৮ই এপ্রিল ১৯২৯ - দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট । দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় তখন দুটি জনবিরোধী বিল ( পাবলিক সেফটি বিল ও ট্রেড ডিস্পিউটস বিল) আইনে পরিণত হতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় সভার মধ্যে ফাটলো তাজা বোমা । মুহূর্তের মধ্যে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল । ধোঁয়ায় ভরা আইনসভায় আওয়াজ ভেসে এলো। " ইনকিলাব জিন্দাবাদ", "সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক" । ইনকিলাব জিন্দাবাদ ধ্বনিত হওয়ার সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়তে থাকে HSRA এর ইশতেহার - যার প্রথম লাইন "বধির কে শোনাতে হলে খুবই উঁচু গলায় বলার প্রয়োজন হয়" । বোমা নিক্ষেপিত হওয়ার সাথে সাথেই সভার সদস্যরা ভীত হয়ে পড়ে । ঠিক তখনই ধোঁয়ার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে দুই বিপ্লবী ভগত সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত । বোমা নিক্ষেপ করেই পালিয়ে যাননি তারা । দুই তরুণ ইনকিলাব জিন্দাবাদ ধনী দিতে দিতে স্বেচ্ছায় ইংরেজ পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন । বোমা ফাটিয়ে ব্যক্তি হত্যা করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না । সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের আলোকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই আর বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলাই ছিল তাদের লক্ষ্য । এসেম্বলি বোমা মামলায় ভগৎ সিংহ, বটুকেশ্বর দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ।
এই মামলা চলাকালীন ভগত ও বটুকেশ্বর আদালতকে স্লোগানে ভরিয়ে দিতেন। তারা চিৎকার করে বলতেন বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক ইত্যাদি । বিচারক ভগৎ সিং কে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই ইনকিলাব জিন্দাবাদ এর অর্থ কি ? বিপ্লবই বা কি ? ভগৎ সিং এর উত্তর দিতে গিয়ে বলেন -" বিপ্লব বলতে সবসময়ই রক্তক্ষয়ী সংঘাত বোঝায় না । ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর উদ্দেশ্যে বিপ্লব সাধিত হয় না । বিপ্লব বোমা পিস্তলের সাধনা নয় । বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি অন্যায় অবিচারে পূর্ণ প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন। উৎপাদক ও মজুরেরা সমাজের অতি প্রয়োজনীয় অংশ , অথচ এদের শ্রমকে যারা কাজে লাগাচ্ছে তারা চূড়ান্তভাবে শোষণ করছে ওই শ্রমজীবীদের কেড়ে নিচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার টুকুও। যে কৃষক সকলের জন্য ফসল ফলায় তার পরিবারই থাকে উপোসী। যে তাঁতির বোনা সুতো বিশ্বের বস্ত্র বাজারে চাহিদা মেটায় নিজের ঘরে তার আর তার ছেলেমেয়েদের পরনের কাপড় জোটে না । যে মিস্ত্রি, কুমোর আর ছুতোরের হাতে গড়ে ওঠে সুবৃহৎ অট্টালিকা, হীন অন্ত্যজের মত তাদের জীবন কাটে ঘিঞ্জি বস্তিতে।
সমাজের পরজীবী শোষক আর পুঁজিপতিদের খেয়াল খুশি অনুযায়ী চলতে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষকে। এই ঘোরতর অসাম্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে জোর করে তৈরি করা বিভাজন সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে বাধ্য। এরকম অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনা । আজকের এই আনন্দমুখর সমাজ আসলে দাঁড়িয়ে আছে এক আগ্নেয়গিরির প্রান্ত সীমায় ।
সময়মতো রক্ষা করতে না পারলে সভ্যতার এই সৌধ অচিরেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে তাই প্রয়োজন এক মৌলিক পরিবর্তন। এই উপলব্ধি যাদের হয়েছে তাদেরই দায়িত্ব সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে সমাজকে পুনর্গঠিত করা । যতদিন না এ কাজ সম্পূর্ণ হবে ,যতদিন না মানুষের দ্বারা মানুষের জাতির দ্বারা জাতির শোষণের অবসান ঘটবে, ততদিন পর্যন্ত মানবজাতি দুর্দশা আর হত্যালীলার আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে না । যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে বা বিশ্ব শান্তির যুগ শুরু হবে এসব আশ্বাস ভন্ডামি ছাড়া আর কিছু নয় ।বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি সমাজের এক চূড়ান্ত কাঠামো যা ভেঙ্গে পরার আশঙ্কায় কম প্রমাণ হয় না যেখানে স্বীকৃত হয় সর্বহারা সার্বভৌমত্ব আর যে সমাজে এক বিশ্ব সংঘ মানবজাতিকে মুক্তি দেয় পুঁজিবাদের শৃঙ্খল আর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দুর্ভোগ থেকে"।
এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে ভগত সিং সমাজতন্ত্রের প্রতি কতটা আস্থাশীল ছিলেন । কীর্তি পত্রিকায় এনার্কিজম সংক্রান্ত ভগতের রচনাবলী থেকে তার রাজনৈতিক পরিপক্কতার প্রমাণ মেলে । ভগৎ সিং এর অন্যতম কমরেড শিব বর্মা, ভগৎ সিং এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছিলেন " সাধারণ মানুষ জানে না ভগৎ সিং সত্যিই কি ছিলেন । লোকেরা এইটুকুই কেবল জানে যে ভগৎ সিং একজন বীর ছিলেন । তিনি লালা লাজপত রায়ের হত্যার বদলা নিয়েছিলেন । দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় একটা বোমা ছুড়েছিলেন । কিন্তু ভগৎ সিং যে কোন উচ্চ স্তরের চিন্তাবিদ - বুদ্ধিজীবী, এক বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন এ সত্য অনেকেই জানে না "।
১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিং জন্মগ্রহণ করেন পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বাংগা গ্রামে । তার মা বিদ্যাবতী দেবী । পিতা কিশেন সিং ছিলেন একজন বিপ্লবী । ভগৎ সিং যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিন তার পিতা ছিলেন কারাগারে বন্দি । তার কাকা অজিত সিংও ছিলেন একজন বিপ্লবী । ভগৎ সিং এর পিতা ও কাকা দুজনেই ছিলেন গদর দলের সদস্য । গদর বিপ্লবীদের আন্দোলন তার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল । ১৯১৫ সালে গদর দলের বিপ্লবী কর্তার সিং সারাভার মৃত্যু ভগৎ সিং এর চেতনায় দাগ কেটেছিল । ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিচলিত করে তুলেছিল ভগৎ সিংকে । লাহোর ন্যাশনাল কলেজে পড়ার সময় তার সাথে পরিচয় হয় ভগবতিচরণ ভোরা, সুখদেব থাপার, জসপাল, জয়দেব গুপ্তা প্রমুখের সাথে। তখন থেকেই শুরু হয় ছাত্র আন্দোলনের জীবন । ১৯২৩ সালে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশনের । ওই সময় পরিবার থেকে বিবাহের জন্য চাপ দেওয়ার ফলে ভগৎ সিং গৃহত্যাগ করে কানপুর গেলেন ও গণেশ শংকর বিদ্যার্থীর ছাপাখানায় কাজ নিলেন । সেখানে অনেক রাজনৈতিক কর্মীরা আসতেন । কানপুরে পরিচয় হলো বর্ধমান থেকে আসা বটুকেশ্বর দত্ত, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জী, চন্দ্রশেখর আজাদের সঙ্গে । যোগ দিলেন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে । সংগঠন পরিচালনার জন্য চাই অর্থ সেই কারণেই ১৯২৫ সালে ট্রেন ডাকাতির সিদ্ধান্ত নেয় এইচ আর এ । ট্রেন ডাকাতির ফলে ধরা পড়লেন HRA এর সদস্য রামপ্রসাদ বিসমিল ,আশফাকুল্লা খান, রোশন সিং, রাজেন লাহিড়ীরা । বিচার শুরু হওয়ার পর চারজনেরই মৃত্যুদণ্ড হল । নেতৃত্বরা যখন জেলে তখনই ভগৎ সিং এর উপর দায়িত্ব এসে পড়ল হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সংগঠন পরিচালনার । ছাত্র থাকার সময়ই তার মধ্যে প্রবল যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটে । কলেজের পাশে দ্বারকানাথ লাইব্রেরী যেখানে তিনি ইতিহাস ,রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি পাঠ করতে থাকেন । অল্প বয়সেই হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু, সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন । টলস্টয়, ভিক্টর হুগ, আনাতল ফ্রাস ,ভলতেয়ার, গোর্কি, দন্তয়েভসকি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের লেখা পড়তে শুরু করেছিলেন ।মার্কস,এঙ্গেলস, লেনিন তিনি গভীর আগ্রহে চর্চা করতে শুরু করেছিলেন । সোভিয়েতের বিপ্লব তার মনে রেখাপাত করেছিল । সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল । তার উদ্যোগেই হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন হয় ।
১৯২৬ সালে ভগৎ সিং, ভগবতীচরণ ভোরা , সুখদেব, যশপাল তৈরি করলেন একটি বিপ্লবী যুব সংগঠন "নওজোয়ান ভারত সভা"। এটি ছিল কার্যত গুপ্ত বিপ্লবী আন্দোলনের প্রকাশ্য মঞ্চ । জনসভায় বক্তৃতা, ইসতেহার বিলির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ও বিপ্লববাদের প্রচার ছিল এর প্রধান কাজ । এই সংগঠন গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিপ্লবী শহীদদের জীবনী ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে দেখাতেন গ্রামের মানুষের চেতনা বৃদ্ধির জন্য । পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে গ্রেপ্তার হন ভগৎ সিং । পুলিশ তাকে মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখায় ও একই সাথে উপদেশ দেয় সকাল বিকাল প্রার্থনা করার । ভগত সিং অনেক ভেবে ঠিক করেছিলেন প্রার্থনা তিনি করবেন না । আসলে সেই সময়েই ভাববাদী ভাবনা থেকে বস্তুবাদী ভাবনা , হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সমাজতান্ত্রিক ভাবনার দিকে এগোচ্ছিলেন ভগৎ সিং। ভগৎ সিং এর ভাবনায় পরিবর্তনের সাথে সাথেই তার রাজনৈতিক কর্মসূচিরও বদল ঘটছিল । দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যেই দেশের সব কটি বিপ্লবী সংগঠনকে এক জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন ভগৎ সিং । সকলকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখী করার উদ্দেশ্যেই ২৮ সালের একটি গুপ্ত সম্মেলন সংঘটিত করেছিলেন । ওই সময়েই হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের নামের সাথে সোশালিস্ট শব্দ যোগ করা হয়েছিল ভগৎ সিং এর উদ্যোগেই। আসলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রভাব তার সংগঠনের উপর এসেও পড়েছিল । HSRA আহ্বান জানিয়েছিল সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার । প্রতিরোধের মিছিল নেমেছিল লাহোরের মাটিতে । বিনা প্ররোচনা স্কটের নেতৃত্বে লাঠিচার্জ শুরু হলো মিছিলে । নির্মম লাঠির আঘাতে ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর শহীদের মৃত্যুবরণ করেন লালা লাজপত রায় ।
ভগৎ সিং এবং তার সহ যোদ্ধারা স্থির করেন লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে। ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর স্কটকে হত্যার পরিকল্পনায় জে পি স্যান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন ভগৎ সিং, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদরা । সেই সময়ই দেশের বিভিন্ন জায়গায় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আন্দোলন যেমন শুরু হয়েছে তেমনি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সোসালিস্টদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। মুজাফফর আহমেদ সহ 30 জন কমিউনিস্ট নেতার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা। ওই সময়ে আইনসভায় পাবলিক সেফটি বিল ও ট্রেড ডিসপিউটস বিল আইনসভায় পেশ করা হয় । প্রতিবাদ স্বরূপ ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত বোমা নিক্ষেপ করেন আইনসভায় ও ইস্তেহার বিলি করেন । বোমা নিক্ষেপ করে তারা পালিয়ে যাননি বরং তারা ধরা দিয়েছিলেন । গোটা আইন সভায় চিৎকার করে আওয়াজ তুলেছিলেন "ইনকিলাব জিন্দাবাদ" । তাদের দুজনের শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড । পরবর্তীতে বিচার চলার সময় ভগৎ সিং কে জেপি স্যান্ডার্স হত্যা মামলায় জড়িয়ে শুরু হয়েছিল বিচার । তদন্তে সুকদেব, রাজগুরু, শিব বর্মা, কিশোরী লাল, জয়দেব কাপুর, মহাবীর সিংহ সহ ২৭ জন বিপ্লবীকে আসামি করে শুরু হয় ইতিহাসের কুখ্যাত লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা। বিচারের শেষে ভগৎ সিং রাজগুরু শুকদেবের ফাঁসির হুকুম হয়। ১৯৩১ এর ২৩ শে মার্চ সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর আঘাতে শহীদের মৃত্যুবরণ করলেন বিপ্লবীরা। খুব অল্প বয়স থেকেই যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রবণতা গড়ে উঠেছিল ভগৎ সিং এর মধ্যে। মাক্স , এঙ্গেলস, লেনিন এর বইতো বটেই - বিশ্ব সাহিত্যের বহু গ্রন্থ সমূহ তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন । তার সহ যোদ্ধা শিব বর্মা তার শহীদ স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন " ১৯২৩ - ২৪ সালে যখন ভগৎ সিং এর দিন কাটছে চরম কষ্টে, নিয়মিত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, পরনের জামা নেই, পাজামা ছিড়ে গেছে, তার স্থান নিয়েছে একটি চাদর, সেটি লুঙ্গির মতো করে পড়া, তবু তার ক্ষদ্দরের একমাত্র গলাবন্ধু কোর্টের পকেটে থাকতো কোন না কোন বই"। যুক্তি দিয়ে বিচার করেই ভগৎ সিং সমাজতন্ত্রকেই মানবমুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় ভগৎ সিং ছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা বোধ তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল । তার জেল নোটবুক প্রমাণ করে সেই সময়ে শত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ, আর্থসামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে তিনি খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করতেন । মার্কস এঙ্গেলস লেনিনের বিভিন্ন উক্তিকে তিনি নোট করে রাখতেন জেলের ডাইরিতে।
১৯৩০ সালের ২১ জানুয়ারি লেনিনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ভগৎ সিং আদালতে হাজির হলেন গলায় লাল রুমাল বেঁধে এবং স্লোগান তুললেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক দীর্ঘজীবী হোক, লেনিনের নাম চিরজীবী হোক, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। রুশ বিপ্লবের সুস্পষ্ট প্রভাবেই ভগৎ সিংয়ের উদ্যোগে HRA তার জনপরিষেবা মূলক যাবতীয় জাতীয় সম্পত্তি - ইস্পাত শিল্প, নৌ বাণিজ্য শিল্প, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি সমস্ত কিছুই জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছিল।
ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও হতাশাকে আমল দেননি । জেলে বসে গভীরভাবে পড়াশোনা করেছেন, স্বদেশ চিন্তা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছেন। অন্ধবিশ্বাস - কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়ে বিচার করার উপরেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন ভগৎ সিং । সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা পোষণ করে সমাজতন্ত্রকেই চলার পাথেয় করেছিলেন ভগৎ সিং । সেই আদর্শ থেকেই জেলে বসে ভারতের মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিপ্লবী কর্মসূচির খসড়াতে জমির জাতীয়করণ, বসবাসীর জন্য আবাসনের গ্যারান্টি, কৃষকের ঋণ মুকুবের কথা বলেছিলেন তার সাথেই খসড়াতে শ্রমিকের কাজ ও কাজের সময় সম্পর্কে ,কারখানা জাতীয়করণ ও সার্বজনীন শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল । লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে ভগৎ সিং এবং তাঁর কমরেডরা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এই বিবৃতিতে তাঁরা স্পষ্টভাবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা জানিয়েছিলেন “আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি, গোটা সমাজব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায়, তবে মানবসভ্যতার পরিণতি বড় ভয়ানক।” ভগৎ সিং ও তার সহযোগীরা যে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন আজকের আর এস এস - বিজেপির হাতে তা আরও বিপন্ন। সার্বজনীন শিক্ষার জায়গায় এখন নয়া শিক্ষা নীতির নামে শিক্ষায় গৈরিকিকরণ আর ইতিহাস বিকৃতি , কারখানা জাতীয় করণের জায়গায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বিক্রি , জমির জাতীয়করণ - কৃষকের ঋণ মুকুবের জায়গায় ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া আর দেনার দায়ে জর্জরিত কৃষক। শ্রমিকের কাজ ও সময় সম্পর্কে ভগৎ সিং যে কথা বলেছিলেন খসড়ায় তার জায়গায় চরম বেকারত্ব তার সাথে যতটুকু কাজ আছে সেখানে ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ তারপরেও কাজের স্থায়িত্ব না থাকা । ভগৎ সিং এর দেশের মানুষ আজ চরম সংকটে । অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তার জন্য ধর্মীয়, সম্প্রদায়গত, জাতিগত বিভাজনের অপচেষ্টা প্রতিদিন চলছে আমাদের দেশে। একইভাবে আমাদের দেশ সহ বিশ্বজুড়েই সাম্রাজ্যবাদ তার রূপ বদল করে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এ সময় হতাশার নয়, এটা জেগে ওঠার সময়। ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও ভগৎ সিং হতাশায় নিমজ্জিত হননি, বরং সমাজতন্ত্রের পথেই মানবমুক্তির পথ কে খুঁজে নিয়েছিলেন । ভগত সিং চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদের শিকড় ও ডালপালা সমেত সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদ কেই নির্মূল করতে, আজকের ভারতবর্ষের যে উগ্র সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এর কথা বলা হচ্ছে ভগৎ সিং কখনোই সে ধরনের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন উদার আন্তর্জাতিক দৃষ্টি সম্পন্ন এক মানুষ। শুধুমাত্র ভারতের মুক্তি তিনি চাননি, তিনি চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির মুক্তি ।আজকের এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ধান্দার ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে, উগ্র সম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে রুটি - রুজির আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে ভগৎ সিংদের লড়াই থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে।