কালিন্দীর চরে বলশেভিক, জয়দেবের লেনিনের কাছে শক্তি - চন্দন দাস

সাহিব লুধিয়ানবী ভ্লাদিমিরের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তখন সমাজতন্ত্রর সাময়িক বিপর্যয় হয়েছে। লুধিয়ানবী লিখেছিলেন,‘‘জানি না, তোমার মরদেহের কী গতি হবে/ ক্রমেই বেড়ে চলেছে সংখ্যা ইমাম-পাদরীদের…..সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে এসে আমরা জাতপাতে/ যেন ভেসে না যাই/ যে গোলামদের ভাগ্য ফিরেছিল/ তারা যেন আবার গোলাম না হয়।’’
গোলামির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে লেনিনকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন অনেক। তাঁদের সবার অনুভবের বর্ণনা দেওয়া খুবই কঠিন। তাই আপাতত বীরভূমে, কালিন্দী নদীর চরে, মাঝরাতে এক বলশেভিকের মুহূর্ত উল্লেখ করব। তবে তার আগে দু’জনের পংক্তি উল্লেখ না করে নদীর চরের বালিতে পৌঁছোন যাবে না।
প্রথমেই — নক্ষত্র খামারের কবির অনুভবই বলব।

‘‘তোমাকে বিশ্বাস ক’রে দূরদেশে ফেলে রাখা যায়?/ তাই কাছে পাবো ব’লে দাঁড়িয়েছ কেন্দ্রে ও শহরে —/একাকী, যে লক্ষ্যভ্রষ্ট তাকে দাও মনসা সংবিৎ/ ঐ শোভাযাত্রা, ঐ ছিন্নভিন্ন মন্ত্র ও হৃদয়ে/ তুমি যেন ফিরে আসো — আদর্শে একত্র করো ওকে।’’

আর? আর কী লিখেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়? ‘লেনিন-মূর্তির প্রতি’ অবনত শক্তি শেষ করছেন,‘‘তোমাকে বিশ্বাস ক’রে দূরদেশে ফেলে রাখা যায়?/ তাই কাছে এনে রাখা, যদি আমি মিছিলে না যাই…/ যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে প’ড়ে থাকি ফুলের বাগানে — তোমাতে বিশ্বাস যদি নাও থাকে, জানি ক্ষমা পাবো।’’


নিজেকে কখনও মার্কসবাদী দাবি না করা এক কবি এই ভাবেই লেনিনের প্রতি আনত হয়েছেন।
কী চাই, কেন চাই লেনিনকে? আজ তবে জয়দেব বসু, কমরেড জয়দেব বসুর পংক্তিই থাক —‘‘বাঁচব বলে জন্মেছি তাই আরোয়াল বা দার্জিলিঙে/ মৃতদেহের একরকমই মানে/ বুলেট এত নিবিড় টানে বাঁধছে দেশে দেশে/ জোহানেসবার্গ-পানামা-গঙ্গা/ মন কী আজো লেনিন চায়? মনকে বলো — হ্যাঁ,/ মনকে বলো — হ্যাঁ, তবু হ্যাঁ।’
নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয়দেব বসুর মত অনেকের মননে লেনিন রেখা এঁকে গেছেন স্পষ্ট, দৃঢ়। কিন্তু আরও আগে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদ-শাসিত কাঁটাতার বিবর্জিত ভারতে ভোলগার জল কী ছুঁয়েছিল অববাহিকা? হ্যাঁ। নিশ্চিতভাবে পৌঁছেছিল।
প্রমাণ? অনেক। আপাতত কালিন্দীর চরে যাই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লেখক-শিল্পীদের সংগঠিত করার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরি। আসুন।
রাত্রির প্রথম প্রহর শেষ হয়ে আসছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। স্বভাবতই জমাট অন্ধকার নদীর পাড়ে — যতদূর চোখ যায়। গায়ে বর্ষাতি, মাথায় বর্ষাতি টুপি। সেই অন্ধকারে নদীর বালি ভেঙে অহীন্দ্র বাড়ি ফিরছিল। চলাফেরায় সতর্কতার স্পষ্ট ছাপ।
ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের ছেলে অহীন্দ্র। তাঁর এই ভাবে বাড়ি ফেরা কেন? সেই প্রশ্নের জবাব লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তখনও অহীন্দ্র বোঝেনি যে সে অন্ধকারে দিক ভুল করেছে। রায়হাটের চরে না নেমে সে নেমে পড়েছে কালিন্দীর বুকে জেগে ওঠা সেই চরে, যেখানে পুঁজিবাদের কৌশলের কাছে সামন্ততন্ত্র পরাজিত হয়েছে। যে চর দেখিয়ে দিয়েছে পুঁজিবাদ কত নোংরা, কতটা নৃশংস, কতটা নিপিড়নের ক্ষমতা সে ধরে।


কেন এত সংগোপনে বাড়ি ফিরছে শহরে পড়তে যাওয়া রায়হাটের জমিদার বাড়ির ছেলে? তারাশঙ্কর লিখলেন কারন — ‘‘বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মহাযুদ্ধের পর তখন ভারতের গণ আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় শেষ হইয়াছে। নূতন অধ্যায়ের সূচনায় রাশিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজতন্ত্রবাদী যুবক-সম্প্রদায়ের এক ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হইয়া পড়িল। ভারতের নানা স্থানে খানাতল্লাসী এবং ধরপাকড় আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। অহীন্দ্র ছিল ইউ.পি-র কোন একটা শহরে। সেখান হইতে আত্মগোপন করিয়া আসিতেছে। আবার আজই, রাত্রির অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই বাহির হইয়া পড়িতে হইবে। দৃঢ় দীর্ঘ পদক্ষেপে বালি ভাঙিয়া কুলে আসিয়া উঠিল।’’


তখনই অহীন্দ্র বুঝলো সে ভুল চরে উঠেছে।
কিন্তু কেন অহীন্দ্র এত বিপদ মাথায় নিয়ে রায়হাটে ফিরছিল?
ভালোবাসার অনুভূতি ছাড়া বিপ্লবী হওয়া যায় না। বিপ্লবী না হলে কালিন্দীর চর ভেঙে অন্ধকারকে অস্বীকার করা যায় না। কালিন্দীর চর ভেঙে, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার দিনগুলিতে এক আত্মগোপনকারী কমিউনিস্টকে তারাশঙ্কর কয়েক ঘন্টার জন্য গ্রামে ফেরানোর কথা ভাবতে পারেন। কারন — ‘গভীর অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া এই দুর্যোগ মাথায় করিয়া সে মা ও উমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে।’
মা — অহীন্দ্রর অপার ভরসা এবং নিরবচ্ছিন্ন শ্রদ্ধা। উমা? তাঁর স্ত্রী — মুগ্ধতার নদী, ভালোবাসার কালিন্দী।
নভেম্বর বিপ্লব বাংলা সাহিত্যকে বিস্তর প্রভাবিত করেছে। শুধু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নন, আরও অনেকের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় তার সুস্পষ্ট চিহ্ন আঁকা রয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে তা এক গবেষণরা বিষয়। তা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই গবেষণা করেছেন। ফলে গবেষণা লব্ধ সেই সব আলোচনার ফলের বিবরণ এখানে উল্লেখ করার কোনও অর্থ নেই। শুধু কয়েকটি উদাহরণই দেওয়া যেতে পারে।


‘মার্কসবাদী সাহিত্য বিতর্ক’-র প্রথম খন্ডের গোড়াতেই ‘মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক প্রসঙ্গে’ ধনঞ্জয় দাশ বলছেন,‘‘..এদেশের বুদ্ধিজীবী ও অগ্রগণ্য সাহিত্যিকদের একাংশের চিন্তা-জগতে অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব পড়লেও পরবর্তী একটি দশকে শিল্প-সাহিত্য বিচারে কিন্তু মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার আলোক আদৌ বিচ্ছুরিত হয়নি। এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে, ১৯২৯ সালে মীরাট-ষড়যন্ত্র মামলার পূর্ব পর্যন্ত, আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হওয়া সত্বেও, মার্কসবাদে দীক্ষিত ও পরিশীলিত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ছিল অঙ্গুলিমেয়।’’
যদিও এক ফৌজি, অনবদ্য বাঁশিবাদক সেই ‘পরিশীলিত বুদ্ধিজীবীর’ জন্য অপেক্ষা করাননি আমাদের।
মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কাছে যাই। যাই নজরুলের পাশে।
১৯১৯-র জুলাই থেকে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ এবং পত্রিকার অন্যান্য সংগঠকরা নজরুল ইসলামের পত্রিকা ছাপতে শুরু করেছিলেন। নজরুল যখন সামরিক বাহিনীতে তখনই তাঁর দুটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল সেই পত্রিকায়। আর সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীনই নভেম্বর বিপ্লবের প্রতি নজরুলের আকর্ষণ জন্মেছিল।
দমদম সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকাকালীন, ১৯৬৫-তে ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ শেষ করার সময় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কথায়,‘‘ব্যাথার দান’’ পড়ে আমরা তখনও বুঝেছিলাম এবং এখনও বুঝতে পারছি যে রুশ বিপ্লব ও লাল ফৌজের প্রতি নজরুলের একটা আকর্ষণ জন্মেছিল।’’ তবে যা স্মরণিয় তা হলো, ১৯১৯-এ ‘ব্যথার দান’ গল্পে যে দেশপ্রেম সুপ্রকাশিত হয়েছিল সেই কারনে কলকাতার কোনও প্রকাশক বইটি ছাপতে রাজি হননি। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের ব্যাখ্যা,‘‘শুধু দেশপ্রেম নয়, নজরুল ইসলামের এই গল্পের ভিতর দিয়ে আন্তর্জাতিকতাও ফুটে উঠেছে। আমাদের সাহিত্যে একটা নূতন জিনিস বলতে হবে।’’

‘নূতন জিনিস’ কী?
গল্পের এক জায়গায় নজরুল শোনাচ্ছেন সরফুল মুল্ক নামের একটি চরিত্র বলছেন,‘‘যা ভাবলুম, তা আর হ’ল কই? ঘুরতে ঘুরতে শেষে এই লালফৌজে যোগ দিলুম। এ পরদেশীকে তাদের দলে আসতে দেখে তারা খুব উৎফুল্ল হয়েছে। মনে করছে, এদের এই মহান নিঃস্বার্থ ইচ্ছা বিশ্বের অন্তরে অন্তরে শক্তি সঞ্চয় করছে। আমায় আদর ক’রে এদের দলে নিয়ে এরা বুঝিয়ে দিলে যে কত মহাপ্রাণতা আর পবিত্র নিঃস্বার্থপরতা প্রণোদিত হয়ে তারা উৎপীড়িত বিশ্ববাসীর পক্ষ নিয়ে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, এবং আমিও সেই মহান ব্যক্তি সঙ্ঘের একজন।’’
এই গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল সাবেক রাশিয়ার লাগোয়া বেলুচিস্তান। প্রধান চরিত্র দারা এবং সরফুল মুল্ক দুজনেই লাল ফৌজে যোগ দিয়েছিল। গল্পটি লেখা ১৯১৯-এ। অর্থাৎ ১৯১৭-র বিপ্লবের অভিজ্ঞতাই ফুটে উঠেছে গল্পে। কিন্তু গল্পে ‘লাল ফৌজ’ শব্দটি নেই। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের কথায়,‘‘নজরুল ইসলাম যখন ‘ব্যথার দান’ গল্পটি আমাদের নিকটে পাঠিয়েছিল তখন তাতে এই দু’জনের লালফৌজে যোগ দেওয়ার কথাই, অর্থাৎ আমি ওপরে যে উদ্ধৃতি দিয়েছি ঠিক সেই রকমই ছিল। আমিই তা থেকে ‘লালফৌজ কেটে দিয়ে তার জায়গায় ‘মুক্তি সেবক সৈন্যদের দল’ বসিয়ে দিয়েছিলাম। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ভারতে ‘লাল ফৌজ’ কথা উচ্চারণ করাও দোষের ছিল। সেই ব্রিটিশ ভারতের লোকেরা যে যোগ দেবে, তা যদি গল্পেও হয়, তা পুলিসের পক্ষে হজম করা মোটেই সহজ হতো না।’’


১৯৫৭ সালের ৬ই জুন চুঁচুড়ার প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়কে নজরুল ইসলামের ফৌজের সহযোদ্ধা জমাদার শম্ভু রায় একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে নভেম্বর বিপ্লবের পরে ব্যারাকে নিজের ঘরের সামনে নজরুল ইসলাম ‘উৎসব’ করেছিলেন। সেখানে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গান হয়, প্রবন্ধ পাঠ হয়। রুশ বিপ্লব নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল।
‘ব্যাথার দান’-এ ভারতীয় সেনাদের লাল ফৌজে যোগদানের কাহিনীর বিবরণের এটিই প্রেক্ষাপট।
নভেম্বর বিপ্লব এবং লেনিন নানা ভাবে বাংলা সাহিত্যের ধারাগুলিকে অনুপ্রাণিত করেছেন। সেই অনুপ্রেরণা বলিষ্ঠ আশাবাদের। কার কথায় তার ছবি তুলে ধরি? অন্নদাশঙ্কর রায়? তিনি কী বলেছিলেন ‘লেনিন মূর্তিতে’ — ‘‘লেনিন মূর্তি না বাঁচে তো/ গান্ধীও কি বাঁচবে?/ গান্ধী মূর্তি ধ্বংস করে/ নাচবে ওরা নাচবে।…বিশ শতকের সঙ্গে লড়ে/ অষ্ঠাদশ কি পারবে? ভাঙবে কিছু, চুরবে কিছু/ সর্বশেষে হারবে।’’

Lenin Mausoleum

শেয়ার করুন

উত্তর দিন