বিকল্পের লক্ষ্যে - শান্তনু দে....

১৪ ডিসেম্বর,২০২০ রবিবার

বিকল্পের ৩৪

সাতাত্তরের সাতগাছিয়া।

নির্বাচনের দু’দিন আগে, মার্কিন পাঠকের কাছে সাতগাছিয়াকে চেনাতে টাইমসের প্রতিবেদক কস্তুরি রঙ্গন লিখছেন: ‘কলকাতা থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে, একটি উর্বর ব-দ্বীপ অঞ্চলের জেলা শহর, যার অর্থ ‘সাতটি গাছের বাগান’। এমন উর্বরতা সত্ত্বেও, জেলাজুড়ে শুধু দারিদ্র আর বেকারি— আর মার্কসবাদ।

‘প্রতি চারজনে একজনের কাজ নেই। শ্রমিক এবং উৎপাদনের সমস্যার কারণে জেলায় পাঁচটি চটকলের ঝাঁপ বন্ধ থাকে প্রায়শই, আর তার অনিবার্য পরিণতি ছাঁটাই। বিপুল সংখ্যায় উদ্বৃত্ত খেতমজুর, খুব কমই সারা বছর কাজ পান। চাষ হয় একেবারে আদিম প্রক্রিয়ায়, কোথাও নেই সেচের ব্যবস্থা। টিউবঅয়েল যা দেখা যায় দেশের সর্বত্র, নেই এখানে।’

সেদিনই এমনই ছিল রাজ্যের ছবি। দারিদ্র, আর বেকারির হাহাকার। বন্ধ কারখানা। কৃষির আদিম চেহারা। যেমন টাইমসের প্রতিবেদক কস্তুরিকে সেদিন বলেছিলেন কৃষক সত্যচরণ মণ্ডল, তাঁর ‘দশজনের পরিবার, কিন্তু বছরে কাজ পান মেরেকেটে চার-মাস।’ যেমন বলেছিলেন চটকল শ্রমিক পুরুষ চন্দ্র সামন্ত, ‘তিন-মাস ধরে কোনও কাজ নেই’।

গ্রামীন দারিদ্রে, দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে শীর্ষে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। সার্বিক দারিদ্রের হারে দ্বিতীয়। যোজনা কমিশনের একাদশ পরিকল্পনায় (ভলিউম-৩, পৃষ্ঠা ১০০-১০১) তার অকপট স্বীকারোক্তি: ১৯৭৩-৭৪, গ্রামীন দারিদ্রের হার ছিল ৭৩.২ শতাংশ। সমস্ত রাজ্যের মধ্যে শীর্ষে, এমনকি ওড়িশারও পিছনে (৬৭.২৮ শতাংশ)। যেখানে গ্রামীন দারিদ্রে জাতীয় গড়ছিল ৫৬.৪ শতাংশ।

সাতাত্তর, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার। এখান থেকেই পরিবর্তন। উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে, আরও নির্দিষ্টভাবে, গ্রামোন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বিকল্প নীতি। ভূমি সংস্কার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত।



এই বিকল্প নীতিতে উন্নয়নের লক্ষ্য শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি নয়। এমনভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি, যাতে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান ও আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। উন্নত করা যায় তাঁদের মর্যাদা। শুরু হয় রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির ভারসাম্য তাঁদের অনুকূলে আসার প্রক্রিয়া।

সারা দেশে জমির মাত্র ৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে। অথচ, গোটা দেশে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে জমি বন্টনের ২২ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গে। ভূমি সংস্কারের ফলেই রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪ শতাংশ কৃষি জমির মালিক। জাতীয় স্তরে যা ৩৪ শতাংশের সামান্য বেশি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে ৩০ লক্ষের বেশি কৃষক পেয়েছেন ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একরেরও বেশি জমি।

পাট্টা প্রাপকদের প্রায় ৩৭ শতাংশ তফসিলি জাতিভূক্ত, ১৮ শতাংশ আদিবাসী এবং ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। পাট্টা পেয়ে জমির মালিক কৃষক পরিবারের মহিলারাও। নারী-পুরুষ যৌথ পাট্টা। শুধুমাত্র মহিলারা পাট্টা পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি। জমির পাট্টা বিলি চলেছে ধারাবাহিকভাবে। এমনকি, সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলেও। ২০০৬-১০, এই সময়ে ১৬ হাজার ৭০০ একর জমির পাট্টা বিলি হয়।

বামফ্রন্ট সরকার মানে অপারেশন বর্গা। ১৫ লক্ষ ১৩ হাজার নথিভূক্ত বর্গাদারের আইনী অধিকার। বর্গা উচ্ছেদ আটকাতে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরেই ভূমি সংস্কার আইনের সংশোধন করে বামফ্রন্ট সরকার। শুধু গ্রাম নয়। শহরেও গরির মানুষকে বসবাসের জমি দিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ। উদ্বাস্তুদের নি:শর্ত জমি প্রদান। ঠিকা প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন, কুড়ি বছরের উপর সরকারি জমিতে বসবাসকারীদের মাত্র ১ টাকায় ৯৯ বছরের লিজ।

নিট ফল: ২০০৪-০৫, রাজ্যে গ্রামীন দারিদ্রের হার নেমে আসে ২৮.৬ শতাংশে। সার্বিক দারিদ্রের হার এই সময়ে ৬৩.৪ শতাংশ থেকে কমে হয় ২৪.৭ শতাংশ। যেখানে জাতীয় গড় ৫৪.৯ শতাংশ থেকে কমে হয় ২৭.৫ শতাংশ।

দারিদ্র হ্রাসে পিছিয়ে থেকে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (এনএসএসও)-র ৬৯ দফার প্রতিবেদন: ২০১০-১১, রাজ্যে গ্রামীন বাজারের আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২৯,০০০ কোটি টাকা।

একসময়ে খাদ্য শস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য পরিণত হয় উদ্বৃত্ব রাজ্যে। চাল উৎপাদনে প্রথম। সবজি উৎপাদনে প্রথম। আলুতে দ্বিতীয়। দেশের মোট খাদ্যশস্যের ৮ শতাংশ উৎপাদন হতে থাকে এরাজ্যে। যদিও দেশে মোট কৃষিজমির মাত্র ৩ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে। নেপথ্যে ছিল সেচের প্রসার, কৃষির বৈচিত্র্য, একফসলি জমিকে দু’ফসলি, তিনফসলি করার পরিকল্পিত উদ্যোগ।

বামফ্রন্টের সময় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত। গ্রামের সরকার। গ্রাম সংসদ। ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের আগেই। পঞ্চায়েতে নিয়মিত নির্বাচন। সরকারি খরচের প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থ খরচ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ৩৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ। পঞ্চায়েত মানে গ্রামীণ গরিব মানুষের অধিকারবোধে পরিবর্তন। মর্যাদা। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় নেতৃত্বে দুর্বলতর মানুষের প্রতিনিধি।

সাক্ষরতায় অভূতপূর্ব সাফল্য। ১৯৭১ সালে রাজ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৮.৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশ। সর্বভারতীয় হারের চেয়ে অনেক বেশি। সাফল্যের স্বীকৃতি ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর বিখ্যাত ‘নোমা পুরস্কার’।

বামফ্রন্ট সরকার মানে শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অরাজকতার অবসান। অনেক বাধা ঠেলে স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা। শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করা। এবং গুণমান বৃদ্ধি। সবচেয়ে সাফল্য আসে প্রাথমিক শিক্ষায়। রাজ্যে ছয় থেকে দশ বছর বয়সী শিশু ৯৯.৬ শতাংশ স্কুলের আঙিনায়। মিড ডে মিলের আওতায় ৯৬ শতাংশ শিশু। দ্রুতহারে কমতে থাকে স্কুলছুটের সংখ্যাও। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার সুযোগ বাড়ে নজিরবিহীনভাবে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ২ লক্ষেরও কম ছাত্রছাত্রী। ২০১১ সালে তা বেড়ে সাড়ে ১০ লক্ষের মতো।



১৯৭৭, পশ্চিমবঙ্গে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৩২৬। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার। পরিবারকল্যাণ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা এই সময়ের মধ্যে বাড়ে প্রায় ১০ গুণ। রাজ্যে ৭৩ শতাংশ মানুষ আসতেন সরকারি হাসপাতালে। গোটা দেশে এই হার তখন ছিল ৪০ শতাংশের মতো। ফলে গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হারে পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল।

সত্তর দশকে এক নৈরাজ্য কাটিয়ে সাতাত্তর। রাজ্যে বামফ্রন্ট। একদিনে নয়। দশকের পর দশক ধরে শ্রেণিসংগ্রাম আর গণআন্দোলনের ফসল। আধা ফ্যাসিবাদী অত্যাচারের রক্তচিহ্ন সারা শরীরে বহন করে, বুকের মধ্যে চেপে রাখা স্বজন হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে সংগ্রাম আর সাফল্যে এক নতুন অধ্যায়। একটি সুশাসন। গ্রামে-শহরে সাধারণ মানুষের, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের মাথা তুলে দাঁড়ানোর অধিকার। এক নতুন পরিবেশ। এক অপ্রতিহত অগ্রগতির যুগের যাত্রা শুরু।

হিলারি ক্লিনটন ও মমতা ব্যানার্জী


দায়িত্বে এসেই প্রথম রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বন্দিদের বিনা শর্তে মুক্তি। অধিকাংশই ছিলেন নকশালপন্থীরা। যাদের হাতে বামপন্থী কর্মীরা খুন হয়েছিলেন, মুক্তি পেয়েছিলেন তাঁরাও। সমকালীন ভারতে এক সাহাসী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। বিনা বিচারের মতো বর্বর প্রথা রদ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পূরণের জন্য ব্যবহার করা হয়নি পুলিশকে। আগের কংগ্রেস জমানায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভাঙাই ছিল পুলিশের মুখ্য কাজ। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে মর্যাদা দেয় সরকার। পুলিশকে দেয় ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার। সরকারি কর্মীদের ধর্মঘট করতে দেওয়ার অধিকার। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ধর্মঘট ভাঙতে কখনও পুলিশ পাঠায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক কার্যকলাপকে কখনও পুলিশ, কিংবা প্রশাসনকে দিয়ে দমন করেনি। সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশই ছিল বিরোধী দলের ভূমিকায়। শেষদিন পর্যন্ত চালিয়ে গিয়েছে কুৎসা-অপপ্রচার। কিন্তু তাই বলে রাজ্য সরকার কখনও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। কট্টর সমালোচক সংবাদমাধ্যমও পেয়েছে সরকারি বিজ্ঞাপন। দেশের মধ্যে প্রথম, বামফ্রন্ট সরকারই রাজ্যস্তরে গড়েছে মানবাধিকার কমিশন।

বামফ্রন্ট সরকারের কি কোনও সমস্যা ছিল না?

ছিল। বহু সাফল্যের মধ্যেও সমস্যা ছিল। সীমাবদ্ধতা ছিল। একটি দেশের একটি অঙ্গরাজ্যে ক্ষমতায়। প্রতিটি চব্বিশ ঘণ্টা লড়তে হয়েছে সংবাদমাধ্যমের কুৎসা, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে। লড়তে হয়েছে দিল্লির নীতির বিরুদ্ধে। এমনকি ওয়াশিংটনের ব্লুপ্রিন্টের বিরুদ্ধে। নাহলে ২০১১-তে পরাজয়ের পর নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাতে ছুটে আসেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন।

সীমিত ক্ষমতায় এই ব্যবস্থার মধ্যেই ‘বিকল্প নীতি’ রূপায়ণ। ভূমি সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

২০০৬ সালের বিধানসভা ভাঙচুরের ছবিতে রয়েছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সহ তখনকার তৃণমূল ও এখনকার বিজেপির বেশকিছু নেতা....


সবার উপর ছিল মানুষের কথা বলার অধিকার। সরকারকে সমালোচনার গণতন্ত্র। ধর্মতলার ব্যস্ত রাস্তায় মাচা বেধে ছাব্বিশ দিন সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ। পুলিশ যায়নি। গণতন্ত্রের ‘মন্দির’ বিধানসভা ভাঙচুর। ভিডিও ফুটেজ থাকলেও কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। মাচা ভেঙে দিয়ে সিঙ্গুরে কারখানা করেনি। বিধানসভায় দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন থাকলেও, করেনি।

সেদিন এমনই ছিল গণতন্ত্র।

◆★ ◆★ ◆★ ◆★ ◆★ ◆★ ◆★ ◆★

অন্তিম পর্ব (পর্ব একাদশ ): বিকল্প নীতির লক্ষ্যে জরুরি,বিকল্প সরকার ....


শেয়ার করুন

উত্তর দিন