বাবিন ঘোষ
ভীম রাও আম্বেদকর’কে ধরতে হলে কোন আম্বেদকরকে আমরা ধরব? তাঁর যে কারণে বহুল পরিচিতি, সেই সংবিধানের ড্রাফটিং কমিটির অধ্যক্ষ হিসাবে ধরব? এক অনমনীয় জননেতা হিসাবে ধরব', যিনি মদন মোহন মালব্য'র মত তাবড় রক্ষণশীল নেতৃত্বের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে পুণা চুক্তি করতে একরকম বাধ্য করেছিলেন গান্ধীকে? সদ্য-স্বাধীন দেশের সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ এক ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ় হিসাবে ধরব', যিনি নিজেরই তত্ত্বাবধানে ড্রাফট করা সংবিধানের অবলুপ্তি চেয়েছিলেন? নাকি শ্রেণী সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এক র্যাডিকাল-ডেমোক্র্যাট হিসাবে দেখব' যিনি বিনা পারিশ্রমিকে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা ফিলিপ স্প্র্যাটের হয়ে আদালতে সওয়াল করে তাঁকে রাজদ্রোহের অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস করিয়ে আনতে পারেন? নাকি এই একেকটি ঘটনা কে আলাদা আলাদা ভাবে দেখতে গেলে ‘অন্ধের হস্তিদর্শনের’ মত ‘ভুল’ হবে? এ সকল ঘটনা কি আদতে একটি নিরবচ্ছিন্ন যাত্রার একেকটি পরিচ্ছেদ?

এক ভয়ঙ্কর কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে দলিত মাহার জনজাতি'র এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ভীমরাওয়ের পক্ষে ‘বাবাসাহেব’ হয়ে ওঠা। শিক্ষাকে হাতিয়ার করেই ব্যক্তিক উন্নতি এবং ভারতের রাজনীতিতে একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যোগ করা। একদিকে সামন্তবাদী ভিত্তির ওপর গ'ড়ে ওঠা জাতিবৈষম্যের অত্যাচার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা, অন্য দিকে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা এবং বসবাস করার সুবাদে 'উদারবাদী' চেতনায় শিক্ষিত হয়ে ওঠা (অবশ্য সেখানেও বর্ণবিদ্বেষ দেখেছিলেন)। এই দুই শিক্ষার মধ্যেকার বিরাট দূরত্বকে এ দেশের সমাজজীবনে ঘোচানোর জন্য মার্কসীয় দর্শনকে আঁকড়ে ধরা বা পরবর্তীতে দলিতদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করার আহ্বান। এই বিরাট লম্বা যাত্রাপথে যে বিষয়টা অপরিবর্তিত থেকে গেছে, তা হল' হিন্দু সমাজে বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা এবং কোনো নির্দিষ্ট 'মরালিটি' দ্বারা পরিচালিত রাজনীতির বিপ্রতীপে ব্যক্তিমানুষের সার্বজনীন ‘অধিকার’কে রাজনীতি/ রাষ্ট্রপরিচালনার নীতির ভিত্তি হিসাবে নির্মাণ করা। তবে কি আম্বেদকরকে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের এক সংস্কারক হিসাবে ধরতে হবে? একটি জরুরি কথা আম্বেদকর বলে গেছেন ‘যে ব্যক্তি এ দেশে হিন্দু ধর্মে নীচু জাত, তাকে এ দেশের অন্য যে কোনো ধর্মেও নীচু জাত হিসাবেই গণ্য করা হবে’। অর্থাৎ বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে আম্বেদকরের যে লড়াই, তাকে শুধুমাত্র হিন্দু সমাজের বিষয় হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত মানুষের সামাজিক সমতার পক্ষেই তাঁর জীবনভর লড়াই থেকেছে।
শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বে শোষকের সাথে শোষিতের ঐতিহাসিক দ্বন্ধ অবসানের লক্ষ্যে শাসনের অধিকার জোর খাটিয়ে "কেড়ে নেওয়ার" যে অনিবার্য অংশটি রয়েছে, তার সাথে আম্বেদকরের বিরোধ ছিল। এই 'হিংসার' পথ তিনি মানতে পারেননি। তিনি উপলব্ধি অবশ্যই করেছিলেন যে caste not only ensures division of labour but division of laborers as well. বর্ণাশ্রম প্রথা শুধুমাত্র শ্রমবিভাজন ঘটায় তা নয়, সেটি শ্রমিকদের মধ্যেও বিভাজন ঘটিয়ে চলে। বর্ণাশ্রম উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈষম্য ঘটায় না কিন্তু উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবা ভোগ (কনজাম্পশন) এর ক্ষেত্রে বিভাজনটা ঘটায়, এই অর্থনৈতিক সত্যিটাও তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল। ১৯৩০ এর দশকে বস্ত্রশিল্পের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বকে (ভি বি কার্নিক, মনিবেন কারা, বি টি রনদিভে, আব্দুল মাজিদ) ট্রেড ডিস্পিউটস এক্টের আওতায় গ্রেপ্তার করে ফৌজদারি মামলা করে ব্রিটিশ সরকার (Emperor Vs. A.A Alwe, Criminal Appeal No. 592 of 1934) আম্বেদকর তাঁদের হয়ে আদালতে বলিষ্ঠ সওয়াল করেন এবং তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন। এর পরেও রনদিভে'র একটি বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকার যখন রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করে, আম্বেদকর আবারও আদালতে লড়াই করেন রনদিভে'র হয়ে। এই নির্দিষ্ট মামলায় একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হল’ আম্বেদকর তাঁর সওয়ালে যুক্তি দেন যে ঐ ভাষণে রনদিভে বোম্বাই প্রদেশের সরকারের নয়, বরং পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করেছেন। আদালতে আম্বেদকর যখন ব্যখ্যা করেন যে রনদিভে কেন পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করে থাকেন, তখন তিনি মার্কসীয় তত্ত্বের উপরেই সেই সওয়াল করেন! অর্থাৎ আদালত কক্ষকে বামপন্থী রাজনীতির প্রচারের কাজে যেমন লাগিয়েছিলেন মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্তরা, তেমনি একই পদ্ধতি আম্বেদকরও গ্রহণ করেছিলেন রনদিভে’র ডিফেন্সে! আবার মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার পানভেল অঞ্চলের চিরনার বনভূমিতে সত্যাগ্রহের মামলায় সত্যাগ্রহীদের তরফে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিরোধকারীদের পক্ষে মামলা করতে গিয়ে তিনি কৌশলে সত্যাগ্রহের অর্থনৈতিক কারণগুলোকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন তাঁর সওয়ালে। লক্ষ্যণীয় যে মত ও পথের অমিল থাকা সত্ত্বেও (এ ক্ষেত্রে সহিংস পদ্ধতি) কমিউনিস্ট ও মিলিট্যান্ট জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে দাঁড়াতে তিনি পিছপা হননি। মহাত্মা গান্ধীর সাথে এ জায়গায় আম্বেদকরের খুব বড় তফাৎ।
কমিউনিস্টদের সাথে অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার প্রশ্নে আম্বেদকরের মতপার্থক্য খুব বেশি ছিল না। ফারাকটা ঘটে গেল' অন্যান্য বিবিধ প্রশ্নে,যথাঃ শ্রেণী শাসনের পরিবর্তন ঘটাতে বল্প্রয়োগের অনিবার্যতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নে ইউরোপীয় ধাঁচের উদারবাদী হওয়া এবং সে কারণে যাবতীয় কালেক্টিভ স্বার্থের বিপ্রতীপে ব্যক্তিমানুষের অধিকারের পক্ষ নেওয়া, ইত্যাদি। কিন্তু সবচেয়ে বড় ফারাকটা ঘটল’ জাতিপরিচিতি’র প্রশ্নে। এই উপমহাদেশে বর্ণাশ্রম প্রথা যে শ্রেণীশাসনেরই একটা অঙ্গ, তা মেনে নিয়েও জাতিপরিচিতিকে শ্রেণীপরিচিতির সাথে এক করে মেনে নিতে পারেননি আম্বেদকর।
মার্কসীয় দর্শনে বর্ণাশ্রম প্রথা আদতে সম্পদের সাথে উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্ক থেকে উদ্ভুত এক ব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থা ধর্মের বৈধতা পেয়ে থাকে। জাতি ব্যবস্থায় উৎপাদনের এই সম্পর্ক চিরকালই শোষণমূলক এবং বৈষম্যে ভরা। এই শোষণের সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য শাসক জাতি (শ্রেণী ও বটে) রাজনৈতিক ও আইনি ক্ষমতার উপর একচেটিয়া দখল বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। অতএব জাতিপ্রথার বিলোপের জন্য উৎপাদনের এই শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্ক, যা কিনা দলিত অংশের মানুষকে উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানার থেকে বহুদূরে সরিয়ে রাখে, সামাজিক পুঁজি- যেমন শিক্ষা'র থেকে বঞ্চিত করে, সেই উৎপাদন সম্পর্কের বিলোপ ঘটাতে হবে।
মার্কসীয় দর্শনের এই অবস্থান আম্বেদকর জানতেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি মনে করতেন যে জাতিপ্রথা একটি সামাজিক অবস্থানের (‘স্টেটাস’) বিষয় যা ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্টেটাস নির্বিশেষে সামাজিক সম্মান এবং প্রতিপত্তির উৎস হতে পারে। 'এনিহিলেশন অফ কাস্ট'-এ তিনি লিখছেন যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণের দ্বারাই মানুষ পরিচালিত হয় না এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতাই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ক্ষমতা নয়। ব্যক্তির সামাজিক ‘স্টেটাস’ ও তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস হয়ে উঠতে পারে। এই ভাবনার মধ্যে সমাজতাত্ত্বিক ও আইনবেত্তা ম্যাক্স ওয়েবারের ‘ক্লাস, স্টেটাস, পার্টি’-র প্রতিধ্বনি পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য আম্বেদকরের লেখায় ওয়েবারের কোনো উল্লেখ নেই। অতএব এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে ওয়েবারের দ্বারাই আম্বেদকর প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা এই ‘লাইন অফ থিংকিং’-এ।
কিন্তু আজ এই ২০২৫ সালে আম্বেদকরের সাথে এ দেশের মার্কসবাদীদের কী ফারাক, সে আলোচনায় যাওয়া কতটা প্রয়োজন? হয়ত' এ কারণেই প্রয়োজন যে আম্বেদকর যা চেয়েছিলেন, যতদূর অবধি চেয়েছিলেন, মনে করেছিলেন সংবিধান এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সেখানে পৌছনো সম্ভব, তা হতে পারেনি বা পারা সম্ভবই নয়, শ্রেণীদ্বন্ধের অবসান না ঘটিয়ে। লিবারেশন থিওলজি’র প্র্যাক্টিশানারদের সাথে সংস্লিষ্ট দেশের মার্কসবাদীদের সম্পর্ক সহজ। এই উপমহাদেশে (আম্বেদকরের ভাবনা, দর্শন সবই অবিভক্ত উপমহাদেশে জন্ম) বৌদ্ধ ধর্ম কি সেই লিবারেশন থিওলজির সমগোত্রীয় হতে পারে? এ বিষয়ে খুব বিশদ আলোচনায় না গিয়েও বলা যেতে পারে যে বৌদ্ধ যুগের পরবর্তীতে সনাতন ধর্মীয় ভাবধারার পুনরুত্থান বেশ কয়েকবার ঘটে গেছে, ইসলামের ভাবধারাও পুষ্ট হয়েছে- দুইয়ের ক্ষেত্রেই অবশ্যই রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্টপোষকতায়। অবজেক্টিভ দিক থেকে দেখতে গেলে বৌদ্ধ মতের চর্চা বর্তমানে ততখানি নেই যা রাজনীতির চর্চায় ‘ক্রিটিকাল মাস’ হতে পারে। তদুপরি, ভাববাদের নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতাও অতিক্রম করা সম্ভব না ধর্মীয় দর্শনের পক্ষে। কাজেই আম্বেদকরের সাথে অমিলের পরিবর্তে ব্যবহারিক রাজনীতিতে মিলের বা মতৈক্যের জায়গাগুলো ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন বামপন্থীদের।
অতএব, সেই গোড়ার প্রশ্নে ফেরা যাক। কোন আম্বেদকরকে ধরব’ আমরা? এর উত্তরে সামনে আসবেন সেই আম্বেদকর, যিনি শোষণের প্রতিটি আলাদা ডিনমিনেশনকে বুঝেছিলেন যথা- শ্রেণী, বর্ণ, লিঙ্গ; সেই আম্বেদকর যিনি সংবিধানকে শুধুমাত্র grundnorm অর্থাৎ দেশের সর্বোচ্চ আইনমাত্র নয়, একটি বৈপ্লবিক অস্ত্র বা পথ হিসাবে দেখেছেন এবং সেই সমাজবিপ্লবের প্রয়োজনে সংবিধানকে অতিক্রম করার ইঙ্গিত ও দিয়েছেন; সেই আম্বেদকর যিনি দু’ হাজার বছরের বেশি পুরনো শ্রেণী শোষণের ব্যবস্থাকে সমূলে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে শুধু কথার খরচ নয়, জীবন বাজি রেখে পা ফেলেছেন; সেই আম্বেদকর যিনি ‘জনপ্রিয় মত’ বা উপযোগিতাবাদের দিকে না গিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণে এস্টাব্লিশ করেন যে সনাতন ধর্ম আসলে is a collection of castes and sub-castes; সেই গোড়া ধরে নাড়া দেওয়া র্যাডিকাল গণতন্ত্রী, অর্গ্যানিক ইন্টালেকচ্যুয়াল আম্বেদকর’কেই আমাদের ধরতে হবে।
‘দ্য ডক্টর এন্ড দ্য সেইন্ট’-এ অরুন্ধতী রায় যেমনটা লিখেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধীদের তরফে পুঁজিবাদেরও বিরোধীতা প্রয়োজন এবং পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধাদের হয়ে উঠতে হবে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী লড়াইয়েরও মুখ।