...........চতুর্থ পর্ব..........
বিকল্পের লড়াইয়ে, প্রয়োগে বলিভিয়া
এক পালটা অভ্যুত্থান।
সেনা অভ্যুত্থান থেকে গণ অভ্যুত্থান। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় চোয়ালচাপা লড়াই। শেষে এক দুর্দান্ত জয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বলিভিয়া ফিরেছে বামপন্থায়।
এই জয় শুধু বলিভিয়ার জন্য নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একইসঙ্গে, এই অঞ্চলে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থানের সাম্প্রতিক যে প্রবণতা, তার জন্য একটি বড় ধাক্কা। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে এক সপাটে আঘাত।
নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে করবিনের ব্রিটেন হারলেও, ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছে মোরালেসের বলিভিয়া। মেক্সিকো, আর্জেন্টিনায় প্রগতিশীল সরকারের পর এবারে বলিভিয়া।
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় ২৬.২৭ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজমের (এমএএস) প্রার্থী লুইস আরসে। তিনি পেয়েছেন ৫৫.১ শতাংশ ভোট। দক্ষিণপন্থী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কার্লোস মেসা পেয়েছেন ২৮.৮৩ শতাংশ। উগ্র দক্ষিণপন্থী ফার্নান্দো কামাচো পেয়েছেন ১৪ শতাংশ। মেসার চেয়ে ১৬,১৭,৮৭৯ ভোট বেশি পেয়েছেন আরসে। ন’টি প্রদেশের মধ্যে ৬টি প্রদেশেই জিতেছে এমএএস। সংসদের দুই কক্ষেই রয়েছে দলের গরিষ্ঠতা। ৩৬-সদস্যের সেনেটে দল জিতেছে ২১টি আসনে। আর ১৩০-সদস্যের প্রতিনিধিসভায় ৭৮টি আসনে। সংসদের দুই কক্ষেই দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি মেসার দল। সেনেটে পেয়েছে ১১টি আসন, আর প্রতিনিধিসভায় ৩৫টি।
জয়ের পর ‘জাতীয় ঐক্যের’ সরকার গড়ার কথা বলেছেন আরসে। ‘আমরা গড়তে চলেছি একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার, আমরা নির্মাণ করতে চলেছি দেশের ঐক্য।’ বলেছেন, পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়াকে গতবছর সেনা অভ্যুত্থানে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তা আবার শুরু করা হবে। মোরালেসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, ‘উনি সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আছেন।’ কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠা করার কথা ঘোষণা করেছেন।
২০০৬, ইতিহাসের নতুন পাতা। সেই প্রথম, সেনা অভ্যুত্থান থেকে গণ অভ্যুত্থান। পাঁচশ বছরের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে সেই প্রথম আদি অধিবাসীর কেউ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বলিভিয়ায়। ইভো মোরালেস, গরিব কৃষক পরিবারের সন্তান।
বলিভিয়া মানে লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার। এই বলিভিয়াকেউ মজুত রয়েছে দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি লিথিয়াম। ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন, রোবট থেকে বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে ব্যাটারি তৈরির জন্য যে লিথিয়াম অপরিহার্য। ২০২৫ সালের মধ্যে যার চাহিদা দ্বিগুণ হওয়ার কথা।
এমন বিপুল সম্পদ থাকার পরেও সওয়া দশক আগে বলিভিয়া ছিল হাইতির পর লাতিন আমেরিকার দরিদ্রতম দেশ।
মোরালেসের সময়ে বলিভিয়া তেল ও গ্যাসকে আনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। বেসরকারিকরণের এই দুনিয়ায় জাতীয়করণ। অতীতে গ্যাস ও তেল উৎপাদনের ৮২ শতাংশ নিয়ে যেত বিদেশী বহুজাতিক সংস্থা। দেশের জন্য পড়ে থাকত মাত্র ১৮ শতাংশ। মোরালেস এই অনুপাত বিলকুল বদলে দেন। গ্যাস ও তেল থেকে আসা আয়ের সিংহভাগ ঢোকে সরকারি কোষাগারে। খরচ করা হয় শিল্পে, ম্যানুফ্যাকচারিং, পরিবহন, কৃষি উন্নয়ন, আবাসন ও বাণিজ্যে। এবং সামাজিক কর্মসূচীতে। শুধু প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করে সরকারি কোষাগারে আসে মোট আয়ের প্রায় অর্ধেক। যেখানে ২০০৫ সালে আসত মাত্র ৭ শতাংশ।
আর নয়া উদারবাদের এই বিকল্প অনুশীলনেই আসে তাক লাগিয়ে দেওয়া সাফল্য।
২০০৫, সেসময় বলিভিয়াতে ন্যূনতম মজুরি ছিল লাতিনের দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম। ৫৪ ডলার। ধনীশ্রেষ্ঠ ১০ শতাংশের সঙ্গে হতদরিদ্রের ব্যবধান ছিল ১২৮ গুণ। গড় আয়ু ছিল লাতিনের মধ্যে সবচেয়ে কম। ৬৩.৫ বছর। যেখানে প্যারাগুয়েতে ছিল ৭১.২ বছর।
২০১৯, বহু দেশকে ছাপিয়ে গিয়ে ন্যূনতম মজুরি পৌছয় ৩০৫ ডলারে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান নেমে আসে মাত্র ৪০-গুণে। গড় আয়ু বেড়ে হয় ৭৩.৫ বছর।
মোরালেসের সঙ্গেই বলিভিয়ার এই অর্থনৈতিক ‘বিস্ময়ের’ অন্যতম স্থপতি ছিলেন লুইস আরসে। যিনি কখনও অস্বীকার করেন না তাঁর মার্কসবাদী শিক্ষার কথা। এই অক্টোবরে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে যিনি অকপটে বলেছেন, ‘আমি ১৪ বছর বয়স থেকে কার্ল মার্কস পড়তে শুরু করি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই মতাদর্শগত অবস্থান পাল্টাইনি। এবং কোনও কিছুর বদলে তা পালটাব না।’ বেসরকারিকরণ থেকে যিনি করেছেন হাইড্রোকার্বন ক্ষেত্রের জাতীয়করণ।
আরসের সময় আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও বলিভিয়ায় গড়পরতা বিকাশের হার ছিল ৫ শতাংশ। তেল ও গ্যাসের জাতীয়করণ এবং স্ট্র্যাটেজিক সংস্থগুলির পুনরুদ্ধারের কারণেই আসে এই সাফল্য। চরম দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়ায় প্রায় অর্ধেক। ২০০৫ সালে যেখানে ছিল ৩৮.২ শতাংশ, ২০১৮-তে কমে দাঁড়ায় ১৭.১ শতাংশ।
পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুমৃত্যুর হার পড়েছে ৬১ শতাংশ। গিনি সূচক অনুযায়ী আয়ের বৈষম্যে লাতিন আমেরিকায় সবেচেয়ে সমতার সমাজের প্রবণতার সাক্ষী বলিভিয়া। একশো শতাংশ বয়স্ক নাগরিক পান পেনশন (আঞ্চলিক গড় যেখানে ৫৯ শতাংশ)।
এই সময়ে হয়েছে ভূমিসংস্কার। জমির দলিলের ৮০ শতাংশের মালিক ক্ষুদ্র কৃষক, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ মহিলা। সরকার চালু করেছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা। এই সময়ে বলিভিয়া তৈরি করেছে ৩,০০০ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। মাথাপিছু জিডিপি ১,০০০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩,৫৮০ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ১২০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০০ কোটি ডলার।
৪৭.০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে দেশের অপার খনিজ সম্পদ লিথিয়ামের জাতীয়করণের পরিকল্পনা করছিলেন মোরালেস। আর তারপরেই অভ্যুত্থান।
এবং নয়া উদারবাদে ফেরার বেপরোয়া পদক্ষেপ। এই এক বছরে বলিভিয়া দেখেছে মা ও শিশুদের খাদ্য বন্টন সুনিশ্চিত করার প্রকল্পের মতো সামাজিক খাতে বরাদ্দ ছাঁটাই। সর্বজনীন অবসরকালীন বেনিফিটে কোপ। যে শিক্ষা ব্যবস্থা বলিভিয়াকে পুরোপুরি নিরক্ষর মুক্ত করেছে, শিশুদের শিক্ষাকে অবৈতনিক করেছে, তা পর্যন্ত বেমালুম বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিউবার সাহায্য নিয়ে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। আক্রান্ত হতে হয় কিউবার চিকিৎসকদের। তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কিউবায়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা বেআব্রু হয়েছে কোভিডে। প্রত্যাহার করা হয়েছে রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, পাইপের জল এবং আবাসনে ভরতুকি।
এর ফলে দারিদ্র বেড়েছে চোখে পড়ার মতো। বেকারি ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নাগাদ যেখানে ছিল ৩.৯ শতাংশ, ২০২০’র মাঝামাঝিতে এসে দাঁড়িয়েছে ১১.৮ শতাংশ। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার পড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ।
ফান্ড-ব্যাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার নামে চলে প্রাকৃতিক সম্পদের বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ। গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর চালানো হয় বর্বর আক্রমণ। নেওয়া হয় একের পর এক জনবিরোধী পদক্ষেপ।
বিক্ষোভ দমনে নামানো হয় সেনাবাহিনী। তাদের দেওয়া হয় একতরফা অধিকার। চরম হেনস্থা করা হয় সাংবাদিক ও বিরোধীদের। টার্গেট করা হয় এমএএসের শক্ত ঘাঁটিগুলিকে। চলে অপহরণ থেকে অত্যাচার। সরকারি হিসেবেই সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন ৩৬ জন। জখম হনকয়েকশ। আটক-গ্রেপ্তার হন হাজারো প্রতিবাদী। শ্রমিকশ্রেণি, গরিব কৃষক— যাঁরা এমএএসের মূল জনভিত্তি— তাঁরাই ছিলেন মূল টার্গেট। পুড়িয়ে ফেলা হয় আদি অধিবাসীদের পতাকা।
বলিভিয়া তবু হারেনি। হারিয়ে যায়নি।
অভ্যুত্থানের প্রথম দিন থেকেই রাস্তায় মানুষ। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। তুমুল আন্দোলনের চাপে সরকার রাস্তা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। যদিও, দ্রুত আবার সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামায়। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টা এভাবেই লড়াইয়ে ছিল এমএএস। কখনও গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের থেকে সংযোগ হারায়নি। জনগণের সঙ্গে ছিল জীবন্ত সম্পর্ক।
আরসে তাঁর প্রচারে স্পষ্ট বলেছেন, মোরালেস সরকারের নীতিতে ফেরাই হবে তাঁর লক্ষ্য। স্পষ্ট করে বলেছেন, সাদা সোনা ‘লিথিয়াম লুটের লক্ষ্যেই অভ্যুত্থান করানো হয়েছিল। যার মালিক আসলেই ছিলেন বলিভিয়া মানুষ, যা থাকবে বলিভিয়ার। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ আমরা কিছুতেই বহুজাতিকের হাতে তুলে দেব না। আমাদের মালিকানা আমরা সুনিশ্চিত করব। আমরা পুনরুদ্ধার করব আমাদের দেশকে, আমাদের গণতন্ত্রকে। যে সরকার হবে জনগণের সরকার।’
------------------------------------------------
ধারাবাহিক চলবে ....
আগামীপর্ব - বিকল্পের লড়াইয়ে চিলি ....
শেয়ার করুন