বিকল্প নীতির লক্ষ্যে জরুরি বিকল্প সরকার
বিজেপি যে পয়লা নম্বর শত্রু, তাকে পরাস্ত করাই যে প্রাথমিক কর্তব্য, তা নিয়ে বামপন্থীদের কারো মনে কোনও সংশয় নেই। থাকার কথাও নয়।
সকলেই সহমত ‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র কাছে তৃণমূল নিজেকে একটি শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে তুলে ধরতেই পারে, কিন্তু তার সন্ত্রাসের রাজত্ব, দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রের উপর সরাসরি হামলা আদতে এই রাজ্যে বিজেপি-কেই বাড়তে সাহায্য করছে।’ কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না ‘পশ্চিমবঙ্গের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিজেপি-কে পরাস্ত করতে গেলে তৃণমূল কংগ্রেসকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, পরাস্ত করতে হবে। তৃণমূল বাংলায় বিজেপি-কে প্রবেশের রাস্তা করে দিয়েছে। তাদের উপর নির্ভর করেই বিজেপি বাংলায় পা রেখেছে।’
সেকারণে মোদী-মমতাকে একযোগে ‘না’ বলাটা জরুরি।
তবে, কেবল না বলাই যথেষ্ট নয়। একইসঙ্গে জরুরি হলো একটি বিশ্বাসযাগ্য বিকল্প নির্মাণ। এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলার জন্য একটি সৃজনের রাজনীতি। এই সময়ের একমাত্র চাহিদা: বিকল্প শক্তি। বিকল্পের জন্য একটি ন্যূনতম কর্মসূচী। এবং সেই বিকল্পের জন্য অবিরাম সংগ্রাম। একটি বিকল্প সরকার।
বিকল্পের সংগ্রামে, বিকল্প সরকারের লক্ষ্যে স্লোগান হোক: কাজ, কর্মসংস্থান। কাজ দিতে না পারলে ভাতা। অতীতের মতো ফি বছর টেট, এসএসসি, পিএসসি’র মাধ্যমে নিয়োগ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ। অবিলম্বে শূন্যপদ পূরণ। ছোট-মাঝারি শিল্পে সরকারি সহায়তা, বিনিয়োগ।
রাজ্যে নিয়োগ বন্ধ স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুর্নীতির জন্য হাইকোর্টের রায়ে আপার প্রাইমারিতে মেধা তালিকা সম্পূর্ণ বাতিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পঙ্গু করে হয়েছে নতুন বোর্ড। যা সংবিধান সম্মত নয়। দুর্নীতি, নৈরাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনে। হয়নি ক্লার্কশিপ পরীক্ষা।
তাহলে কোথায় হবে কর্মসংস্থান? রাজ্যে বেড়েই চলেছে শূন্যপদের সংখ্যা। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে লক্ষাধিক। কলেজের স্থায়ী অধ্যাপক ২৫ হাজারের বেশি। সরকারি-আধা সরকারি মিলিয়ে শূন্যপদ কমবেশি সাড়ে ৫ লক্ষ। বামফ্রন্টের সময় ছোট-মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান ছিল রাজ্যগুলির মধ্যে শীর্ষে। অনেক পিছনে গুজরাট। এখন সবই সঙ্কটে। বেশিরভাগই বন্ধ। সিঙ্গুরে নব্বই শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া কারখানা তাড়ানোর পর আর বিনিয়োগ আসেনি। জিন্দাল ইস্পাত কারখানা পুরোপুরি বন্ধ। বছর-বছর শিল্প সম্মেলন হয়েছে। বিনিয়োগ হয়নি। সবার জন্য দিনে ন্যূনতম মজুরি ৭০০ টাকা। সবার জন্য মাসিক পেনশন ১০,০০০ টাকা। কৃষি থেকে কৃষক উচ্ছেদ রোধে পরিকল্পিত উদ্যোগ। চাষকে লাভজনক করতে সরকারের তরফে মিনিকিট, সার ও সেচের জলের প্রসার। কৃষকের জন্য কেবল এককালীন ঋণমকুব নয়। ফসলের দেড়গুণ দামের নিশ্চয়তা। কৃষি থেকে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। যাতে নিশ্চিত করা যায় ফসলের দাম। ছোট-মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ, যাতে মূল্য যোগ করা যায় কৃষি ফসলে। সেইসঙ্গে, ভূমি সংস্কারে জমি পাওয়া যাঁরা উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের পুনর্প্রতিষ্ঠা।
এপিএমসি অ্যাক্ট বাতিল। মাঠে ফসল থাকাকালীনই বেসরকারি সংস্থা যাতে কৃষকদের কাছ থেকে তা কিনে নিতে পারে, সে জন্য মোদীর ৬-বছর আগেই ২০১৪ সালে আইন পাশ করেছে তৃণমূল সরকার। কৃষিপণ্যের বাজারে খুলে দিয়েছে বৃহৎ পুঁজি প্রবেশের পথ। এই আইনে যে কোনও ব্যক্তি, কোম্পানি, সংস্থা, কো-অপারেটিভ সোসাইটি, সরকারি সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা অথবা এজেন্সি-কে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কেনার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই আইনেই ‘কমিশন এজেন্ট’ নিয়োগের অধিকারও দেওয়া হয়েছে ক্রেতাকে। অর্থাৎ আইনেই দালালি ব্যবস্থাকে দেওয়া হয়েছে বৈধ স্বীকৃতি। ২০১৭, একটি সংশোধনী এনে কৃষিপণ্যের ই-ট্রেডিং বা অনলাইন বাণিজ্য এবং বিপণনও বৈধ করেছে। বামফ্রন্টের আমলে গড়ে উঠেছিল কয়েক হাজার কৃষি সমবায় সংস্থা। স্থানীয় কৃষকরাই সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এই সমবায়গুলিই কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে সরকারের কাছে সরাসরি বিক্রি করত। এই ব্যবস্থা কৃষকদের সরাসরি সরকারি সহায়তা মূল্য পেতে সাহায্য করত। ক্ষমতায় এসে মমতা ব্যানার্জির সরকার কৃষি সমবায়গুলিসহ প্রায় ২০ হাজার সমবায় সরকারি অধ্যাদেশ জারি করে বেমালুম বাতিল করে দেন। এর ফলে সমগ্র বাজার চলে যায় কিছু অর্থবান ক্ষমতাশালী দালালদের নিয়ন্ত্রণে। এরপর ২০১৭ সালে এপিএমসি আইনের পরিবর্তন করে রাজ্যের কৃষিপণ্যের বাজার ও বিপণনকে সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করেন তিনি।
সব গ্রামে, সব শহরে রেগা। একশ দিন না। দু’শ দিন।
খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্ব। গণবন্টনের সম্প্রসারণ। আগের সব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাকে সময়োপযোগী করা। সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জল। বাসস্থানের ব্যবস্থা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সর্বজনীন শিক্ষা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈরাজ্যের অবসান। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা।
সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রের সবটাই করতে হবে বিনামূল্যে। জনস্বাস্থ্যে সরকারকে নিতে হবে সম্পূর্ণ দায়িত্ব। মহামারি ও রোগ প্রতিরোধে দিতে হবে অগ্রাধিকার।
বিদ্যুতে ক্রস সাবসিডি মারফত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য বিদ্যুতের দাম কমানো।
সম্পদের বন্টনের জন্য যে স্টেট ফিনান্স কমিশন ছিল, তাকে পুনরুজ্জীবিত করে সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ। রাজ্য সরকার পরিচালিত রুগ্ন সংস্থাগুলির পুনরুজ্জীবনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ। সরকারি কারখানা তৈরি সামগ্রী বিপনণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ। চটকল ও পাটচাষীদের জন্য বিশেষ প্যাকেজ।
পরিবেশ রক্ষার জন্য বনাঞ্চল সংরক্ষণে বিশেষ প্যাকেজ। বেআইনি খনি, খাদান বন্ধ করা। বড় শহরগুলিতে সরকারি পরিবহন এর ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চালিত বাস ও অন্যান্য যানবাহন তার জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার। স্পেশাল গ্রিন জোন নির্মাণ ও সংরক্ষণের উদ্যোগ।
নারীনির্যাতন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রতিরোধে শহরে ওয়ার্ড বা বরো ভিত্তিক বিশেষ সহায়তা কেন্দ্র। গ্রাম বাংলায় ব্লক-স্তরে। ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের জন্য হরাইজন্টাল রিজার্ভেশন।
সংগঠিত শিল্পে এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য বার্ধক্যকালীন, কাজের সময় দুর্ঘটনা, কাজের ধরনের জন্য স্বাস্থ্যহানির জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা ঝড় ইত্যাদি মোকাবিলায় বিশেষ তহবিল গঠন।
উন্নয়নের কাজে গ্রামসভা থেকে ওয়ার্ডসভায় মানুষের অংশগ্রহণ। সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পাহাড়ে সর্বোচ্চ স্বশাসনের অধিকার। গণতন্ত্রে বিরোধী রাজনৈতিক মতের অধিকার। শান্তিতে ভোটদানের অধিকার। পঞ্চায়েত, পৌরসভায় নিয়মিত অবাধ নির্বাচন। গুণ্ডারাজ, তোলাবাজ মুক্ত রাজ্য।
শেয়ার করুন