Site icon CPI(M)

As You Like It! A Report

SSC Scam WB

জয়দীপ মুখার্জী

এখনও পর্যন্ত উদ্ধার নগদ ৫০,৩৬,০০,০০০ টাকা ! 

হ্যাঁ, ৫০ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা। তৃণমূল কংগ্রেসের সদ্য ছাঁটাই মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জীর ঘনিষ্ট বান্ধবীর দুটি ফ্ল্যাটে ইডি–র তল্লাশির ফলশ্রুতি। সেইসঙ্গে কয়েক কেজি সোনার বিস্কুট, গয়না, রূপোর কয়েন, বিদেশী মূদ্রা মিলিয়ে বাজেয়াপ্ত আনুমানিক আরও ১০,০০,০০,০০০ টাকার (১০ কোটি) সামগ্রী। পাওয়া গেছে রাশি রাশি ধন সম্পত্তির হদিশ। নামে-বেনামে জমি, বাড়ি, বাগান বাড়ি, রিসর্ট, ফ্ল্যাট, স্কুল, কোম্পানি কিনে বিনিয়োগ করা লুটের আরও কোটি কোটি টাকা সম্পত্তির দলিল। জিজ্ঞাসাবাদে ওই ফ্ল্যাটদুটির মালকিন নাকি স্বীকার করেছেন উদ্ধার হওয়া টাকা, সোনা, সম্পত্তি সবকিছুরই মালিক আসলে মন্ত্রী স্বয়ং। তাঁকে ব্যবহার করা হয়েছে।

এককথায় বেনজির ঘটনা। সাম্প্রতিক কালে দেশের কোথাও তল্লাশি চালিয়ে এমন বিশাল অঙ্কের লুটের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার নজির নেই। এই ঘটনায় নোট গুনতে আসা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক আধিকারিক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন তাঁর দীর্ঘ তিরিশ বছরের কর্মজীবনে একসঙ্গে এতো নগদ টাকা গোনা তো দূরের কথা, চোখেই কখনও দেখেননি। 

ইডি–র অনুমান মন্ত্রীর অবৈধ সম্পত্তির এখানেই শেষ নয়। লুটের পরিমাণ আরও অনেক। তদন্তে নেমে মন্ত্রীর আরও বেশকিছু স্বর্ণসন্ধানী নারী সংসর্গের সন্ধান মিলেছে। তাঁদের অধিকাংশ শিক্ষা দপ্তরের অধীন বিভিন্ন পদে  নিয়োজিত। স্ব-ক্ষেত্রে তাঁদের পেশাগত আচম্বিত উল্লম্ফনও এখন তদন্তের আওতায়। আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন তাঁদের বিপুল সম্পত্তির উৎসের সন্ধানও খতিয়ে দেখা চলছে। তদন্তকারী সংস্থার সন্দেহ লুটের টাকা সরাতে মন্ত্রী এঁদেরও ব্যবহার করে থাকতে পারেন। তাঁদের অনুমান শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন কেবলমাত্র এসএসসি-র শিক্ষক নিয়োগে প্রতারণা থেকেই পার্থ চ্যাটার্জী ১২০-১৩০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। সুতরাং ঘুষের আরও টাকা লুকনো আছে, নাকি দলীয় রীতি মেনে ২৫:৭৫ (২৫ ভাগ নিজের বাকি ৭৫ ভাগ দলের সুপ্রিমোর) অনুপাতে বাটোয়ারা হয়ে গেছে, হদিশ পাওয়া এখনও বাকি। এখানে লক্ষ্য রাখার বিষয় ২৮ জুলাই, ২০২২, পর্যন্ত পার্থ বাবু শিল্প, শিল্প-বাণিজ্য, তথ্য-প্রযুক্তি ও বৈদ্যুতিন শিল্প, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, শিল্প পুনর্গঠন এবং পরিষদীয় দপ্তরের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। তদন্তের আওতাধীন না হলেও উল্লেখিত প্রতিটি দপ্তর নিয়েই বেআইনি লেনদেনের অভিযোগ বিস্তর। অতএব কোন টাকা যে কোথায় মিশেছে তা নিয়ে যেমন ধন্দ আছে, তেমনই এর পরিমাণ যে পাহাড় প্রমাণ তা সহজেই অনুমেয়।

প্রত্যাশা মতোই মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জী ঘটনার পাঁচ দিনের মধ্যেই পার্থ বাবুকে পদ থেকে ছাঁটাই করে হাত মুছে ফেলার প্রক্রিয়ায় নেমেছেন। ভাবখানা এমন যে এসবের বিন্দুবিসর্গ তিনি জানতেন না। কে না জানেন দলের মধ্যে তাঁর আস্থাভাজন গুটিকয় নেতা-নেত্রীর মধ্যে অন্যতম পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সুকৌশলে ভ্রাতুষ্পুত্র সাংসদ তাঁর ঘোষিত উত্তরসূরি অভিষেক ব্যানার্জীকে এগিয়ে দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে ছাঁটাই ঘোষণার কাজটি সেরেছেন। এক ঢিলে দুই পাখি মারার বস্তাপচা কায়দা। কাটমানি, তোলা, ঘুষের পঙ্কিল গদ সেঁটে আছে তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ডে। সোনা-কয়লা-গরু পাচার, পুলিশের তোলা আদায়, থানার মাসোহারা, ট্রান্সফার-পোস্টিং, পাথর খাদান, বালি-মাটি কাটা, শিল্প-আবাসন প্রকল্পের জমি কেনা-বেচা, ছোটো-মাঝারি শিল্প গঠনের সেলামী, সরকারি-আধা সরকারি-বেসরকারি আবাসন নির্মাণ প্রকল্প, নীল-সাদা রঙ্গের জোগান, আবগারি পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, বিনোদন জগত, দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাটমানি তোলা আদায়ের ৭৫ ভাগ, তালিকার অন্ত নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা বেআইনি লেনদেনের আয় ভোগী এবং ‘স্যুটকেস’ কোম্পানি মারফত হাওয়ালায় দেশের বাইরে পাচার হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নানা  দেশে ব্যবসায় সেই টাকা বিনিয়োগ করার অভিযোগে প্রধান অভিযুক্তের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার আপ্রাণ চেষ্টা। পাশাপাশি, তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দেওয়া।

পার্থ চ্যাটার্জীকে একঘরে করে দিয়ে সারদা-নারদা সহ একাধিক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দলের বাকি নেতা মন্ত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টায় মমতা ব্যানার্জী কতটা সফল হবেন সেটা সময় বলবে। বাজারি মিডিয়ার একাংশ ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর ন্যারেটিভে খবর পরিবেশনের পথ নিতে শুরু করেছে। সৌজন্যে সরকারি বিজ্ঞাপন। ইডি–র তল্লাশি, বাথরুমের দেওয়ালে লুকনো ওয়াড্রবে নগদ গচ্ছিত টাকার বান্ডিলের মাপ, বাড়ির নিচে বাঙ্কার, মিনি ব্যাঙ্ক, পার্থ চ্যাটার্জীর নারীসঙ্গ, বিবিধ  খেলনা  উদ্ধার, খবর পরিবেশন ঠিক যেন সোপ অপেরার একেকটি রোমহর্ষক এপিসোড। মন্ত্রীর কীর্তি কলাপকে যতটা পারা যায় তৃণমূল কংগ্রেস দল এবং দলের শীর্ষ নেতাদের সংস্রব থেকে বিযুক্ত করে দেখানো। এই বিপুল দুর্নীতির অভিঘাত কে খাটো করে ব্যক্তির চরিত্র হনন। সর্বোপরি, সরকারি প্রসাদ ভূক্ত এবং প্রত্যাশী বিদ্বজ্জনদের অটল নীরবতা!

বস্তুতপক্ষে, ইডি–র তল্লাশিতে যতটুকু সত্য সামনে এসেছে তা তৃণমূল কংগ্রেস দলের এরাজ্যে ১১ বছরের শাসনকালে সার্বিক দুর্নীতির কনা মাত্র। বলা যায়, হিমশৈলর চূড়ামাত্র প্রত্যক্ষ করা গেছে। দুর্নীতির হিমশৈলটি ঢাকা রয়েছে দেশের শাসক দল বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক বোঝাপড়া, চালু কথায় সেটিংয়ের আড়ালে। যার নেপথ্যে আরএসএস, এরাজ্যের শাসক দল তাদের অপশন-বি এবং বাম গণতান্ত্রিক শক্তি তাদের ঘোষিত শত্রু। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক এক্ষেত্রে তবে ব্যতিক্রম হলো কেন। মনে রাখতে হবে, এসএসসি নিয়োগ নিয়ে সিবিআই তদন্তটি হচ্ছে শীর্ষ আদালতের নির্দেশে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো, বোঝাপড়ার সুযোগ কম। বাকি ক্ষেত্রগুলোতে এমন ব্যবস্থা করা গেলে না জানি কী ভয়াবহ চিত্র সামনে আসতো। পুঁজিবাদী কাঠামোয় ঘুষ, কাটমানি, দুর্নীতি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পুলিশ-প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে, প্রভাবশালীর সৌজন্যে, আইনের ফাঁক গলে অতীতেও ঘুষ, কাটমানি, তোলাবাজির ভুড়ি ভুড়ি  নজির রয়েছে। কিন্তু গত ১১ বছরে তৃণমূল কংগ্রেস গোটা সিস্টেমে দুর্নীতি-স্বজনপোষণ’কে এরাজ্যে পঞ্চায়েত থেকে নবান্ন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। সরকারি আমলাতন্ত্রের একটা  অংশ, আইপিএসদের একাংশ, পঞ্চায়েত-পৌরসভার কর্মীদের একাংশ এই র‍্যাকেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। মুখ্যমন্ত্রী খোদ তাদের পেশাগত সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছেন। সরকার এবং প্রশাসন দুর্নীতির কারবারি প্রভাবশালী ও পদাধিকারীদের যাবতীয় কূকর্মকে আড়াল করছে। সরকারি পরিষেবার সমস্ত স্তরে এর জাল বিস্তার করেছে। একশো দিনের কাজের টাকা, বন্যার ত্রাণ বিলি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি তো শুধু সরকারি দলের কেষ্টু-বিষ্টুদের পকেট ভারি করেনি, একইসঙ্গে অচেতন ভাবে অনেক উপভোক্তাকেও এর অংশীদার করেছে। কাজ না করে, শ্রম না দিয়ে টাকা উপার্জন অথবা, ঘুষের বিনিময়ে কাজ হাসিলের বাধ্য বাধকতা তাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির এই প্রাতিষ্ঠানিকতা গোটা সমাজকে কলুষিত করছে। দুর্বল করছে মূল্যবোধ এবং প্রতিবাদের মেরুদণ্ডকে। গত একদশকে এটাই রাজ্যের রূপান্তর, কাঙ্খিত ‘পরিবর্তন’!

কী ছিল এক দশক আগের চিত্র? বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের অথবা, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা তো দূরের কথা, আলোচনায় কখনও এসেছে? কেউ কখনও ভেবেছেন মন্ত্রীর গুপ্তধন লুকনো আছে বেনামে অন্য কারো জিম্মায়! চলতি শতকের প্রথম দশকে কী ছিল রাজ্যের আমজনতার চর্চার কেন্দ্রে? মানুষের আলোচনা ছিল, কৃষির সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের বিকাশ হবে কিনা? শিল্পের জন্য জমি আসবে কোথা থেকে? কৃষি জমি শিল্পের জন্য অধিগ্রহণ হলে ক্ষতিপূরণের মাপকাঠি কি হবে? জমি হারানোদের আয়ের কী বন্দোবস্ত? বিকল্প পেশা কী হবে? নানা আলোচনা। পক্ষে, বিপক্ষে জোরালো বিতর্ক। পাড়ার রোয়াক, মোড়ের চায়ের দোকান, অফিস ক্যান্টিন, বাস-ট্রেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আলোচনায় সরগরম। বেকার সমস্যা, রুজি-রুটির সুযোগ, বিকাশের সূচকে দেশের মধ্যে রাজ্যের অবস্থান, এসবই তো ছিল চর্চার কেন্দ্রে। পুঁজিবাদের বিকাশের স্তরে বিকল্প পথের সন্ধান। বিতর্কের উপাদান আজও অপ্রাসঙ্গিক নয়। অনেক প্রশ্নেরই মীমাংসা হওয়া এখনও বাকি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণপন্থার রাস্তাকে প্রশস্ত করেছে। নয়া উদারবাদের হাত ধরে এরাজ্যেও শেকড় বিস্তার করেছে ধান্দার ধনতন্ত্র (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম)। অতিমারীর কালে ২০২১ সালে ক্ষুধার সূচকে বিশ্বের ১১৬ টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান যখন একধাপ নেমে ১০১ তম, তখন কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ্‌’দের পৃষ্ঠপোষকতায় গৌতম আদানির বিশ্বের ধনকুবেরদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে উত্থান যেমন ধান্দার ধনতন্ত্রের একটি কুৎসিত ফলশ্রুতি। তেমনই এরাজ্যে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এর আরেকটি কদর্য দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম রাখার লক্ষ্যে এরা পরস্পরের পরিপূরক। আবার লগ্নীকৃত পুঁজির সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের পথকে সুগম করার নীতি রূপায়নে একে অপরের সম্পুরক।

আরএসএস-এর তত্ত্বাবধানে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসকদলের এই রাজনৈতিক বোঝাপড়া’কে চূর্ণ করেই এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

শেয়ার করুন