★দ্বিতীয় পর্ব★
বাইডেনের জয়, নেপথ্যে বার্নির বিকল্প
চার বছর আগে ম্যাকিনসের একটি রিপোর্ট।
‘পুওরার দ্যান দেয়ার প্যারেন্টস?’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে অসহায় আর্তনাদ: সঙ্কটের আট বছরে মার্কিন নাগরিকদের ৮১ শতাংশের আয় হয় একই থেকেছে, নতুবা কমেছে।
এরপর ওবামার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারিকে কে ভোট দেবেন? এবং হিলারির হার। নয়া উদারবাদে বিশ্বস্ত ওবামার মধ্য দক্ষিণপন্থা থেকেই ট্রাম্পের উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান। পরবর্তী সময়ে সঙ্কট কমেনি। বরং আরও বেড়েছে। মহামারি সেই ক্ষতকে আরও বাড়িয়েছে।
‘ক্ষুধার কিনারে আমেরিকা।’
চায়না ডেইলি, কিংবা গ্রানমা নয়। এই শিরোনাম বিশ্ব পুঁজিবাদের মুখপত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়। প্রতিবেদনে রূঢ় বাস্তবের ছবি: ‘ক্ষুধার এক করাল ছায়া গ্রাস করছে আমেরিকাকে। মহামারি অর্থনীতিতে, প্রতি আটটি পরিবারের মধ্যে প্রায় একটিতেই খাওয়ার মতো নেই যথেষ্ট কিছু। লকডাউনে, ফুড ব্যাঙ্কগুলিতে বেনজির দীর্ঘ লাইন।’ পিউ রিসার্চের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষায়, ৩৩ কোটির দেশে ৫ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ খাবারের জন্য ফুড ব্যাঙ্ক, বা এমন দাতব্য সংগঠনের উপর নির্ভরশীল। সরল অঙ্কে মার্কিন জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ।
শেয়ার বাজারের সূচকের উল্লম্ফনের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারি। বাড়ছে ছাঁটাই। অক্টোবরের দশ তারিখ শেষ হওয়া সপ্তাহে, মার্কিন শ্রম দপ্তরের হিসেব, শেষ সাত-দিনে বেকার ভাতার জন্য নতুন করে আবেদন করেছেন ৮,৯৮,০০০ জন। প্রায় ৯ লক্ষ। আগস্টের শেষ থেকে সর্বোচ্চ। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, মে মাস থেকে দারিদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়েছেন ৮০ লক্ষ মার্কিন নাগরিক (দ্য গার্ডিয়ান, ১৭ অক্টোবর)।
বিপরীতে, মার্চ-সেপ্টেম্বর, অর্থনীতির এই অভূতপূর্ব সঙ্কোচনের সময়েও দেশের ৬৪৩ জন বিলিওনেয়ারের সম্পদ বেড়েছে ৮৪,৫০০ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ২৯ শতাংশ! এই সম্পদ বৃদ্ধির প্রায় অর্ধেক গিয়েছে ১৫ জন ধনকুবেরের ঘরে। আর তার অর্ধেক মাত্র পাঁচজন— বেজোস, গেটস, জুকেরবার্গ, মাস্ক আর বাফেটের পকেটে।
এরপর ট্রাম্পকে কে ভোট দেবেন? মানুষ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু, কোভিড এবং বেহাল অর্থনীতির কারনে ‘সহজ জয়’ হবে বলে ডেমোক্র্যাটরা যেমন ভেবেছিলেন, তা হয়নি। অধিকাংশ জনমত সমীক্ষার ‘নীল ঝড়’ ওঠার পূর্বাভাস মেলেনি। বস্তুত, বহু প্রদেশেই জোরদার লড়াই দিয়েছেন রিপাবলিকানরা। জর্জিয়া, পেনসিলভ্যানিয়া, অ্যারিজোনা, উইসকনসিনে রীতিমতো টানটান লড়াইয়ের মুখে পড়েছেন বাইডেন। কান ঘেষে বেরিয়ে গিয়েছেন।
ডেমোক্র্যাটদের এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ, তাঁদের ছিল না কোনও বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচী। বস্তুত, তাঁদের অর্থনৈতিক বার্তা ছিল খুবই দুর্বল, অস্পষ্ট। এমনকি পরিবেশ ও তেল শিল্প নিয়েও ছিল না কোনও স্পষ্ট অবস্থান। বাইডেন আগাপাশতলা মার্কিন কর্পোরেটদের প্রার্থী। অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে নয়া উদার নীতির কট্টর সমর্থক।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরেও তবু বাইডেন পিছলে বেরিয়ে গিয়েছেন, কারণ রাস্তার সংগ্রাম ও তৃণমূল স্তরের প্রগতিশীল সামাজিক সংগঠনগুলির দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা লড়াইয়ের সুফলে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে থাকা সংখ্যালঘু ডেমোক্র্যাটিক সোস্যালিস্টস অব আমেরিকা (ডিএসএ) অংশটি এই সংগ্রামগুলিতে প্রত্যক্ষ মদত জুগিয়েছে। বার্নি স্যাণ্ডার্স নিজে গিয়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার-এর বড় বড় জনসভাতে বক্তব্য রেখেছেন।
ডিএসএ-কে অনেকেই দক্ষিণপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ‘বামপন্থী মুখ’ বলতে পারেন। আবার ট্রটস্কিবাদীরা বলতেই পারেন ‘মেকি বাম’। তবে সবাইকেই বলতে হবে নিউ লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ডিএসএ এক অন্য-হাওয়া।
পুঁজিবাদের মধ্যেই তাঁরা বলছেন নয়া উদার নীতির বিকল্পের কথা। সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়র ফি মকুব, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিএ)-র অবসান, মহিলা ও সংখ্যালঘুদের অধিকার, প্রতি ঘণ্টায় ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলার, সবার জন্য সরকারি কাজ, আবাসনের নিশ্চয়তা এবং ধনীদের উপর চড়া হারে কর আরোপ।
যে মার্কিন গণতন্ত্রে বেছে নেওয়ার পরিসর অনেকটাই ‘কোকো-কোলা আর পেপসি-কোলার মধ্যে একটিকে’ পছন্দ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে ডিএসএ এক রাজনৈতিক-অক্সিজেন।
১৯৮২-তে ডিএসএ’র প্রতিষ্ঠা। শুরুতে যতোটা না রাজনৈতিক দল ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল বামপন্থী একটি সংগঠন। মূলধারার কর্পোরেট ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পেতেন না, তাঁরাই ছিলেন এর সদস্য-সমর্থক।
তবে, ২০১৬-তে ডেমোক্র্যাট প্রাইমারি নির্বাচনে বার্নির প্রচারের আগে পর্যন্ত খুব কম মানুষই জানতেন তাঁদের নাম। সদস্য-সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৭,০০০। বার্ণি-এফেক্টে বছরশেষে সদস্য সংখ্যা একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১১,০০০। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০,০০০।
এখন আর বার্নি একা নন।
এবারে মোট ২৯ জন প্রার্থী ও ১১টি ব্যালট উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছিল ডিএসএ। এর মধ্যে জিতেছে ২০টি আসনে, আটটি ব্যালট উদ্যোগে। এই মুহূর্তে ১৫টি প্রদেশের আইনসভাতে রয়েছেন ডিএসএ’র প্রতিনিধি।
বার্নির সঙ্গে এখন নিউ ইয়র্কের ওকাসিও কোর্তেজ, মিশিগানের রশিদা তালিব, মিনসোটার ইলহান ওমর, ম্যাসাচুসেটসের আয়ান্না প্রেসলিরা। মার্কিন সেনেটে নির্বাচিত হওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা আয়ান্না বলেছেন, ‘আমরা ইতিহাস গড়তে আসিনি, আমরা পরিবর্তনের জন্য এসেছি।’
মার্কিন কংগ্রেসে প্রগতিশীল ব্লক ‘স্কোয়াড’র চারজন সদস্যই এবার পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে কোর্তেজ, আর রশিদা ডিএসএ’র সদস্য।
প্রগতিশীলরা তাঁদের স্কোয়াডে যুক্ত করেছেন আরও দু’জনকে। নিউ ইয়র্ক থেকে নির্বাচিত ৪৪ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ স্কুল শিক্ষক জামাল বোম্যান এবং কোরি বুশকে। পেশায় নার্স কোরি বুশ, মিসৌরি থেকে নির্বাচিত এই প্রথম কোনও কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য।
ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে ওয়াশিংটনের প্রমিলা জয়পাল এবং ক্যালিফোর্নিয়ার রো খান্নাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রগতিশীল বিষয়সূচি নিয়ে প্রচার করে নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য।
প্রদেশগুলির আইনসভাতে নির্বাচিত হয়েছেন বেশ কয়েকজন ডিএসএ’র সদস্য। যেমন নিউ ইয়র্ক প্রদেশের আইনসভাতে নির্বাচিত হয়েছেন পরিচালক মীরা নায়ারের ছেলে জোহরান মামদানি।
এছাড়াও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীল নীতি ব্যালটে ছিল, যা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। যেমন ফ্লোরিডা প্রদেশ ট্রাম্পকে ভোট দিলেও, তাঁরা রায় দিয়েছেন প্রতি ঘণ্টায় ন্যূনতম মজুরি ১৫ ডলার করার পক্ষে। অ্যারিজোনা প্রদেশের মানুষ রায় দিয়েছেন ধনীদের ওপর কর চাপিয়ে ১০০ কোটি ডলার সংগ্রহে, যা দিয়ে কম সাহায্য পাওয়া স্কুলগুলিকে সহায়তা করা যায়। কলোরাডো প্রদেশ রায় দিয়েছে উৎখাতের বিরুদ্ধে। বড় জমির মালিকদের উপর কর বসানোর পক্ষে, যাতে সেই অর্থ উৎখাতের মুখে পড়া মানুষদের আইনি লড়াইয়ে সহায়তার কাজে ব্যবহার করা যায়। সেইসঙ্গেই একটি নীতি ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে যা শ্রমিকদের ১২ সপ্তাহের পূর্ণ মজুরির সঙ্গে মেডিকাল এবং পরিবারের প্রয়োজনে ছুটির মঞ্জুর করেছে।
সেকারণে বাইডেন নয়। তাকিয়ে থাকুন বার্নি স্যাণ্ডার্স, ওকাসিও কোর্তেজ, ইলহান ওমার, কোরি বুশসহ বামপন্থা ঘেঁষা প্রগতিশীল সাংসদদের দিকে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, নারী আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনের দিকে। তাদের সাফল্য অথবা ব্যর্থতার উপর নির্ভর করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ভবিষ্যৎ।
ধারাবাহিক চলবে ......
শেয়ার করুন