ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
২০১২-১৩ সাল থেকে এদেশের মূলধারার মিডিয়া এক অন্যরকম যুদ্ধ শুরু করে। যুক্তি,ধর্মনিরপেক্ষতা,গণতান্ত্রিক বোধ এই সমস্তকে ধ্বংস করার যুদ্ধ। খুব সচেতনভাবেই এখনও যারা সংবাদ মাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ মনে করেন এমন মুষ্টিমেয় সাংবাদিক ও মিডিয়াহাউসগুলো এই ‘প্রাইম টাইম’ মিডিয়াগুলোকে ‘গোদি মিডিয়া’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ডিক্সেনারির নির্বাচিত “word of the year” ছিল- Post Truth। আমাদের দেশের এই গোদি মিডিয়া উত্তর সত্য বা পোস্ট ট্রুথ নির্মাণকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সম্পর্কে এমন কিছু নিত্যনতুন শব্দ পাই যা তাজ্জব করে দেওয়ার মত। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল আসামের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সৃষ্ট নতুন শব্দবন্ধ – ফ্লাড জিহাদ। অবশ্য এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যেকোন ঘটনাকে একটা সাম্প্রদায়িক দিক দিতে গেলে মূলধারার মিডিয়া তার সাথে “জিহাদ” শব্দটা জুড়ে দেওয়া কোন নতুন ঘটনা নয়। জি নিউজ ২০২০ সালে একটি সম্পূর্ণ শো করেছিল বিভিন্ন ধরনের "জিহাদ" - "লাভ জিহাদ" থেকে "অর্থনৈতিক জিহাদ" থেকে "চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত জিহাদ" সম্পর্কে "রিপোর্ট" করার জন্য। জি নিউজের তৎকালীন প্রধান সুধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে পুলিশ।একই বছরে, বিজেপিপন্থী সুদর্শন নিউজ, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন (ইউপিএসসি) পরীক্ষায় মুসলমান "অনুপ্রবেশ" নিয়ে একটি বিতর্কিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যখন সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি হাইকোর্টের এই অনুষ্ঠান স্থগিত করার আদেশ বাতিল করে দেয়।অল্ট নিউজ এক ঘণ্টার একটা অনুষ্ঠানে সুদর্শন নিউজের ছয়টি মিথ্যাকে উন্মোচিত করেছিল। ভারতীয় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সুদর্শন নিউজের সম্প্রচারকে "সাম্প্রদায়িক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন সাংবাদিকতা" বলে অভিহিত করেছিল।
যাইহোক, আসাম বন্যা প্রসঙ্গে আসা যাক। আসামের কাছাড়,করিমগঞ্জ সহ ২৭টি জেলায় জুন মাস থেকে যে ভয়াবহ বন্যা শুরু হয়েছিল তাতে এখনও অবধি ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, ১৬১৮টা গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরাক উপত্যকার তথা দক্ষিণ আসামের সবথেকে বড় শহর শিলচর ও লাগোয়া অঞ্চল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৬ জুন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা হঠাৎ করেই সংবাদমাধ্যমের সামনে এই বন্যা সম্পর্কে বলেন যে, “এটা – ম্যানমেড বন্যা। যদি না কিছু দুষ্কৃতিকারী বেতুকান্দির রিংবাঁধ কেটে দিত তাহলে এই ঘটনা ঘটত না”। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেতুকান্দির থেকে শিলচর শহরের দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে, কাবুল খান, মিঠু হুসেন লস্কর, নাজির হোসেন লস্কর এবং রিপন খান – এই চারজনকে উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। একটি রিংবাঁধ হল এমন একটি কাঠামো যা সাধারণত একটি নদীর গতিপথের সমান্তরালে তার প্লাবনভূমিতে বা নিচু উপকূলরেখা বরাবর থাকে। এর উদ্দেশ্য হল নদীর গতিপথ পরিবর্তন রোধ করা এবং নদী বা উপকূল সংলগ্ন এলাকাকে বন্যা থেকে রক্ষা করা।
৫ জুলাইয়ের কাছাকাছি, মূলধারার মিডিয়ার একটি অংশ এই কথিত বাঁধ কাটাকে 'বন্যা জিহাদ' বা ‘ফ্লাড জিহাদ’ নামকরণ করে দেয়। নিউজএক্স শিলচরে বন্যা সংক্রান্ত একটি প্রাইমটাইম বিতর্ক সম্প্রচার করে। প্যানেলিস্টরা ছিলেন প্রাক্তন কূটনীতিক ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিক আর.ভি.এস. মানি, অরেলিয়াস কর্পোরেট সলিউশনের প্রতিষ্ঠাতা সুমিত পীর (রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসাবে), এবং আইটিভি নেটওয়ার্কের সম্পাদকীয় পরিচালক (নিউজএক্স-এর মূল সংস্থা) মাধব নালাপাত। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক সহ সমস্ত প্যানেলিস্টের মতামত ছিল যে "বন্যা জিহাদ"ই হয়েছে। সমস্ত আলোচক মিলে এই কথাই জোর গলায় বলতে থাকেন যে এই ঘটনা শুধুমাত্র ম্যানমেড বন্যা নয়, এর পেছনে আসামের মানুষকে মেরে ফেলার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত রয়েছে যার মাধ্যমে আসামের বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারকে বিপদে ফেলার উদ্দেশ্য রয়েছে।
নিউজএক্স এইরকম অনুষ্ঠান করার পরেই ম্যানমেড বন্যা থেকে ফ্লাড জিহাদে রূপান্তরিত করা হল আসামের বন্যা পরিস্থিতিকে-সুদর্শন টিভি থেকে দৈনিক জাগরণ, ওয়ান ইন্ডিয়া থেকে আরএসএস-এর মুখপত্র অর্গানাইজার মানে এক কথায় গোটা গোদি মিডিয়া ও তাদের নিবেদিত প্রাণ ‘সাংবাদিক’রা এটা প্রমাণ করতে উঠে পরে লাগল যে এই বন্যায় হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সরকারের কোন ব্যর্থতা নেই। যদিও এই বন্যার মধ্যেই মহারাষ্ট্রের সরকার ভাঙার খেলায় হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছিলেন। ২৪ জুন নাগাদ নিজের রাজ্যের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও একনাথ শিন্ডে ও তার সাথে থাকা বিক্ষুব্ধ শিব সেনা বিধায়কদের গুয়াহাটিতে খাতির-যত্ন করে ও “নিরাপদে” রাখার ব্যবস্থা করে হিমন্ত সরকার। ১৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের সদ্য প্রাক্তন রাজ্যপাল তথা বিজেপির উপরাষ্ট্রপ্রতি পদপ্রার্থী জগদীপ ধনখড়ের ট্যুইট থেকে আমরা জানতে পারি যে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা,মমতা ব্যানার্জী ও জগদীপ ধনখড় দার্জিলিঙের রাজভবনে দীর্ঘ সময় ধরে “সৌজন্য সাক্ষাৎ” করেন। নিজের রাজ্যের বন্যা পরিস্থিতি ছেড়ে ঠিক রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগেই এত সৌজন্যের প্রয়োজন কেন হতে পারে সেটা সকলেরই বোধগম্য হয়।
যদিও ম্যানমেড বন্যা বা ফ্লাড জিহাদ কোনটার কথাই অন্তত আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় না। দ্য হিন্দু জানিয়েছে, আসামে প্রাক-বর্ষা মরসুমে (মার্চ থেকে মে) স্বাভাবিকের চেয়ে ৪১% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং ২৫ জুন পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ৭১% বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৬১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে আসামের বার্ষিক স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ছিল ২,২৩৯.৪ মিমি। যাইহোক, মাত্র ১ মার্চ থেকে ২৪ জুনের মধ্যেই আসামে ১৮৯১.৯মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে – যা তিন মাসেরও কম সময়ে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের স্তরের কাছাকাছি।
কাছাড় জেলার এসপি রমনদীপ কউর সংবাদমাধ্যমকে বলেন যে তিনি তার জীবনে কখনও “ফ্লাড জিহাদ” বলে কোন শব্দ শোনেননি, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে কোন সাম্প্রদায়িক দিক খুজতে যাওয়া উচিৎ নয়। দ্য টেলিগ্রাফ এর খবর অনুসারে বেতুকান্দিতে আর শিলচরে এই জলবন্দী হওয়ার ঘটনা বাৎসরিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বেতুকান্দির জলবন্দী মানুষেরা তাদের নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় বহুবার প্রশাসনের কাছে দরবার করলেও সমস্যার কোন স্থায়ী সমাধানের আগ্রহ দেখা যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই বাধগুলোর অবস্থা খুউবই খারাপ, যথোপযুক্ত সেচ সংস্কার ছাড়া শিলচর-বন্যার সমাধান সম্ভব নয়।
এমনকি হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও এই ঘটনার ক্ষেত্রে কোন সাম্প্রদায়িক দিক থাকার কথা অস্বীকার করেন। এরপরেও বিজেপির ওবিসি মোর্চার জাতীয় সোশ্যাল মিডিয়া ইনচার্জ রাহুল নাগার থেকে গোদি মিডিয়ার তাবড় “সাংবাদিকরা” জাতীয় স্তরে এমন ঘৃণ্য প্রচার নিরন্তর চালিয়ে গেছে কারণ উত্তর-সত্যের প্রতিষ্ঠা না হলে সত্যের হত্যা সম্ভব নয়, প্রতিরোধী কন্ঠস্বর ও মানুষের সমস্যাকে ধর্মের মোহে ঢেকে রাখতে পারলেই শোষণ বজার রাখা সম্ভব।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে - সরিৎ মজুমদার