২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রথম পর্ব
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালী জাতীয়তা বোধের অঙ্কুরোদগমের দিন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনা বাঙালীর মনে সুপ্ত ছিল। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে ফিরেছে বাঙালীর কবিতা, গানে, সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমের প্রকাশে। এমনকি যখন বৃটিশ-কংগ্রেস-লীগ মিলে ভারত ভাগ করে ফেলছে, তখন উভয় দলের হিন্দু-মুসলিম নেতারা মিলে বাঙালী জাতিসত্তা ভিত্তিক অঞ্চলের একটি প্রস্তাব নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়কার সাম্প্রদায়িক আবহ ও কংগ্রেস-মুসলিম লীগ উভয় দলের নেতৃত্বের কুটিল রাজনৈতিক স্বার্থে অচিরেই তার ইতি ঘটেছিল। কোন রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে আর এগুতে পারেনি। ভারত ভাগের কোপ বিশেষভাবে পড়েছিল বাঙলা ও পাঞ্জাবে। বাঙালীর স্বতন্ত্র পরিচয় বিলীন হয়ে গিয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানে। কিন্তু পাকিস্তান বাস্তব হিসাবে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে এলেও বাঙালী জাতীয়তার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা কখনও বিলীন হয়নি। আর এ কারণে যখন ভাষার প্রশ্ন এসেছে তখন তাদের এই সুপ্ত জাতীয়তাবোধের প্রকাশ ঘটেছে বাংলাকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষাতো বটেই, পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করার মধ্য দিয়ে।
॥২॥
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহম্মদ হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে ১৯৪৭ সনের জুলাই মাসে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। একে খন্ডন করে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক দৈনিক আজাদে এক প্রবন্ধ লিখে বলেন, “কংগ্রেসের নির্দিষ্ট এক হিন্দীর অনুকরণে-উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমণ হইবে।… যদি বিদেশি ভাষা বলিয়া ইংরেজি ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা কর্তব্য”। ড. শহীদুল্লাহর এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ বিতর্ক হলেও, রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বিতর্কটি নিয়ে আসে ছাত্র-যুবকরা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন বাস্তবতায় যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় যে পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (৬-৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭) সেখানে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আদালতের ভাষা করার প্রস্তাব নেয়া হয়। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। এর পরপরই ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু?’ এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে, যাতে বিভিন্ন গুনীজনের লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে তমদ্দুন মজলিশের ভাষাবিষয়ক এক প্রস্তাব সংযোজিত হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও সরকারি ভাষার পাশাপাশি বলা হয়, ‘পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দু’টি-উর্দু ও বাংলা’।
॥৩॥
কিন্তু তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি এত নির্দিষ্ট রূপ নিয়ে আসেনি। ইতিমধ্যে ১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের ‘লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করা হয়। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম কি হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রাদেশিক সরকার করবে বলে বলা হয়। করাচীর শিক্ষা সম্মেলনের এহেন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-যুবক, শিক্ষাবিদ, এমনকি সরকারি কর্মচারিদের মধ্যেও বিরোধিতা সৃষ্টি হয়। তেমনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষেও প্রচার চলে যেখানে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ অবশ্য ভাষার প্রশ্নে উর্দুকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৪৭-এর ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সংবিধান সভা সরকারি ভাষা হিসাবে উর্দু ও ইংরেজিকে সমমানের মর্যাদা দেয়ার সুপারিশ করে। তারা অবশ্য উল্লেখ করে, কোন সদস্য যদি ঐ দুই ভাষাতে কথা বলতে না পারেন তবে সভাপতির অনুমতি নিয়ে তার নিজের প্রাদেশিক ভাষায় বক্তৃতা করতে পারবেন।
॥ ৪ ॥
ইতিমধ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মানিঅর্ডার ফর্ম, ডাকটিকেট এবং মুদ্রায় শুধুমাত্র ইংরেজি ও উর্দু ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, সেটা এই অঞ্চলের জনমনে ক্ষোভ সঞ্চার করে। গণ-পরিষদ সভা আহুত হওয়ায় সে সময় এ সব বিষয় সংশোধন করা হবে বলে গণ পরিষদে যোগদানকারী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দেন ছাত্রদের। কিন্তু সে ধরণের কোন উদ্যোগ জানা যায় নি। ইতোমধ্যে ১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ অধিবেশন শুরু হলে অধিবেশনে দু’টি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর একটিতে বৎসরে অন্তত একবার ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠান, অপরটিতে উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপিত হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন কংগ্রেস দলীয় সদস্য কুমিল্লার প্রখ্যাত আইনজীবী শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ)। গণপরিষদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তীব্র ভাষায় এর বিরোধিতা করেন এবং প্রস্তাবকারীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি ও একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করে। গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যরাও এর বিরোধিতা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বক্তৃতা করেন এবং বলেন যে, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ লোক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতি।
॥ ৫॥
গণপরিষদে বাংলা ভাষার দাবি এভাবে অগ্রাহ্য হওয়ায় ছাত্র-যুব ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ’৪৮ ঢাকার ছাত্র সমাজ এর বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন করে। ঐ ধর্মঘটের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রসভায় ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠু সাংগঠনিক রূপ দিতে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয়। এই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গণপরিষদের সরকারি ভাষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানায়।
১৯৪৮-এর এই ১১ মার্চ থেকেই প্রকৃতপক্ষে সংগঠিতভাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় যা পরিণতি নেয় ১৯৫২-এর ভাষার দাবিতে জীবনদানের ঘটনায়। ১১ মার্চের এই সাধারণ ধর্মঘটে পিকেটিং থেকেই গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ ও অন্য অনেকে। এদিকে গ্রেপ্তার না হলেও পিকেটিংয়ে নেতৃত্বদান, পুলিশ ও কর্তৃপক্ষের সাথে যারা বাদানুবাদে লিপ্ত হন তারা হলেন মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরদার ফজলুল করিম। এরা সবাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্যবাদী আন্দোলন ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইতিহাসের এক একটি নাম।
॥ ৬॥
১১ মার্চের ধর্মঘটের পর পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের টনক নড়ে ও প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তিতে গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের মুক্তি ও পুলিশী নির্যাতনের তদন্তের পাশাপাশি যেটা মূলত স্বীকৃত হয় তা’হল এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং তাকে পাকিস্তান গণপরিষদের ও কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাদিতে উর্দুর সমমর্যাদা দেয়ার জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব করা হবে। প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হবে।
॥ ৭ ॥
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি হলেও ছাত্ররা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একদিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, অন্যদিকে মুসলিম লীগ বিশেষ করে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত মুসলিম লীগ নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে জিন্নাহর উপস্থিতি প্রয়োজন মনে করে তাকে আমন্ত্রণ জানান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আগমন করেন। বস্তুত জিন্নাহর ঢাকা আগমন ও রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন আরো সুুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। একুশে মার্চ ১৯৪৮ মহম্মদ আলি জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। তিনি আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের চরিত্র সম্পর্কে শ্রোতৃমন্ডলীকে সতর্ক করেন এবং পাকিস্তানে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা (বাঙালী, সিন্ধী, বালুচ, পাঠান, পাঞ্জাবী)-র বিরোধিতা করে বলেন, ‘আমরা সকলেই মুসলমান, এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার মানুষ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না। পাকিস্তানের অখন্ডতা ধ্বংস করতে বাইরে দ্বারা পরিচালিত।
রেসকোর্স ময়দানে তার বক্তৃতার ক্ষীণ কন্ঠে কিছু প্রতিবাদ হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে একই কথা পুনরুক্তি করলে ছাত্রদের মধ্য থেকে সুস্পষ্ট ‘নো’ ‘নো’ ধ্বনি উচ্চারিত হলে তিনি কিছুটা থমকে গিয়ে নিচুস্বরে তার বক্তৃতা শেষ করেন কিন্তু ভাষা নিয়ে আর কথা বলেন নি। তবে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে তিনি তার একই বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন।
ক্রমশ........
( রাশেদ খান মেনন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি , বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
(বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)