Site icon CPI(M)

Appalling Job Scenario in the Modi-Mamata Regime – Part 2 : Abhas Roychoudhury

অপরিকল্পিত লকডাউনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অর্থনীতির চাকা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ২৭.১ শতাংশ কাজ হারিয়েছিল অন্তত ১৪ কোটি দেশবাসী। কুড়ি থেকে ত্রিশ বছর বয়সীদের মধ্যে ২.৭ কোটি কাজ হারিয়েছিল। এই সময়কালে ৮৪ শতাংশ ভারতীয় পরিবারের আয় কমেছে। এমনিতেই ভারতবর্ষের বিকাশের হার গত জানুয়ারি মাস থেকে নিম্নমুখী ছিল। করোনা অতিমারীর প্রভাবে ভারতের জিডিপি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক প্রকাশিত শ্বেতপ‍‌ত্রে বলা হয়েছে যে কোভিড-১৯ এর ফলে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ১৪.৮৮ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হবে যার বিপুল প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলিতে। প‍‌ড়েছেও। এগুলি  হলো বস্ত্রশিল্প, অটোমোবাইল শিল্প, বিমান ও পর্যটন শিল্পে, খুচরো ব্যবসা, নির্মাণ ক্ষেত্র, ক্ষুদ্র-ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ, ম্যানুফ্যাকচারিং ইত্যাদি। মানুষের হাতে অর্থ নেই, ব্যবসা বাণিজ্য মন্দার কবলে।

আনলক এর প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর কিছু কাজের সুযোগ সৃষ্টি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। দেশের জিডিপির সিংহভাগ যে রাজ্যগুলি থেকে আসে সেই মহারাষ্ট্রে, তামিলনাড়ু, গুজরাট, কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের মাত্র ৭ শতাংশ জেলাতেও পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু হয়নি। কৃষিক্ষেত্রে খারিফ মরসুম শুরু হওয়ায় এবং ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু হওয়ায় গ্রামাঞ্চলে কিছুটা কাজের সুযোগ সৃষ্টি হলেও শহরে বেকারত্বের হার যথেষ্ট উদ্বেগজনক। লকডাউন এর আগে বেকারীর হার ছিল ৮.৭৫ শতাংশ, শহরাঞ্চলে এখন বেকারের হার ১১.২ শতাংশ। সিএমআইই-র রিপোর্ট অনুযায়ী কাজ হারানো ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশ ছোট ব্যবসায়ী ও শ্রমিক। আন্তর্জাতিক ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট ফার্ম আর্থার ডি. লিটলের রিপোর্ট অনুযায়ী করোনা অতিমারীর জন্য কর্মসংস্থানের যে ভয়ঙ্কর সঙ্কট দেখা দিয়েছে তার দরুণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত। এই রিপোর্ট অনুযায়ী ১৩.৫ কোটি মানুষরে কাজ পুরোপুরি চলে যাবে এবং ১২ কোটি মানুষ দরিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। এসময় দেশের অর্থনী‍‌তিতে প্রধানতম সমস্যা চাহিদার ব্যাপক সঙ্কোচন। এখন সরকারি উদ্যোগে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটবে এবং পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং সরকারি দপ্তরে নতুন নিয়োগের বদলে কর্মী সঙ্কোচন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিপিসিএল এর মত নবরত্ন সংস্থায় বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণের প্রকল্প চালু হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলি যখন লাগামহীন ছাঁটাই এবং বেতনহ্রাসের পন্থা নিয়েছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার মৌন সম্মতি জানাচ্ছে। করোনা অতিমারী স্বাস্থ্য সঙ্কট থেকে সামগ্রিক মানবিক সঙ্কটে পরিণত হয়েছে সরকারের ব্যর্থতা এবং উদাসীনতার জন্য।

সামগ্রিকভাবে করোনা অতিমারী দেশের মহিলাদের উপরে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিকতম সমীক্ষায় প্রকাশ যে এই সময় মহিলারা পুরুষদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি কর্মহীনতার শিকার হয়েছেন। গত এপ্রিল মাসে মহিলাদের কর্মসংস্থান ছিল লকডাউন পূর্ববর্তী অবস্থার বার্ষিক বছরের ৬১ শতাংশ পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ছিল ৭১ শতাংশ। চতুর্থাংশ সেরকম মহিলা কর্মরত তার ওপর ভারতে মহিলারা গড়ে পুরষদের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম আয় করেন, গোটা বিশ্বে এই হার ১৬ শতাংশ। লকডাউন ঘোষণার পর এই লিঙ্গবৈষম্য আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময় মহিলাদের গার্হস্থ্য শ্রমের চাপ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অক্সফাম রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ সালের এপ্রিলেই ১ কোটি ৭০ লক্ষ মহিলা কাজ হারিয়েছেন। মেয়েরা হারানো কাজ ফিরে পাচ্ছে পুরুষদের তুলনায় কম। আইসিডিএস, আশা কর্মীদের কাজের বোঝা লকডাউনে প্রচণ্ড বেড়েছে, মজুরি বাড়েনি। এই রিপোর্ট অনুসারে ভারতের ১১জন বিলিওনেয়াররের সম্পত্তির ওপর মাত্র ১ শতাংশ কর বাড়ালে দেশের ৯ লক্ষ আশাকর্মীদের গড় মজুরি ৫ বছরের জন্য নিশ্চিত করা যায়।

কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্যাকেজে কিংবা ২০২১ বাজেটে মহিলাদের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি যা তাদের অন্ধকারে আলোর দিশা দেখাতে পারে। কমানো হয়েছে বাজেট বরাদ্দ। বাজেটে ‘রেগা’ প্রকল্প সম্পূর্ণ উপেক্ষিত, অথচ গ্রামীণ ভারতের সব পরিবারের কাছে ‘রেগা’ ন্যূনতম প্রাণশক্তি। বাজেট বরাদ্দে মারাত্মকভাবে ছাঁটাই হয়েছে, তেমনিই খাদ্য ভরতুকিও।

(ক) আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ৪৩ লক্ষ মানুষ কর্মরত। ৩০ বছরের নিচের কর্মীরা এই সময়ে ব্যাপক সংখ্যায় কাজ হারিয়েছে। ২০১৯-২০ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে এই বয়সী কর্মীদের সংখ্যা ছিল মোট কর্মীর ২০.৯ শতাংশ, গত এপ্রিল মাসে তা কমে হয়েছে ১৮.৮ শতাংশ। এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বেশি কাজ হারিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সংস্থাগুলোর আয় কমেছে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। আইবিএম, কগনিজেন্টের মতো বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাসহ ছোটো, মাঝারি সব ধরনের সংস্থাই কর্মী ছাঁটাই করেছে। আইটি, বিপিও মিলিয়ে গত জুন মাস পর্যন্ত ৩০ হাজার জনের কাজ গিয়েছে, ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার জনকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। যারা কর্মরত তাদের কাজের সময় বেড়েছে, অথচ মাইনে কমেছে।
(খ) করোনা পরিস্থিতি লক্ষ লক্ষ পরিবহণ কর্মীর কাজ কেড়ে নিয়েছে। যারা বাসের ড্রাইভার, খালাসি অথবা ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনে চালান কিংবা ভাড়ায় গাড়ি চালাচ্ছেন তাদের মধ্যে পনেরো থেকে কুড়ি লক্ষ কাজ হারিয়েছেন, আরও তিরিশ থেকে চল্লিশ লক্ষ পরিবহণ কর্মীর কাজ চলে যাওয়ার মুখে। এই হিসেব দিয়েছে বাস অ্যান্ড কার অপারেটরস কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়া। সেপ্টেম্বর মাস থেকে ঋণের ইএমআই জমা নেওয়া শুরু হলে পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হয়। পেট্রোল-ডিজেলের লাগাতার লাফিয়ে লাফিয়ে মূল্যবৃদ্ধি, একটানা লকডাউন, থমকে যাওয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একত্রে পরিবহণ শিল্পে, কৃষি ও অসংগঠিত শিল্পে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে। এমনকি এসময়ে অসমারিক বিমান চলাচল ভীষণ ব্যাহত হয়েছে যার সরাসরি কোপ পড়েছে কর্মীদের ওপর। বিমান পরিবহণের সাথে যুক্ত চার লক্ষ কর্মী এসময়কালে কাজ হারিয়েছেন। সরকারি নির্বিকারত্বও বেড়ে চলেছে সমানহারে।
(গ) গত দশ মাসে অত্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে হোটেল ও পর্যটন ব্যবসা। আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রে সরাসরি যুক্ত সাড়ে চার কোটি মানুষ। হোটেল অ্যাসোসিয়েশনে অব ইন্ডিয়ার বক্তব্য যে করোনা অতিমারীর জন্য এই ক্ষেত্রের সাথে সরাসরি যুক্ত সাড়ে চার কোটি ও তাদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে অন্তত ষোল কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম ৯০ হাজার কোটি টাকা। যেহেতু ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ব্যবসা হচ্ছে তাই অধিকাংশ কর্মী এখনও কর্মহীন বা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
(ঘ) এই সময়কালে খুচরো ব্যবসায়ী এবং হকাররা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় খুচরো ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অন্যদিকে যানবাহন বিশেষত ট্রেন না চলার দরুণ হকারদের একটা বড় অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এদের অধিকাংশই ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে কোনোমতে অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত আছেন। অসংগঠিত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিযুক্ত ১২.২০ কোটি মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। এদের ঘরে বসে কাজের সুযোগ নেই, অনেকেই অস্থায়ী শ্রমিক। অক্সফাম রিপোর্টে বলা হয়েছে এদের বেশিরভাগ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত।
(ঙ) লকডাউনের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত মাঝারি, ছোট ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ (এমএসএমই)। আমাদের দেশে এরকম ৬.৩৪ কোটি সংস্থা রয়েছে যেখানে কর্মরত মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ কোটি। কর্মরতদের ৬৬% তফসিলি জাতি, আদিবাসী, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত। এপ্রিল মাসে কোটাক মাহিন্দ্রার একটি সমীক্ষা অনুযায়ী মাত্র ৭% মানুষ জানিয়েছিল যে তাদের হাতে তিন মাসের বেশি চালানোর মতো অর্থ আছে অর্থাৎ ৯৩% মানুষ তখনই প্রবল অর্থসঙ্কটে ভুগছিল। আজ লকডাউনের প্রায় পাঁচ মাস পরে তাদের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। সম্প্রতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প সমিতি তিন‍‌টি সংস্থার সহযোগিতায় যে সমীক্ষা করেছে সেই রিপোর্ট অনুযায়ী এ‍‌ই সংস্থাগুলির সঙ্গে যুক্ত আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ জুন মাসের মধ্যেই কাজ হারিয়েছেন। আরও এক থেকে দেড় কোটি মানুষের কাজ চলে যাওয়ার মুখে কিংবা নামমাত্র মজুরিতে কাজে যোগ দিচ্ছেন। কার্যত অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখোমুখি এই ক্ষেত্র। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তিন লাখ টাকার ঋণের সুবিধা প্রয়োজনের মাত্র ১৯% পূরণ করতে পেরেছে। সমীক্ষায় প্রকাশ ৬১% মানুষের বক্তব্য এই যে সেপ্টেম্বর মাস থেকে তারা ঋণের কিস্তি দিতে পারছে না। ৩৭% মানুষের আরও ছ’মাস এবং ৩২% আরও এক বছর ছাড় চাইছে। কর্পোরেট সংস্থা ও সরকারের কাছে এদের যা প্রাপ্য তা এখনো না পাওয়ায় সঙ্কট আরও বাড়ছে। বাজেটে এদের সহায়তা করার নামগন্ধ নেই।

লকডাউনের ফলে যখন বিরাট অংশের মানুষ নিরন্ন, কর্মহীন তখন তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে আমাদের দেশের ও রাজ্যের সরকার ভূমিকা পালন করেনি। আমাদের রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘোষণা করে দিলেও কার্যত এখানে রেশনে বরাদ্দ কমছে। আরকেএসওয়াই-২ কার্ডের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটছে।

কেন্দ্রীয় সরকার ১৮ মার্চ বলেছিল যে দেশের ৭৫ কোটি রেশন উপভোক্তা দু’মাসের রেশন একসাথে তুলে নিতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে কি হয়েছে তা সকলে জানেন। দেশের খাদ্য ভাণ্ডার কার্যত উপচে পড়ছে। ন্যূনতম যে পরিমাণ খাদ্যশস্য রাখা জরুরি তার তিনগুণ মজুত থাকলেও গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে না। গুরগাঁও-এর মুকেশের মতো নিজের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন অনেকেই। কিছু ঘটনা সংবাদপত্রে ঠাঁই পাচ্ছে, অধিকাংশই চলে যাচ্ছে নজরের আড়ালে। ভারতবর্ষের মানুষের হাতে এখন কাজ নেই, ক্ষুধা সর্বগ্রাসী চেহারা ধারণ করছে। যদি সরকার সচেতন না হয় তাহলে অচিরেই ভারতবর্ষে করোনার চেয়েও অনেক বেশি লোক শুধু না খেতে পেয়ে মারা যাবে।

…চলবে

শেয়ার করুন