ড. নুরুল ইসলাম
‘সাম্প্রদায়িক মানসিকতা চলে গেলে সাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারে না।’
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ সাল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় এ কথা লেখেন। আজ ২৩ শে জানুয়ারী ২০২৫, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৮ তম জন্ম বার্ষিকী। পিতা জানকীনাথ বসু ও মাতা প্রভাবতী দেবীর নবম সন্তান সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয় ১৮৯৭,২৩ জানুয়ারি উড়িষ্যার তৎকালীন রাজধানী কটক শহরে। তাঁদের পৈত্রিক আদি নিবাস ছিল পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগনা জেলার কোদালিয়া গ্রামে। মেধাবী সুভাষ চন্দ্রের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কটকের এক মিশনারী স্কুলে, পরে তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। তারপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ছাত্র অবস্থা থেকেই সুভাষচন্দ্র ছিলেন দেশপ্রেমিক, কলেজের ব্রিটিশ শিক্ষক ওটেন সাহেব একদিন ইতিহাসের ক্লাসে পাঠদান কালে ভারতীয়দের প্রতি বর্বর অসভ্য জাতীয় কটুক্তি করলে তিনি প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন এবং তিনি ওটেন সাহেবকে বাধ্য করেন তাঁর জঘন্য মন্তব্য প্রত্যাহার করতে। কিন্তু এর জন্য তাকে কলেজ থেকে সাসপেন্ড হতে হয়। পরে উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় স্কটিস চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে অনার্স সহ বিএ পাস করেন। তারপর আইসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিলেত যান এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ স্থান অধিকার করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাছাড়া তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএ ডিগ্রী লাভ করেন।
মাত্র তিন অক্ষরের নেতাজির নাম প্রত্যেক দেশপ্রেমিকের হৃদয়ে ঝড় তোলে, তুফান তোলে। ভারতীয় উপমহাদেশে তাকে ঘিরে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। জাতীয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে অনেক লেখা ও গবেষণাপত্র চলছে। তিনি সম্পূর্ণ জাতীয়তাবাদী হয়েও চিন্তা ভাবনায় সর্বোপরি দেশের মুক্তি সাধনায় পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক। তার চোখে স্বাধীনতার অর্থ সর্বপ্রকার শোষণ বঞ্চনা বন্ধন থেকে মুক্তি। কৈশোরে ভারত ভ্রমণ কালে প্রত্যক্ষভাবে অভিজ্ঞতা লাভ করেন ধর্ম বর্ণ জাত পাতের ভেদাভেদে দীর্ণ বিদির্ণ বিধ্বস্ত পরাধীন ভারতের রূপ। পরাধীনতা কেবল রাজনৈতিক দাসত্বের সৃষ্টি করে না মানসিক ভাবেও সংকীর্ণতা এনে দেয়। আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি স্থির করে ফেলেন মান সম্মান যশ অর্থ এটা তার জীবনের কাম্য নয়, বিরুদ্ধতার আঘাতে আঘাতে সংগ্রামময় জীবনই তার একমাত্র লক্ষ্য।
তরুণের স্বপ্ন,ভারতের মুক্তি সংগ্রাম,কিংবা অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভারত পথিক, ইত্যাদি বইয়ের মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে বিপ্লবী হৃদয়ের ভাব, ভাবনা ও জীবনচর্যা। এইসব লেখার মধ্যে তার সাহিত্য ইতিহাস দর্শন রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ চলার অভিমুখ প্রকাশ পেয়েছে।
বাংলার রাজনীতিতে, দুবারের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রূপে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সুপ্রিম কমান্ডার রূপে তাঁকে দেখি, জনগণমন ভারত ভাগ্য বিধাতার আদর্শ প্রতিনিধি রূপে। শিক্ষা পরিকল্পনা, নারীর মুক্তি,অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, কৃষি শিল্প ভাবনা, সাংস্কৃতিক দর্শন ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য ভারতবর্ষের চিরন্তন মর্মবাণী প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি বহুবার ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন, ১১-১২ বার জেলে গেছেন, গৃহে নজরবন্দি থাকতে হয়েছে, এমনকি নির্বাসিতও হয়েছেন। তার লেখা বহু বইপত্র, পান্ডুলিপি লিপি সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে, তবুও তিনি তার লক্ষ পথে অবিচল থাকেন। জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রূপে হরিপুরা অধিবেশনে বলেন, " আমরা শুধু ভারতের জন্য সংগ্রাম করছি না সমগ্র মানবজাতির জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভারতের স্বাধীনতার অর্থ মানবজাতির মুক্তি। "
ন্যায়,সাম্য,স্বাধীনতা শৃঙ্খলা ও প্রেম সম্পর্কে তরুণ সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩১ সালের মে মাসে মথুরায় এক ভাষণে বলেন, " মানুষের জন্য প্রেমানুভূতিতে উদ্দীপিত না হলে আমরা সকলের প্রতি ন্যায় নিষ্ঠ হতে পারবো না,সব মানুষকে সমান বলে ভাবতে পারবো না। স্বাধীনতার জন্য কষ্ট ত্যাগও করতে পারব না। আমাদের সমাজে নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। "
আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যা ছিলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন, পরে রে ক্যাপ্টেন সাইকেলের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে তিনি লক্ষ্মী সায়গল নামে পরিচিত হন ঝাঁসির রানী ব্রিগেডের অধিনায়ক। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যখন মেয়েরা প্রথম সামরিক বাহিনীতে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছেন , এখানে তার বেশ কয়েক বছর আগেই নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীতে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল মহিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন, রাইফেল তুলে নিয়ে বুকের রক্তে মাতৃভূমি মুক্তির সংগ্রামে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ সরকারের ভেতর জাত পাত ধর্ম বর্ণবিদ্বেষের সমস্ত সীমারেখা, মুছে দিয়েছিলেন তিনি আপন জীবন আদর্শের দ্বারা। বহু বিদেশি ঐতিহাসিকও তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে এই সাফল্যের ভুয়সী প্রশংসা করেন। ধর্মীয় বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে পারস্পরিক সম্বোধন হয়ে দাঁড়ায় জয় হিন্দ। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ শিখ খ্রিস্টান সবার রান্না খাওয়া হতো একই সঙ্গে, তাদের একটাই পরিচয় ছিল তারা ভারত মায়ের বীর সন্তান।
প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় যেসব ছাত্র কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতেন তাদের শিক্ষার জন্য দেশবন্ধুর পরিকল্পিত জাতীয় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। জানা যায়, শিক্ষকতা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলে প্রয়োজনের ক্লাসরুমের টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করতেন, এমনকি বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। ফরওয়ার্ড পত্রিকার অফিসেও তিনি ধর্ম ক্লান্ত অবস্থায় বহুদিন রাত কাটাতেন।
১৯২৩ এর বেঙ্গল মিউনিসিপাল আইন অনুযায়ী ১৯২৪ চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতা পুরসভার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন, নেতাজি ছিলেন নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে কাউন্সিলর পদ ছেড়ে দিয়ে অফিসার পদে যোগদান করেন। সেই সময় সেই পদের বেতন ছিল ৩ হাজার টাকা মাসিক, কিন্তু তিনি নিতেন মাত্র তার অর্ধেক। আবার সেই টাকাও তিনি বস্তি এলাকার গরিব ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করতেন। গুরু শিষ্য মিলে দক্ষিণ কলকাতা সেবক সমিতি, দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেও দাদা শরৎ চন্দ্র বসু তার নির্ধারিত দেয় অর্থ নিয়মিত দিয়ে আসতেন। কলকাতা পুরসভার মেয়র থাকাকালীন দরিদ্র জনসাধারণের জন্য নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেন ১৯৩১ সালে ২৬শে জানুয়ারি মেয়র সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে মিছিলের উপরে পুলিশের লাঠি চালোনা ও তাকে গ্রেফতার ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনা। ইউরোপের থাকাকালে তিনি ভিয়েনা পুরসভার সমাজ তান্ত্রিক কার্যপ্রণালী যে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারই রূপায়ণ ঘটাতে তিনি চান কলকাতার মেয়র রূপে, ‘পৌর সমাজতন্ত্র আসলে ঐক্যবদ্ধভাবে সমাজের জনগোষ্ঠীর সেবা প্রচেষ্টা’।
বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন দেশে রাজ্যে দেশপ্রেম জাতীয়তাবোধ ধর্মের নামে যে ধরনের জঘন্য নক্কারজনক কার্যকলাপ চলছে তাতে করে নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে দেশপ্রেম দিবস রূপে পালন করে আমরা প্রতিটি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির ভাবনা মেলবন্ধন বয়ে আনতে পারি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র ধর্মীয় ভাবনা থেকে মুক্ত ছিলেন না কিন্তু তিনি ছিলেন চৈতন্যদেব,রামকৃষ্ণ দেব বিবেকানন্দের মতই যত মত,তত পথ,অর্থাৎ সব ধর্মের বর্ণের মানুষের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও একের উৎসবে অপরের অংশগ্রহণ,সব ধর্মের মানুষকে মানুষ হিসেবে ভেবে কাছে টেনে নেবার আদর্শে বিশ্বাসী। একদল বলছেন ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট নাকি স্বাধীনতা দিবস নয়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে রাম মন্দির নির্মাণের একটি বিশেষ দিনই নাকি স্বাধীনতা দিবস। প্রতিবেশী দেশে আবার ১৯৭১ সালের মুক্তি আন্দোলনকে স্বীকৃতি না দিয়ে সেই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাতিল করার দাবি করে পুনরায় মুক্তি দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে চাইছে। এই দুইবারটাই দুই দেশের লাখো লাখো শহীদের আত্ম বলিদানকে চরম অপমান করছে। এই দুঃসাহস দুই দেশের মানুষ কখনোই বরদাস্ত করতে পারে না।দুটি দেশেরই শাসক শ্রেণী ও শাসক গোষ্ঠী নির্বিচারে সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি নির্যাতন নিপীড়ন করছে। প্রত্যেক সরকারই নিজস্ব সংকট সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় রূপে প্রতিবেশী সংখ্যালঘু মানুষের জায়গা জমি ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি দখল করার প্ররোচনা দিচ্ছে। লগ্নি পুঁজির ধর্মই হলো উৎপাদন নয় সীমাহীন মুনাফা, এই মুনাফা বৃদ্ধির জন্য তারা সর্বত্র রাষ্ট্রীয় সম্পদ জল জঙ্গল জমি ব্যাংক বিমা রেল বন্দর ইত্যাদি সবকিছুই রাষ্ট্র মালিকানা থেকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করতে চায়। তাই একদল হুমকি দিচ্ছে চার দিনের মধ্যে কলকাতা দখল করার আর অন্য দল হুমকি দিচ্ছে রাতারাতি চট্টগ্রাম বন্দর দখল করার। চট্টগ্রাম বন্দর দখল হলে মোদিজীর বদান্যতায় ফুলেঁপে ওঠা আদানি গোষ্ঠীর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান প্রায় সবকটি বন্দর দখলে চলে আসবে । পাকিস্তান আফগানিস্তানেও ধর্মীয় মৌলবাদ নিজেদের ধর্মেরই এক শ্রেণীকে অন্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে প্ররোচনা যোগাচ্ছে। উদ্দেশ্য একই মানুষের দৈনন্দিন জীবন যন্ত্রণাকে আড়াল করে দেওয়া, মানুষকে বর্ণে বর্ণে, ধর্মে ধর্মে ভাষায় ভাষায় ভাগ করে দুর্বল করে ফেলা। নেতাজির আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, বহু বর্ণের বিচিত্র সমাবেশ গণতান্ত্রিক ভারত। আজকে ভারতের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, আদিবাসী তপশিলি মানুষের সামাজিক ন্যায় অধিকার বিপন্ন বা ধ্বংসের মুখোমুখি। আজকের দিনে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নেতাজি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনা সত্যিই নতুন ভাবে আমাদের পথ খুঁজে নেবার বার্তা যোগায়।