ওয়েবডেস্কের প্রতিবেদন :
সেদিনও ওরা ভয় পেয়েছিল। সেদিনও ওরা দেখেছিল ‘কমিউনজমের ভূত’। সেদিনও ওরা ভেবেছিল শ্রমিকদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে যদি সমাজতান্ত্রিক ভাবনা, সাম্যবাদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে ভেঙে পড়বে সূর্য ডুবে না যাওয়া দোর্দন্ড প্রতাপ ব্রিটিশ শাসন।
সেদিন ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসন। উত্তাল অগ্নিগর্ভ কুড়ির দশক। খেতে খামারে আগুণ জ্বলছে, জোট বাঁধছেন কৃষকরা। সুতাকল থেকে চটকলে একজোট হচ্ছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের মধ্যে, কমিউনিস্টদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে অজেয় সমাজতন্ত্রের ভাবনা। কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছে দেশে, গড়ে উঠেছে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’, শ্রমিক কৃষকদের সঙ্গে চলছে যোগাযোগ স্থাপনের কাজ।
নাহ! সেদিনও মানতে পারেনি ব্রিটিশ রাজ।
১৯২৮, আজকের সংসদ, সেদিনের ‘সেন্ট্র্যাল অ্যাসেম্বলি’তে আনা হয়েছিল ‘পাবলিক সেফটি বিল’। একটাই উদ্দ্যেশ্য, কমিউনিস্টদের সমাজতান্ত্রিকদের কোতল করো। ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’র সঙ্গে যেন যোগাযোগ না থাকে ভারতের কমিউনিস্টদের। বামপন্থীদের। ‘সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত’র থেকে যেন দূরে থাকে ভারতের কমিউনিস্টরা।
‘পাবলিক সেফটি বিল’র বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ। মডারেট থেকে মিলিট্যান্ট। সবার। মতিলাল নেহেরু থেকে লালা লাজপৎ রাই। সবাই ছিলেন ‘পাবলিক সেফটি বিল’ বিরুদ্ধে সরব। এআইটিইউসি’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক দিওয়ান চমন লাল বলেছিলেন ‘যদি তোমরা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার করো, যদি সমাজতন্ত্রের ভাবনাকে পায়ে মাড়িয়ে দিতে চাও, আমাদের লাশের ওপর দিয়ে তোমাদের সেই ক্ষমতা অর্জন করতে হবে’।
সেদিনও ওরা চেয়েছিল। শ্রমিকদের অধিকার কাড়তে। ধর্মঘটের অধিকার ছিনিয়ে নিতে। ধর্মঘট মানেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, অতয়েব ধর্মঘট বেআইনি, অতয়েব গ্রেপ্তার ধরপাকড়। সেদিনের ‘সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি’তে আনা হয়েছিল ‘ট্রেড ডিসপিউট বিল’।
না! ওরা সেদিনও সহজে পারেনি।
১৯২৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ‘পাবলিক সেফটি বিল’ কে ফেরৎ পাঠানো হয়েছিল সিলেক্ট কমিটিতে। ৬২/৫৯ ভোটে হেরেছিল ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সিলেক্ট কমিটির সুপারিশ মানা বিল পেশ করেছিলেন তৎকালিন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্রেরার। আবার হেরে যায় সরকার ৬২/৬১ ভোটে। ‘সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি’র প্রেসিডেন্ট বিঠলভাই প্যাটেল নিজের ভোট দিয়েছিলেন ‘পাবলিক সেফটি বিল’র বিরুদ্ধে।
যদিও ‘ট্রেড ডিসপিউট বিল’র পক্ষে সমর্থন যোগাড় করতে সক্ষম হয় ব্রিটিস সরকার।
চোয়াল শক্ত করেছিলেন ভগৎ সিং। চোয়াল শক্ত করেছিলেন ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’র কমরেডরা। কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবে না শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া ‘ট্রেড ডিসপিউট বিল’, কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবে না সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্টদের কোতল করতে চাওয়া ‘পাবলিক সেফটি বিল’।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল। দুপুর সাড়ে বারোটা। সবে সেই সময় ‘ট্রেড ডিসপিউট বিল’ নিয়ে নিজের রুলিং পেশ করতে যাবেন বিঠলভাই প্যাটেল, সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে হাজির মতিলাল নেহরু, জিন্না, মদনমোহন মালব্য, সেই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রেরার। ‘ভিজিটার্স গ্যালারি’তে ‘সাইমন কমিশন’ কুখ্যাত জন সাইমনও হাজির।
হঠাৎ! বোম। সেন্ট্রাল হলে। ধোঁয়ায় ধোঁয়া। আর খাঁকি শার্ট আর শর্টস পড়া দুই যুবকের চিৎকার করে স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ আর দুই বিলের বিরুদ্ধে ‘এইচএসআরএ’র গোলাপী রঙা লিফলেট ছড়িয়ে পড়ছে ‘সেন্ট্র্যাল অ্যাসেম্বলি’র ঘরে। দুই যুবকের মধ্যে যার মাথায় সাহেবি টুপি ছিল, তাঁর নাম ছিল ভগৎ সিং, আরেকজন তাঁর কমরেড বটুকেশ্বর দত্ত।
স্রেফ বোমা ফেলার জন্য বোমা ফেলেননি, ছিল না কাউকে খুন করার উদ্দ্যেশ্য। লক্ষ্য ছিল একটাই বধিরদের কানে স্পষ্ট শোনানো। যা করছো তোমরা করতে পারো না। রেজিস্ট্যান্স অ্যান্ড ডিফায়েন্স, প্রতিরোধ আর অবাধ্যতা।
পালিয়ে যাননি ভগৎ সিং। ধরা দিয়েছিলেন যাতে বিচার সভায় তাঁর কথা, তাঁর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাবনা, সমাজতান্ত্রিক ভারত গড়ার স্বপ্নের কথা জানতে পারে গোটা দেশ।
ইতিহাস কি বিস্ময়ের! ৯০ বছরেরও বেশি সময় পার করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর। চলতি সেপ্টেম্বর। ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় গায়ের জোরে গণতন্ত্রকে খতম করে হল্লা বাধিয়ে পাশ হয়ে গেল তিনটি কৃষি বিল। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। বিরোধী শূন্য সংসদে পাশ হল তিনটি লেবার কোড বিল।
সেদিনের মত আজও। ব্রিটিশের ‘ট্রেড ডিসপিউট অ্যাক্ট’ আজকের মোদী অমিত শাহদের ‘লেবার কোড’। ব্রিটিশদের মতই মোদী অমিত শাহরাও চায় শ্রমিদকের অধিকার কাড়তে। ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে। ধর্মঘট করলে জেলে পুরতে, কঠোর জরিমানা চাপিয়ে দিতে।
সেদিনের ব্রিটিশ শাসনের থেকেও বেপরোয়া আজকের সংঘের শাসন। ‘পাবলিক সেফটি বিল’ গিয়েছিল ‘সিলেক্ট কমিটি’তে, আজ লেবার কোড বিল থেকে কৃষি বিল ‘সিলেক্ট কমিটি’তে পাঠানোর দাবি টুকুই শোনেনি সংঘের মোদী সরকার!
আজকের এই ভারতে আজ এই জন্মদিনের দিন ভগৎ সিং কি দেখতেন কি ভাবতেন? ইতিহাস যেন ঝলসে উঠতো আজও তাঁর চোখে। তাঁর পাঞ্জাব আজও জ্বলছে। অমৃতসর থেকে লুধিয়ানা। কৃষিবিলের বিরুদ্ধে কৃষকরা ট্রাক্টর নিয়ে রাস্তায় রেল লাইনে সড়কে। হ্যাঁ, তাঁর ছবি নিয়েই।
ভগৎ সিং দেখতেন, বুঝতেন কতটা সত্যি ছিলেন তিনি , কতটা নির্ভুল ছিলেন তিনি। শতবর্ষে পা দেওয়া বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতন ‘রাজা আসে রাজা যায়, দিন বদলায় না..’।
আজ। ভগৎ সিং’র জন্মদিনের দিনও এই সেপ্টেম্বরেও তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক।
ভগৎ সিং মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জরুরি পূর্ব শর্ত হল রাজনৈতিক বিপ্লব। রাজনৈতিক বিপ্লব মানে শুধু এক হাত থেকে অন্য হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতার হস্তান্তর নয়। ভগৎ সিং সেই কবেই লিখে গিয়েছেন ‘তরুন রাজনৈতিক কর্মীদের লেখা চিঠি’তে। ‘শ্রমিক কৃষকদের কাছে কি ফারাক হয় যদি ভারত সরকারের প্রধান লর্ড রিডিং হন বা বা স্যার পুরুষোত্তমদাস ঠাকুর? কি তফাৎ গড়ে একজন কৃষকের কাছে যদি লর্ড আরউইনের বদলে আসেন স্যার তেজ বাহাদুর সপ্রু?’
কতটা নির্ভুল ছিলেন ভগৎ সিং!
আজকের পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশ দিল্লি ঘুরে কি ভাবতেন ভগৎ সিং? আজকের সকালের খবরের কাগজ বা আজকের টিভি চ্যানেলগুলোর ‘প্রাইমটাইম’ দেখেই বা কি করতেন? যখন শ্রমিক কৃষকদের দিন মজুর বানাবার প্রস্তুতি চলে তখন টিভিতে চলে রাম মন্দির। টিভিতে চলে রিয়া চক্রবর্তী। টিভিতে চলে লাদাখ গালোয়ান। যখন কৃষি বিল পাশ হয় তখনই দিল্লি দাঙ্গার চার্জ শিটে লেখা হয় একরাশ মিথ্যা। দাঙ্গার নামে ধর্মের নামে শ্রমিক কৃষকদের অ্যাজেন্ডাকে ভুলিয়ে দিতে চায় শাসক।
ভগৎ সিং লিখেছিলেন, ‘সব দাঙ্গা বন্ধ করার একটাই ওষুধ আছে। যদি দাঙ্গা সারাতেই হয় তাহলে দেশের অর্থনীতির গতিপথ পরিবর্তন করতে হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে উল্টে দেওয়া চলতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কঠিন কিন্তু জনগণকে ক্রমাগত লড়তে হবে সরকারের বিরুদ্ধে যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার না হটে যায়’।
আজকের রিপাবলিক টিভি, সুদর্শন টিভিওয়ালাদের জন্যই যেন ভগৎ সিং বলেছিলেন, ‘কাগজগুলোর একটাই লক্ষ্য মানুষের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে তোলো, মানুষের মনকে সাম্প্রদায়িকতায় বিষাক্ত করো যাতে আমাদের মিশ্র সংস্কৃতির সুমহান পাশাপাশি চলার ঐতিহ্য ধ্বংস হয়’।
আজ এই জন্মদিনের দিনও কতটা প্রাসঙ্গিক ভগৎ সিং।
ভগৎ সিংই শিখিয়ে গেছেন শ্রমিকদের কৃষকদের যদি পাল্টা প্রত্যাঘাত হানতে হয় ধর্ম জাত রং’র বিভাজন সরিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ‘ধর্ম জাতি রং প্রদেশ নিরপেক্ষে সব গরিব মানুষের অধিকারই সমান। শ্রেণি চেতনা গড়ে তোলার প্রয়োজন যাতে জনগণ নিজেদের মধ্যে লড়াই না করেন। নিজেদের পার্থক্য বিভাজনকে দূরে সরিয়ে রেখে শ্রমজীবী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যতক্ষণ না রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের হাতে না আসে। এই সমস্ত প্রচেষ্টায় তুমি কিছু হারাবে না একদিন তোমার শেকল খুলে যাবে এবং তুমি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাবে’। যেন আজকের সময়ের জন্যই লিখেছিলেন ভগৎ সিং।
আজ ভগৎ সিং’র জন্মদিনের শপথ হোক ফুল মালার আনুষ্ঠানিকতা শুধু নয়, শুধুই ভগৎ সিং চর্চা নয় আজকের সময়ে ভগৎ সিং’র শিক্ষার প্রয়োগ।
সেদিন ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্তরা ‘পাবলিক সেফটি বিল’, ‘ট্রেড ডিসপিউট বিল’ মেনে নেননি। ওঁদের বোমা ছোঁড়া ছিল রেজিস্ট্যান্স অ্যান্ড ডিফায়েন্স। প্রতিরোধ আর অবাধ্যতা।
আজকের কৃষি বিল, লেবার কোড আমরা মেনে নেব না। প্রতিরোধ আর অবাধ্যতায়। ওরা কর্পোরেটকে ডেকে আনবে মাঠে খেতে, ভাগিয়ে দেবেন কৃষকরা, আগলে রাখবেন মান্ডি। রিলায়েন্স আর আদানি এগ্রি লজিস্টিকদের কাছে ফসল কৃষকরা বিক্রি করবেন না, তাঁরা অনড় থাকবেন মান্ডিতে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দাম যোগ করে ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে। ওরা কর্পোরেটদের গুদামঘরে যত খুশি চাল, ডাল, তেল মজুত করার নিদান হাঁকতে পারে, ওদের কাছো বিক্রি করবেন না কৃষকরা। ওদের চুক্তি পত্র ছিঁড়ে জ্বালিয়ে দেবেন কৃষকরা।
ওরা লেবার কোড আনবে, কারখানায় কারখানায় মানবেন না শ্রমিকরা দাসত্বের আইন। ৮ঘন্টার বেশি তাঁরা কাজ করবেন না, তাঁরা অনড় থাকবেন ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে। হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’র নীতিকে তারা মানবেন না কারখানায়। কারখানা বিক্রি করতে এলে খরিদ্দারদের ভাগিয়ে দেবেন শ্রমিকরা। রেজিস্ট্যান্স অ্যান্ড ডিফায়েন্স। প্রতিরোধ আর অবাধ্যতা।
বোবা কালা সরকারকে শোনানোর কাজ আজও জরুরি! ভগৎ সিং’র সুমন্ত্রণা মনে রাখা আজও জরুরি।
শেয়ার করুন