ত্রিপুরায় আক্রমনের ঘটনার নেপথ্যে
তারিখঃ মঙ্গলবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ত্রিপুরায় বিজেপি বিরোধীদের সমস্ত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। এই কাজে তারা সিপিআই (এম) এবং বামফ্রন্টকেই মূলত নিশানা করছে। সঠিক খবর রপচার করে এমন গনমাধ্যমের অফিসগুলিতেও হামলা চালানো হচ্ছে। বিজেপি সরকারের আমলে ত্রিপুরায় ভারতের সংবিধান, সংবিধান স্বীকৃত গনতান্ত্রিক অধিকারসমুহ এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে কাজ করার নিয়ম কিছুই যেন প্রযোজ্য নয় এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে । দুঃখজনক ঘটনা এই যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সবচেয়ে বেশী উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে, হুমকি দিয়ে সিপিআই (এম)-এর বিরুদ্ধে এহেন নক্ক্যারজনক আক্রমণকে ন্যায্যতা দিচ্ছেন। ২০১৮ সাল, যখন থেকে বিজেপি ত্রিপুরায় ক্ষমতা দখল করেছে, এখনও পর্যন্ত, একজন মহিলা সহ ২১ জন সিপিআই(এম) সমর্থক এবং সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।
৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে বিজেপির গুন্ডাবাহিনী জয় শ্রী রাম স্লোগান দিতে দিতে লোহার রড ও পেট্রোল বোমা সজ্জিত হয়ে হামলা চালায়। ঘটনার সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও ঘরবাড়ি এবং দলীয় কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে কোনরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তারা অস্বীকার করে। এহেন হামলার ঘটনাকে উৎসাহ দিতে কিছু বিজেপি নেতা এবং মন্ত্রীরাও উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন।
৭ ও ৮ই সেপ্টেম্বর মোট ৪৪ টি পার্টি কার্যালয়ে (যার মধ্যে সিপিআই(এম)-র এর ৪২ টি, ১ টি আরএসপি’র এবং আরেকটি সিপিআই(এম-এল)’র ছিল) আক্রমণ চালানো হয়, কার্যালয়গুলিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, পার্টির সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। আগরতলায় সিপিআই(এম)-র রাজ্য দপ্তর আক্রমণ করে পোড়ানোর চেষ্টা করা হয়, বিজেপি’র গুন্ডাবাহিনী দপ্তরের চত্বরে প্রবেশ করে প্রবীণ আদিবাসী নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেবের মূর্তিটি ভাঙচুর করে। রাজ্য দপ্তরের সামনে মোতায়েন সিআরপিএফ জওয়ানদের আক্রমণের ঠিক এক ঘণ্টা আগে রহস্যজনকভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। এলাকায় সিপিআই (এম) সমর্থকদের দোকানগুলি হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা লুট করা হয়েছে। কয়েকজন সমর্থক শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে অন্তত দশজনকে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এই অবস্থায় রাজ্য পুলিশ সিপিআই(এম) সমর্থকদেরকেই মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করছে।
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাতেই যে এমন নির্মম হামলা চলেছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ত্রিপুরায় বিরোধী দলের নেতা এবং ত্রিপুরার চারবারের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে পুলিশ ৬ই সেপ্টেম্বর তার নিজের নির্বাচনী এলাকায় যেতে বাধা দেয় এমনকি অবরোধ করে রাখার চেস্টাও করে। সরকারী দলের কয়েকজনকে জড় করে সেই অজুহাত দেখিয়ে বিরোধী দলের নেতাকে নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখাই ছিল উদ্দেশ্য। গত ৬ই সেপ্টেম্বর যখন মানিক সরকার কাঠালিয়া ব্লকের বিডিও দপ্তরে গণ-ডেপুটেশন জমা দিতে যান তখন পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা আটকে সেই কর্মসূচি ভেস্তে দেবার চেস্টা করে এবং ব্যারিকেড তুলতে অস্বীকারও করে। এই গন-ডেপুটেশন কর্মসূচিতে শত শত মানুষ মানিক সরকারের জন্য অপেক্ষা করছিল, মানিক সরকার পুলিশের অপচেস্টা ধরে ফেলেন। এর আগেও শান্তি বাজারে আরেকটি কর্মসূচিতে বিধায়ক এবং দলীয় নেতাদের সঙ্গে উপস্থিত হবার মুখে পুলিশের উপস্থিতিতেই তার উপরে শারীরিক আক্রমণ চলে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রশাসন ও পুলিশকে সরকারী চেয়ারে থাকা বিজেপি নেতারা এমন নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
দেশজূড়ে বিভিন্ন গনমাধ্যম ব্যাপকভাবে সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির অফিসসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে এবং সমর্থকদের উপরে হামলার খবর প্রচার করা সত্বেও দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নীরব রয়েছেন। এমন নীরবতা কার্যত ত্রিপুরা সরকারের দুষ্কর্মের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থনেরই ইঙ্গিত। ত্রিপুরায় হামলার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণসহ সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠালে সেই চিঠির প্রাপ্তিটুকুও স্বীকার করা হয়নি। বিরোধীদের সরকার রয়েছে এমন রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে সেখানকার বিজেপি নেতারা কোন অভিযোগ জানালে কেন্দ্র যে মনভাব দেখায় এক্ষেত্রে তাদের আচরণ সম্পূর্ণ বিপরীত।
২০১৮ সালে ত্রিপুরায় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে এহেন হামলার একের পরে এক পর্যায়। ২০১৮ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের জুন অবধি ৬৬২টি দলীয় কার্যালয়, বাম গণসংগঠনের ২০৪টি কার্যালয়, সিপিআই(এম)-এর সদস্য এবং সমর্থকদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৩৩৬৩টি, ৯৫৯টি দোকান হয় ভাঙচুর করা হয়েছে অথবা লুঠ করা হয়েছে এবং ১৫০০ কাজের জায়গা যেমন মাছের পুকুর, রাবার গাছ ইত্যাদি ধ্বংস করা হয়েছে। নির্লজ্জভাবে নারীদের বিরুদ্ধে বর্বর অপরাধগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিপিআই(এম) নেতাদের ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করার জন্য মিথ্যা মামলা চাপানো হচ্ছে।
ত্রিপুরায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে চাপা দিতেই আক্রমণ তীব্র হয়েছে। ক্ষমতায় আসার তিন বছর পরেও বিজেপি সরকার নির্বাচনের সময়ে দেওয়া প্রতিশ্রুতিসমূহ পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। অথচ এই সরকারের আমলে চালু জনকল্যাণ প্রকল্পগুলি এবং বামফ্রন্ট সরকারের উপজাতী মানুষ সম্পর্কিত নীতিগুলি বাতিল হয়েছে। আজ ত্রিপুরায় বুভুক্ষার তাড়না এবং অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে, অপরাধীদের প্রশ্যয় দেওয়া হচ্ছে। অথচ আরএসএস মানুষের মধ্যে ঘৃণা ও বিভাজনের বীজ বপনের চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছে। যখন গণমাধ্যমের খবরে বাস্তব অবস্থার ছবি তুলে ধরছে তখনই তাদের উপরে আক্রমণ নেমে আসছে। ৩০০ জনেরও বেশি গণমাধ্যমকর্মী শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এই পর্যায়ে, বিজেপি সরকারের সমালোচনা করে এমন ৪টি গনমাধ্যমের দপ্তরে হামলা হয়েছে। ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মানুষের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণই বিজেপিকে মরিয়া করে তুলেছে।
বিরোধী দল এবং বিশেষ করে বামপন্থীদের উপর এই আক্রমণ এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের উপর আক্রমনের ঘটনা আসলে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা এবং গণতন্ত্রের উপর সেই সর্বাত্মক আক্রমণেরই অংশ যা সারা ভারতেও ঘটছে। জনগণকে সাথে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির উচিত গণতন্ত্রের উপর এই সর্বাত্মক হামলার নিন্দা করা।
ত্রিপুরায় সমস্ত বিরোধী দলের বিরুদ্ধে এইসব হামলা এবং সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছে সিপিআই(এম)। মিডিয়ার উপর হামলা বন্ধ করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। বিভিন্ন ঘটনায় দায়ী দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যাদের বাড়ি, দোকান এবং অন্যান্য সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।