিসাবে ব্যাখ্যা করার ঝোঁক রয়েছে। অ্যাডওয়্যার হল সেই সফটওয়্যার যা কম্পিউটার অথবা স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন যারা তাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্রাউজিং হিস্টোরি অথবা টেন্ডেন্সি অ্যানালাইজ করতে পারে। সহজ ভাষায় একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রোজকার জীবনে যেসব তথ্য ইন্টেরনেটে সার্চ করেন সেই ডেটাবেস ঘেঁটে অ্যাডওয়্যার বুঝতে চায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মনোভাব, পছন্দ – অপছন্দ ; মনে হতে পারে এইসব অ্যানালিসিস কার অথবা কাদের কাজে লাগবে, কি কাজে লাগবে !

মুনাফা চালিত বাজার এবং অভাবনীয় তথ্যপ্রযুক্তির আন্তঃসম্পর্ক লুকিয়ে রয়েছে ঠিক এই প্রশ্নেই।

আসলে সবটাই করা হয় পোটেন্সিয়াল কাস্টমার অথবা উপযুক্ত ক্রয়ক্ষমতা আছে এমন খরিদ্দার খুঁজে পেতে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ব্রাউজিং হিস্টোরি জেনে আসলে বুঝতে চাওয়া হয় ব্যক্তিটির মনোভাব – অর্থনীতির ভাষায় চাহিদা। চাহিদা সম্পর্কিত পর্যালোচনা (অ্যানালিসিস) অনুযায়ী নির্দিষ্ট ব্যাক্তির ডিভাইসে উপযুক্ত পণ্যের লোভনীয় বিজ্ঞাপন পাঠানো হয়। বাজার খুঁড়ে ক্রেতা খোঁজার কাজটি সফলভাবে একটি সফটওয়্যার দ্বারা করা গেলে সেই প্রযুক্তিকে অ্যাডওয়্যার বলা চলে। এ তো গেল নিরামিষ বাজার সভ্যতার ততোধিক নিরামিষ চাহিদা – যোগানের চলতি ভারসাম্যটি নষ্ট করা এবং পুনরায় নতুন ভারসাম্য সূচক প্রতিষ্ঠা করতে ঠাকুমার ঝুলির গল্প। ব্যাপারটার গভীরতা এটুকুই হলে কিছুটা সমাজসচেতন যারা অথবা মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে যারা মাথা ঘামান তাদের চিন্তা থাকতো না। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার রয়েছে, কারন স্পাইওয়্যার শুধুই বিজ্ঞাপনের বিষয় না। স্পাইওয়্যার শুধুই একটি অ্যাডওয়্যার না।

স্পাইওয়্যার সম্পর্কে তিনটি তথ্য প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক –

১) Spyware is software that enables a user to obtain covert information about another’s computer activities by transmitting data covertly from their hard drive.

২) Spywares are Internet Programs that surreptitiously monitor and report the actions of a computer user.

৩) Spywares are any malicious software that is designed to take partial or full control of a computer’s operation without the knowledge of its user.

উপরের তিনটি পয়েন্ট পড়ার সাথেই পাঠকেরা মাথায় রাখুন শেষ কয়েক বছরে কতবার সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হতে দেখেছেন অবৈধ তথ্য, নিষিদ্ধ ইমেইল আদানপ্রদান করার অপরাধ সংক্রান্ত কতগুলি ঘটনা মনে পড়ছে! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের বক্তব্য ছিল এরকম কোন ইমেইল তারা কাউকে পাঠান নি কিংবা তথ্য আদানপ্রদান করেন নি, অথচ সেই অভিযোগেই এদের প্রত্যেকের নামে দেশদ্রোহিতার মামলা রুজু হয়েছে – ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২১ (এ) ধারার প্রয়োগে জেল খাটতে হয়েছে। বিনা বিচারে সদ্য প্রয়াত ফাদার স্ট্যান স্বামীকে যে যে অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল এহেন ইমেইল পাঠানোর অভিযোগ যা তিনি আদালতে অস্বীকার করেছিলেন এবং বলেছিলেন এইসব ইমেইল হ্যাক করে তার কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞেরা প্রমাণ করে দিয়েছেন ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আরেক অভিযুক্ত রণা উইলসনের কম্পিউটার হ্যাক করে বিভিন্ন জাল প্রমানাদী ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকার একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরি রনা উইলসনের কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার ব্যবহার এবং হ্যাক করার প্রমাণ পায়, এই ম্যালওয়্যার উইলসনের অজ্ঞাতসারে কাজ করেছিল। এর সাহায্যেই তার ইমেইল বক্সে ঘটনার জাল প্রমাণ হিসাবে কিছু ইমেইল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, এগুলিই সেইসব ইমেইল যার ভিত্তিতে এন আই এ উলসনকে ষড়যন্ত্রে সামিল থাকার প্রমাণ হিসাবে দাখিল করেছে। কম্পিউটার হ্যাক এবং ম্যালওয়্যারের অস্তিত্ব সম্পর্কে পরে অন্য বিশেষজ্ঞরাও একই মতামত দেন।  

এই নিবন্ধের লেখক ধরে নিচ্ছে যারা এই প্রতিবেদন পড়ছেন তাদের বুনিয়াদি ইংরেজিতে সমস্যা নেই তাই কিছু ইংরেজি শব্দের বঙ্গানুবাদ করা হচ্ছে না, একইসাথে মনে রাখতে হবে ফিন্যান্স পুঁজি নির্ভর অর্থনীতি, আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত বহু শব্দের উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ লেখক খুঁজে পায় নি, যেটুকু রয়েছে সেগুলি আধুনিক বাঙালির জিহ্বায় বাংলা বলে মনে হবে না। নিবন্ধকার চেষ্টা করবে এই লেখার প্রয়োজনে যতদূর সম্ভব সেই কাজ করে ওঠা যায়।

তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় আধুনিকতার যেরকম ভয়াবহ প্রচার ভারতে আজকের প্রজন্ম ইতিমধ্যেই দেখেছে বা দেখছে তার কারন কোন “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” নয়, বিশ্ববাংলা তো নয়ই! এর পিছনের কারন বুঝতে হলে আমাদের ফিন্যান্স পুঁজি, পুঁজিবাদী আধুনিক অর্থনীতি এবং আজকের পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের সমবেত মিথস্ক্রিয়া বুঝতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই এই নিবন্ধের সুত্রপাত। স্মার্টফোনে স্পাইওয়্যার পাঠিয়ে নাগরিকদের চলাফেরায় আড়ি পাতছে দেশের সরকার – এ আর জেমস বন্ডের আষাঢ়ে গপ্পো নয়! জর্জ অরয়েল বেঁচে থাকলে আরেকবার 1984 লিখতে বসতেন কিনা জানার সুযোগ নেই, সোশ্যালিজম আদৌ পেরেছিল কিনা কেউ জানেনা কিন্তু পুঁজিবাদ তার সেই কষ্টকল্পনাকে সত্যি প্রমান করেই ছাড়ল; এখন বলতেই হচ্ছে বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং আস!

ওয়েবডেস্কের পক্ষে: সৌভিক ঘোষ

তথ্যসুত্রঃ

১) স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ সম্পর্কে দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন

২) স্পাইওয়্যার ‘পেগাসাস’ সম্পর্কে সম্প্রতি অন্যান্য গনমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন

৩) ১২ই ফেব্রুয়ারি এবং ১৯ জুলাই তারিখে প্রকাশিত সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর বিবৃতি

ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া

শেয়ার করুন