বিকল্পের জন্য মরিয়া চিলি
এই চিলিতেই, এই গ্রহে প্রথম উদারনীতির পরীক্ষা।
স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল পিনোচেতের জমানায়। ১৯৮০, চিলির ওপর নতুন সংবিধান চাপিয়ে দেন তিনি। ওই সংবিধানই ঠিক করে দেয়: দেশ চলবে নয়া উদারনীতিতে। ১৯৯০, স্বৈরতন্ত্রের অবসান হলেও, তারপর আট-বছর তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ। অবসর নেওয়ার পর আরও বারো-বছর ছিলেন চিলির সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের দাপুটে সদস্য। এই সময়ে ৩৩-বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। কিন্তু বেসরকারিকরণের সঙ্গে জড়িত নয়া উদার কাঠামো থেকে গিয়েছে জীবন্ত। অটুট থেকে গিয়েছে নয়া উদারবাদের মডেল।
এহেন চিলিতে পিনোচেতের সংবিধান বদলে নতুন সংবিধান চেয়ে বিপুল জনাদেশ। মেকিস্কোর বামপন্থী দৈনিক লা জর্নাদা’র ভাষায়, ‘নয়া উদারবাদের অবসান’। নেরুদা, ভিক্টর হারা, আলেন্দের চিলিতে ইতিহাসের নতুন পাতা।
এই অক্টোবরে, গণভোটে প্রায় ৭৮.২৭ শতাংশ মানুষ রায় দিয়েছেন নতুন সংবিধানের পক্ষে। কমিউনিস্ট-সহ প্রগতিশীলদের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন সংবিধান তৈরিতে সরাসরি নির্বাচিত সাংবিধানিক সভাকেই বেছে নিয়েছেন ৭৯.২২ শতাংশ।
বলিভিয়ার পর এবারে চিলি। লাতিন আমেরিকা লড়ছে। গণবিদ্রোহ থেকে ব্যালটে। অভিমুখ ফের বামপন্থায়। এবং লাতিন আমেরিকা শুধু লড়ছেই না। ভাঙছে নয়া উদারবাদী মডেলকে, তার মূল অক্ষ চিলি থেকে। এই গ্রহে নয়া উদারবাদের প্রথম পরীক্ষাগার ছিল চিলি। এহেন চিলিতে দক্ষিণপন্থীদের বরাবরের দাপট ভেঙে বামপন্থীদের, বিশেষ করে ব্রড ফ্রন্টের জন্য তৈরি হয়েছে এক নতুন সম্ভাবনা।
একদিনে নয়, একবছর ধরে রাস্তায় লড়াই। কারফিউ। সেনা জওয়ানদের বেয়নটের মুখেও অকুতোভয়। সশস্ত্র বাহিনীর বর্বর দমনপীড়ন। যৌন হিংসা। এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত। এক প্রতিরোধের বিস্ফোরণ। শেষে সাফল্য। সান্তিয়াগোর প্রাণকেন্দ্রের ঢাউস ব্যানার: ‘বিদায় জেনারেল! নতুন সংবিধান চেয়েছি আমার শ্রেণির জন্য।’
শ্রেণিসংগ্রামের পাটিগণিত: এই বিশ্বের সবচেয়ে অসাম্যের দেশগুলির অন্যতম চিলি। জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০১৮-তে ছিল ১.১ শতাংশ, যেখানে বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির মুনাফা বেড়েছে ১০-গুণের বেশি। কী কারণে এই প্রকট ব্যবধান, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। চিলি দেখেছে জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্য, ওষুধ, পরিবহন, শিক্ষা এমনকি হিমবাহের বেসরকারিকরণ।
‘উৎখাতের মাধ্যমে কেন্দ্রীভবনের’ এক ধ্রুপদী উদাহরণ। ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশের জীবনধারণ। যে চিলিতে মাথাপিছু আয় বছরে ২৫,০০০ ডলার, সেখানে অর্ধেক শ্রমিকের বেতন মাসে ৫৫০ ডলারের কম।
গত বছরের ১৪ অক্টোবর, মেট্রোরেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে হাইস্কুলের ছাত্রদের বিক্ষোভ দিয়ে শুরু। মেট্রোর ভাড়া ৩.৭৫ শতাংশ (৩০ পেসো) বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ছাত্ররা। দ্রুত এই আন্দোলন এক অন্য মাত্রার চেহারা নেয়। দাবি তখন নিছক ‘৩০-পেসো নয়, ৩০-বছরের অসাম্যের অবসান।’
তাঁরা চান নয়া উদারবাদের বিকল্প। রাষ্ট্রপতি পিনেরার অবিলম্বে পদত্যাগ। একটি নতুন সরকার। তাঁরা চান মজুরিবৃদ্ধি, যা হবে দারিদ্রসীমার উপরে। ৪৫ নয়, সপ্তাহে ৪০-ঘণ্টা কাজ। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, যৌথ দর কষাকষির নিশ্চয়তা। নাগরিক পরিষেবাসহ স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের জাতীয়করণ। বেসরকারি পেনশন তহবিলের অবসান। ছাত্রদের ঋণমকুব। জলের কর ব্যবস্থার অবসান। প্রগতিশীল কর-কাঠামো। একটি নতুন অভিবাসী নীতি। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, রাজনীতি থেকে অর্থনীতির— কাঠামোগত পরিবর্তন। সবমিলিয়ে একটি নতুন সংবিধান। তার খসড়া লেখার জন্য একটি নতুন গণপরিষদ।
বিদ্রোহের দাবিগুলি কিন্তু একটিও নতুন নয়। স্বৈরতন্ত্রের পতনের সময় কমিউনিস্টরা চেয়েছিলেন শ্রমের অধিকারের পুনর্প্রতিষ্ঠা। শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকারের পুনর্প্রতিষ্ঠা। বেসরকারি পেনশনের অবসান। কিন্তু তখন তা ছিল সংখ্যালঘু মত। এখন সেই বিকল্প ভাষ্য আলোচনার কেন্দ্রে।
গণভোটের সিদ্ধান্ত মেনে ১৫৫-সদস্যের সাংবিধানিক সভার নির্বাচন হবে আগামী বছর ১১ এপ্রিল। সাংবিধানিক সভায় গৃহীত খসড়া সংবিধান গণভোটের জন্য পেশ করতে হবে ২০২২ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে।
তারমধ্যেই আগামী বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। এই মুহূর্তে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে একজন কমিউনিস্ট। প্যালেস্তিনীয় বংশোদ্ভূত দানিয়েল জাদু। সান্তিয়াগোর শহরতলি রিকোলেতার মেয়র। বেশ কয়েকটি জনমত সমীক্ষায় তাঁর পক্ষে সমর্থনের হার ১৯ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরে কমিউনিস্ট-বিরোধী পরম্পরার একটি দেশে একজন কমিউনিস্ট এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। জনকল্যাণকর প্রকল্পে মানুষের অংশগ্রহণকে স্থানীয় স্তর থেকে জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে তুলে আনার মধ্যেই এই সাফল্য। তাঁর স্লোগান: প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র।
গণভোটে জিতলেও, চিলির কমিউনিস্ট পার্টির বিশ্লেষণ, সম্পূর্ণ জয় এখনও আসেনি। তার জন্য আরও কয়েক ধাপ বাকি। যেমন আদি অধিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে নারাজ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। অনেকই স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা এবং আবাসনে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ভূমিকার কথা অস্বীকার করছেন। এই মুহূর্তে চিলিতে ১ শতাংশের হাতে ২৬.৫ শতাংশ সম্পদ। আর ১০ শতাংশের হাতে ৬৬.৫ শতাংশ। বিপরীতে, হতদরিদ্র ৫০ শতাংশের মাত্র ২.১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, তাঁরা অনুমোদন করবেন নয়া উদারবাদের একটি ‘মিঠে সংস্করণ’। সাংবিধানিক সভায় খসড়া সংবিধান অনুমোদনের জন্য জরুরি দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা।
সেকারণে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি গুইলেরমো তেইলার বলেছেন, ‘গণভোট আমাদের বিরোধীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাধ্য করেছে।’ সেইসঙ্গেই বলেছেন, ‘আমরা জানি আমাদের নানা মত আছে। কিন্তু এই সংবিধানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের মধ্যে সহমত নির্মাণে যতদূর সম্ভব যেতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ’।
বামপন্থীদের অন্যতম শক্তি ব্রড ফ্রন্ট। ২০১৭, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফ্রন্টের প্রার্থী সাংবাদিক বেত্রিস স্যানচেজ দুই অঙ্কেও পৌছতে পারবেন না বলেও পূর্বাভাস থাকলেও, পেয়েছিলেন ২০ শতাংশের বেশি ভোট। প্রায় পৌছে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় রাউন্ডে। সংসদের দুই কক্ষে নির্বাচিত হয়েছিলেন ফ্রন্টের ২১ জন প্রার্থী।
এবারে গণভোটে, ব্রড ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন স্যানচেজ। সঙ্গে ছিলেন কমিউনিস্ট মেয়র দানিয়েল জাদু। গণভোটের পরে ঐক্যের কথা আরও একবার জোরের সঙ্গে ঘোষণা করতে স্যানচেজ এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদরদপ্তরে। জাদু মৃদু সমালোচনার সুরে তাঁকে বলেছেন, ‘কেউ যখন শুধু আমাদের ভোট চায়, কিন্তু আমাদেরকে চায় না, তখন ঐক্য হয় না।’
গণভোট চেয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সময় চিলির কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থী দলগুলি মিলে তৈরি করেছে ‘চিলি দিগনো’ জোট। কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে, নয়া উদারবাদ বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে আমাদের ঐক্য নির্মাণ জরুরি। এবং সাংবিধানি সভার জন্য সহমতের একটি প্রার্থী তালিকাই প্রকাশ করা উচিত। যাঁরা বলবেন রূপান্তরের প্রকল্প, বিশ্বস্ততার সঙ্গে সুনিশ্চিত করবেন জনগণের আকাঙ্খা। বহন করবেন প্রকৃত অর্থেই একটি সাংবিধানিক সভা নির্মাণের জন্য জনাদেশ।’ যাঁরা বলবেন এমন এক নতুন সংবিধান, ‘যা হবে গণতান্ত্রিক, বহু জাতিগোষ্ঠীর, যা হবে মহিলাদের জন্য, জনগণের জন্য এবং যা হবে না অভিজাতদের জন্য।’
::::::::::::::::::::::::::::::::
ধারাবাহিক চলবে .....
আগামী পর্বের বিষয়:হিন্দুত্ব 'জাতীয়তাবাদ' জরুরী বিকল্প ভাষ্য...
শেয়ার করুন