বিকল্পের লক্ষ্যে - শান্তনু দে

১৩ ডিসেম্বর ,২০২০ শনিবার

বিহারে আসলে জয়ী আমজনতার ইস্যু

বিহারে কেউ জেতেনি। জিতেছে আসলে জনজীবনের অ্যাজেন্ডা। জনগণের জলন্ত ইস্যু। রুটি-রুজি। কামাই, পধাই, দাওয়াই, সিচাই আউর মাহাঙ্গি। কাজ, শিক্ষা, ওষুধ, সেচ, মূল্যবৃদ্ধির জরুরি দাবি।

কোভিড সত্ত্বেও ভারতের প্রথম নির্বাচনে বেকারি, পরিযায়ী শ্রমিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষাই ছিল শিরোনাম। প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জোটের উভয়ের পক্ষেই সমর্থনের হার এক। ৩৭ শতাংশ। দশমিকে ধরলে, ভোট শতাংশের হিসেবে ব্যবধান মাত্র ০.০৩ শতাংশ। আর সংখ্যার হিসেবে, রাজ্যের ৩.১৪ কোটি ভোটারের মধ্যে মোদীর এনডিএ থেকে লালু-পুত্র তেজস্বীর ‘মহাগঠবন্ধন’ (মহাজোট) পিছিয়ে মাত্র ১২ হাজার ভোটে।

তেজস্বী যাদব { রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)।}


২৪৩-আসনের বিহার বিধানসভায় একক বৃহত্তম দল বিজেপি, কিংবা নীতিশ কুমারের জেডি(ইউ) নয়। তেজস্বী যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)। আসন সংখ্যা ৭৫, যেখানে বিজেপি জিতেছে ৭৪টি আসনে। একক দল হিসেবেও, সমর্থনের পাল্লা ভারি আরজেডি’র দিকে। ২৩.১ শতাংশ, যেখানে বিজেপি’র পক্ষে সাকুল্যে ১৯.৫ শতাংশ। জোটসঙ্গী জেডি(ইউ)-র আরও কম, ১৫.৪ শতাংশ।

সরকার গড়ার জন্য ‘ম্যাজিক ফিগার’ ১২২ থেকে মাত্র তিনটি আসন বেশি পেয়েছে এনডিএ। বিপরীতে, মহাজোট পেয়েছে ১১০টি আসন। তাক লাগিয়ে দেওয়া ফল করেছে মহাজোটের শরিক বামপন্থীরা। ২৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে ১৬টি আসনে। সিপিআই(এমএল-লিবারেশন) পেয়েছে ১২টি আসন। সিপিআই(এম) এবং সিপিআই জিতেছে দু’টি করে আসনে। বেড়েছে সমর্থনের হার। প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বামপন্থীরা চেয়েছিলেন ৫০টি আসন। দেওয়া হয়নি। বামপন্থীদের আরও আসন দেওয়া হলে হয়ে যেত মহাজোটের সরকার।

বিহারে বামপন্থীদের নির্বাচনী জনসভায় মানুষের ভিড় ছিল চোখে পরার মত ....২০২০


গত বছরের লোকসভা নির্বাচন, কিংবা পাঁচ বছর আগের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি’র সমর্থনের হার কমেছে ৪-৫ শতাংশ। কমেছে নীতিশের দলেরও। বেড়েছে আরজেডি’র। গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ৭.৭ শতাংশ।

তবু, মাত্র ৪৩টি আসনে জিতে (গতবার ছিল ৭১) আবার মুখ্যমন্ত্রী ‘বিহারের চাণক্য’ নীতিশ কুমার। আগামী পাঁচ-বছর যে বোঝা বইতে হবে বিজেপি-কে।

ছবি : google


পাটিগণিত জিতিয়ে দিলেও, এ আসলেই মোদী-নীতিশের রাজনৈতিক পরাজয়।

অথচ, একমাস আগেও কেউ ভাবেনি এমন ফল হবে। সলতে পাকানোর কাজ শুরু করেছিলেন বামপন্থীরাই। তৈরি করে দিয়েছেন বিকল্পের অ্যাজেন্ডা। জাতপাত, ধর্মের মেরুকরণ নয়। জনজীবনের ‘পরিবর্তনের জন্য প্রতিশ্রুতি’র ২৫-দফা সনদ। তুলে এনেছেন চাকরি, সম কাজে সম মজুরি, অধিকার এবং মর্যাদার প্রশ্ন। অচিরেই তা হয়ে উঠেছে মানুষের দাবি। গ্রাম-গঞ্জের চা-দোকান থেকে শহরের আড্ডার আলোচনার একমাত্র ইস্যু।

কুড়ি দিনে ২৪৭টি সমাবেশ করেছেন তেজস্বী। এর আগেও তেজস্বী সভা করেছেন। কিন্তু এমন উপচে পড়া ভিড, এমন স্বতস্ফূর্ততা দেখেননি।

স্বাভাবিক। বিহারে এই মুহূর্তে কর্মসংস্থানের হার মাত্র ৩৩.৮ শতাংশ। মানে প্রতি তিনজনের মধ্যে কাজ আছে একজনের। বাকি দু’জনই বেকার। সেপ্টেম্বর মাসের এই তথ্য শুনিয়েছে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)।

সেকারণে মহাজোট যখন, মুখ্যত শূন্য পড়ে থাকা সরকারী পদগুলি পূরণের মাধ্যমে ১০ লক্ষ চাকরি সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে মানুষের দাবি। আলোচনার অ্যাজেন্ডা। এনডিএ নেতারা বুঝে উঠতে পারেননি কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। সুশীল মোদী থেকে নীতিশ কুমার বিদ্রূপ করতে শুরু করেন। কিন্তু বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এর গুরুত্ব বোঝেন। দলের ইশতেহারের ১৯ লক্ষ কাজের প্রতিশ্রুতি দেন।

করোনা বেআব্রু করেছে পরিযায়ী শ্রমিকের সমস্যাকে। জুন মাসে শহরগুলি থেকে ৬৭ লক্ষ পরিযায়ী ফিরেছেন দেশের ছ’টি রাজ্যের ১১৬টি জেলায়। এর মধ্য ৪৪ লক্ষ, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ফিরেছেন ৫৩টি জেলায়। প্রথম ছয় রাজ্যের মধ্যে শীর্ষে নীতিশের রাজ্য। ২৩.৬ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ফিরেছেন বিহারের ৩২টি জেলায়। দ্বিতীয় উত্তর প্রদেশ, ১৪.৪৮ লক্ষ। অন্য একটি তথ্য বলছে, বিহারে ফেরা এই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৩২ লক্ষ। এই সংখ্যাকে গড়পরতা বিহারী পরিবার (৫.৫)-কে দিয়ে গুণ করলে দাঁড়ায় ১.৭৬ কোটি। বিহারের ১০.৩৭ কোটি জনসংখ্যার (সেনসাস ২০১১) প্রায় ১৭ শতাংশ।

চার ঘণ্টার নোটিশে মোদীর লকডাউন ঘোষণার সময় থেকে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রশ্নে নীতিশ ছিলেন নির্বিকার। ব্যালটে মানুষ সেই ক্ষোভ উগডে দিয়েছেন। এই সমস্যার জন্য তাঁরা মোদীর দিকে আঙুল তুললেও, মুখ্যত দায়ী করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। নীতিশ চওড়া রাস্তা করেছেন। পানি, ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু সেই রাস্তা গিয়ে মেশেনি শিল্পাঞ্চলে।

রক্তশূন্য কৃষি। গ্রাম-শহরের গরির খেতমজুর, বেকার যুবক তাই কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে।

বিহারে ২০২০ বিধান সভা নির্বাচনে তাক লাগিয়ে দেওয়া ফল করেছে মহাজোটের শরিক বামপন্থীরা। ২৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে ১৬টি আসনে।


বিজেপি-নীতিশের দেড় দশকে বিহারে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৩১,২৮৭ টাকা, জাতীয় গড়ের এক-তৃতীয়াশ। সাক্ষরতার হার নিচের দিক থেকে তিন-নম্বরে। ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে দেশের মধ্যে রাজ্যের অংশ মাত্র ১.৩ শতাংশ। মহামারির অনেক আগেই, ২০১৮-১৯’র শ্রমশক্তির সমীক্ষায় বিহারে বেকারত্বের হার ছিল ১০.২ শতাংশ, জাতীয় গড়ের (৫.৬ শতাংশ) প্রায় দ্বিগুণ।

মহাজোটের বিকল্পের অ্যাজেন্ডা তাই সহজেই মানুষের মনে ধরেছে। শুধু বিরোধিতা নয়, বিকল্পের নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা উপস্থিত করেছে মহাজোট। মানুষের মনে হয়নি আকাশকুসুম, অলীক স্বপ্ন। মনে হয়েছে বাস্তব দাবি। আদায়যোগ্য দাবি। নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক প্রচার মানুষের মন কেড়েছে। তাই তেজস্বী-সহ মহাজোটের সমস্ত সভায় ভিড় উপচে পড়েছে।

বিজেপি ইশতেহারে ভ্যাকসিনের বিনিময়ে ভোট চেয়েছে। বিহারবাসীকে বিনামূল্যে কোভিডের টিকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যখন বিধানসভা নির্বাচনের এই প্রতিশ্রুতির কথা ঘোষণা করেছেন, তখন বিষয়টি রীতিমতো হয়ে উঠেছে ন্যক্কারজনক। মোদী সরকার, যারা কোভিডের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ, যারা অপরিকল্পিত লকডাউনের সময় বিহার থেকে ভিন রাজ্যে খাটতে যাওয়া শ্রমিকদের অকথ্য নিষ্ঠুরতার শিকার হতে বাধ্য করেছে, তারা যখন ভ্যাকসিনের বিনিময়ে ভোট চাওয়ার নির্লজ্জ স্পর্ধা দেখিয়েছে, মানুষ মেনে নিতে পারেননি।

বামপন্থীদের নেতৃত্বে বিকল্পের অ্যাজেন্ডায় জাতপাতের রাজনীতিকে ছাপিয়ে উঠে এসেছে শ্রেণির কথা। আরজেডি-ও নিজের ‘এম-ওয়াই’ (মুসলিম আর যাদব) পার্টির ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে ‘এ-থেকে-জেড’ পর্যন্ত সবার দল হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করার চেষ্টা করেছে। জোর দিয়েছে অর্থনৈতিক ও স্থানীয় ইস্যুর উপর। বলেছে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথা।

নির্বাচনের স্লগ ওভারে বিকল্পের এই অ্যাজেন্ডাই এই নির্বাচনের টার্নিং পয়েন্ট।

বিহারের ভোটের গুরুত্ব তাই শুধু বিহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর রয়েছে এক জাতীয় গুরুত্ব। মেরুকরণের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে সৃজনশীল রাজনীতির জন্য তৈরি করেছে এক বিরাট সম্ভাবনা। জাতীয় রাজনীতিতে শোনা যাবে যার অনুরণন।

★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★ ★

ধারাবাহিক চলবে .....

আগামী পর্ব : বিকল্পের ৩৪ (সাতাত্তরের সাতগাছিয়া)





শেয়ার করুন

উত্তর দিন