বিজেপির নারী বিদ্বেষী নীতি - মালিনী ভট্টাচার্য

আজ ৮ই মার্চ, ২০২১

৮ই মার্চ আমাদের চােখ ইতিহাসের পাতায় ছাপােনা একটি তারিখমাত্র নয়। ৮ই মার্চ আজ এখন। পেট্রোগ্রাডের নারীশ্রমিক বা বিশ্বযুদ্ধে রত রুশ সৈনিকের স্ত্রীদের কাছে ১৯১৭র ৮ই মার্চটা যেমন 'রুটি ও শান্তির' আওয়াজ তোলার দিন ছিল তেমনিই মেয়েদের আন্দোলনের পরম্পরায় এদিনটি বারবার নতুন সময়ের নতুন ডাক নিয়ে ফিরে এসেছ।

প্রতিবার ৮ই মার্চ নতুন করে জন্মায়, যেমন জন্মেছিল ভারেতর স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন মেয়েরা নিজেদের তাগিদে দান্ডি সত্যাগ্রহে যোগ দিল, মন্বন্তর-দেশভাগের ভয়াবহ দিনে যখন ত্রাণের কাজে বা মেয়েদের আশ্রয়গৃহ খোলার উদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বা তেলেঙ্গানা -তেভাগার কৃষকসংগ্রােমর সামেনর সারিতে এসে দাঁড়াল। না পারিবারিক বাধা, না সমাজের চোখরাঙ্গানি, না রাজৈনিতক নেতৃত্বের অনীহা কিছুই তাদের আটকাতে পারল না। এই মেয়েদের বেশির ভাগেরই নাম জানা নেই, অনেকেরই কোনো রাজনৈতিক দিশা নিয়ে আন্দোলনে নামেনি, যে রাস্তায় তারা নেমেছে তা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে তার ধারণাও তাদের হয়তো ছিলনা, কিন্তু তারা বুঝেছিল সময় তাদের কাছে দাবি করেছে সামাজিক-পারিবারিক শিকলভাঙার লড়াই। ৮ই মার্চের নতুন মানে তাদের বাদ দিয়ে তৈরি হত না।

২০২১ সালেও তা হবে না যাদের ছাড়া, আজ তাদেরি তাই খুঁজি। যখন গণতন্ত্রই ফ্যাসিস্ট থাবায় বিপর্যস্ত তখন আজ মেয়েদেরও মূল লড়াই নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের পোস্টাই হয় কোথা থেকে? সমাজের রক্ষণশীলতার মধ্যে কি তার বীজ থাকে না? তা কি উশকানি পায় না আপনার-আমার ভিতরে লুকিয়ে-থাকা অন্ধকােরর ঘূর্ণিগুলি থেকে?

মেয়েদের দাবিয়ে রাখাই সমাজের পক্ষে মঙ্গলকর, ঘরের ভূমিকাই তাদের আসল ভূমিকা, আমাদের সঙ্গে তারা থাকুক, কিন্তু সুতোটা থাক আমাদেরই হাতে, এধরনের চিন্তার শিকড় সমাজের মধ্যে যদি না থাকত তাহলে ফ্যাসিস্ট শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার সুযোগ পেত কি? দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় কি পারত ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার বিয়ের নিদান দিতে, তাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ওপর ফতোয়া দেওয়া আইন তৈরি কি চলত? এদেশের মেয়েদের রক্তাক্ত বধ্যভূমিতে আজ পরিণত হত মনুবাদের আধুনিক সংস্করণ-রচয়িতাদের হাঁড়িকাঠের নকশা যদি না উঠে আসত আমাদেরই গোপন দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্ববিরোধের অন্ধ খাদান থেকে? প্রশ্ন আসছে,মেয়েরাও কি এর শরিক নয়..? এই শিকলবাঁধা 'সুরক্ষা'কি তারাও চায় না ?

এর জবাব দেবার জন্য খুঁজি সেই মেয়েদের যাদের নাম জানি না, কিন্তু সেই অন্ধ খাদানের তলা থেকে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে যারা ধাপে ধাপে উঠে আসছে। তারাই হয়তো পরিবারের প্রথম প্রজন্মের দলিত অধিবাসী বা মুসলিম পরিবারের মেয়ে মাঠঘাট ভেঙ্গে অনেক বিপদ মাথায় নিয়ে দূরপথ অতিক্রম করে স্কুলকলেজে যাচ্ছে, অতিমারীর মরশুমেও পড়া বন্ধ করতে রাজি হয়নি যারা, কেউ হয়তো কাজ খুঁজছে, কম মজুরির বিনিময়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটছে, কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ, গান গাইছে, নাটক করছে, সিংঘু বা টিকরি সীমান্ত থেকে বার্তা দিচ্ছে তারাও কিষান, কৃষিবিরোধী আইন বাতিল হবার আগে তাদের ঘরে ফেরার প্রশ্ন নেই, মজুরির লড়াইেয় অংশ নিতে গিয়ে কেউ গ্রেফতার হচ্ছে, পুলিশি নৃশংসতার স্বীকার হচ্ছে, জীবনসঙ্গী নির্বাচনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জাতধর্ম নয় মনের মিলনের ওপর আস্থা রাখছে, পাত্রপক্ষয়ের পণললুপতার কাঁদুিন না গেয়ে পত্রপাঠ তাদের দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে, শত অত্যাচারেও বাহুবলী ধর্ষেকের ওপর থেকে মামলা তুলেটে রাজি হয়নি,

এইসব মেয়েদের খুঁজি কারণ ৮ই মার্চের নতুন বয়ান তৈরি করবে এরাই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চাই এই মেয়েদের স্বনির্ভরতার স্বীকৃতি, নইলে লড়াই অসম্পূর্ণ। ৮ই মার্চ ২০২১এ তাদেরই অপেক্ষায় আছি।




শেয়ার করুন

উত্তর দিন