জনগণের ট্যাক্সের টাকা বিপুল খরচের মাধ্যমে শেষ হলো এবারের বাংলার শিল্প সম্মেলন। এই নিয়ে সাতবার!এবারের সম্মেলনের শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, এবারের বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ৩, ৭৬,২৮৮ কোটি টাকার! শিল্পের জন্য মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ১৮৮টি! গতবারের ঘোষণা ছিল ৩,৪২,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের! শিল্প চুক্তি নাকি হয়েছিল ১৩৭টি! এই ঘোষণার আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া আসল তথ্যটা হলো যে, কেন্দ্রীয় সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব পলিসি অ্যান্ড প্রমোশন (ডিআইপিপি) তার রিপোর্টে জানাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ — এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের লিখিত প্রস্তাব এসেছে ৫৭,১২৩ কোটি টাকার। অর্থাৎ শিল্প সম্মেলনগুলিতে যা ঘোষণা হচ্ছে তা আদতে বিস্তর ভাঁওতা। এই শিল্প সম্মেলনের মঞ্চ থেকে অহেতুক বামেদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, বাম আমলে শিল্পের দুর্দশা নিয়ে নানান গল্প সাজিয়েছেন। তথ্য বলছে শুধু ২০০৮ সালেই রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব ছিল ৯৫,০০০ কোটি টাকার। স্মরণে রাখতে হবে, সেই সময়ে রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনা ধ্বংস করতে নানান ষড়যন্ত্র করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীরা।
২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচনী ইশ্তেহারে বলেছিল, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতিটি মহকুমায় অন্তত দশটি করে বড়ো, মাঝারি শিল্প গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ ভূমিকা নেবে এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক।’ দীর্ঘদিন যাবত সেই ব্যাঙ্ক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলা বন্ধ করেছেন। এই গাল ভরা প্রতিশ্রুতির ঘুম যখন ভাঙে, তখন পরিবার পরিজন ছেড়ে, পিঠে বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে কেরালা, হায়দরাবাদ অথবা নয়ডাতে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যেতে বাধ্য হয় এই বাংলার যৌবন। হায়দরাবাদে চারমিনারের আশেপাশে কয়েক লক্ষ বাংলার মানুষ বসবাস করেন যাদের বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশের মধ্যে। মোবাইল সারাইয়ের দোকান, বোরখা তৈরির কাজ ইত্যাদি নানারকমভাবে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা তাঁরা করেন। এই ধরনের কাজের কোনো সুযোগই কি পশ্চিমবাংলায় ছিল না? পরিযায়ী শ্রমিকদের কোনো খবর মোদি মমতা রাখেন না। মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে দেখা যায়, এই বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের লাশ কফিন বন্দি হয়ে তাঁদের গ্রামে ফেরে। ইনসাফ যাত্রা শুরুর আগের দিনই কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ মহকুমার জামালদহের পরিযায়ী শ্রমিকের কফিনবন্দি দেহ ফিরেছিল বাড়িতে। এই ‘না ইনসাফি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যেই যুবরা রাস্তায় নেমে ইনসাফ যাত্রা করছে।
কিছুদিন আগে প্রকাশিত হওয়া বিশ্বব্যাংকের একটি রিপোর্ট আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (আইএলও) থেকে পাওয়া তথ্যের নিরিখে জানা যাচ্ছে যে, ভারতে গ্রামের চেয়ে শহরে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। গ্রামে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশ, সেখানে শহরে বেকারত্বের হার ৭.৮ শতাংশ। কাজের জন্য দেশের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে! দেশের যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ শতাংশে। গ্রামের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি যুবকদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার এখন শোচনীয়। ২০১১-১২ সালে সমাজের এই অংশের বেকারত্বের হার ছিল ৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে তা প্রায় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭.৪ শতাংশে। গ্রামের ১৫ থেকে ২৯ বছরের নারীদের ক্ষেত্রেও বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। ২০১১-১২ সাল থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৬ শতাংশ। মোদি কদিন আগেই ‘পিরিওডিক লেবার সার্ভে’ করিয়েছিলেন বেকারত্বের সমস্যা কমে গেছে এটা প্রমাণ করার জন্য। যে তথ্য তিনি গোপন করলেন তা হলো, এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের মধ্যে তরুণ প্রজন্মের বেকারির হার ভারতেই সব থেকে বেশি। বিভিন্ন সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে — দেশের ৮২ শতাংশ পুরুষ কর্মী এবং ৯২ শতাংশ মহিলা কর্মী এখনও মাসে ১০ হাজার টাকার কম বেতন পাচ্ছেন। দেশের প্রায় ৯০% শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। প্রথাগত হিসাবের বাইরে বিভিন্ন অনিয়মিত কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষ ছদ্দ বেকার বা আংশিক বেকার হিসেবে থেকে যান। এন এস এস ও -র ২০২১ সালের পিরিওডিক লেবার সার্ভে অনুযায়ী দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমের বাজারের বাইরে অবস্থান করছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের হাতে স্থায়ী কাজ নেই। বাজারে মজুদ বেকার বাহিনীর সংখ্যা এতই বেশি যে স্থায়ী কাজে নিযুক্ত শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির কথা ভাবতেই পারেন না পাছে তার কাজ চলে যায়। এই প্রজন্মের এক বড় বংশের শ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা কি তা জানেন না। মজুরি ও অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা জনিত খরচ কমানোর লক্ষ্যে পুরনো শ্রম আইনের বদলে নতুন শ্রম কোড তৈরি করা হয়েছে। দেশের শিল্প ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের গতি বৃদ্ধি ঘটেছিল ২০০৩-৪ সাল থেকে ২০০৮-৯ সাল পর্যন্ত। সেই সময় দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশি ছিল, বিনিয়োগ ও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০০৮ এর পরবর্তী সময়ের মহামন্দার ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের হার ক্রমাগত কমতে থাকে এবং তা কর্মসংস্থানকেও প্রভাবিত করে। পরবর্তী ক্ষেত্রে নোট বাতিল, জিএসটির সিদ্ধান্ত এবং অতিমারির প্রভাব কর্মসংস্থানের সুযোগকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সম্পদের যথাযথ বন্টনের ক্ষেত্রেও দেশে ভয়ংকর বৈষম্য রয়েছে। দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৩৩ শতাংশ দখলে রেখেছেন দেশের ১% ধনী মানুষ। উল্টোদিকে দেশের মোট সম্পদের ৬% অধিকার করে রয়েছে দেশের নিম্নবিত্ত ৫০% মানুষ।
এই বৈষম্য কমানোর কোন প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। উল্টে সরকারের টাকা নেই — এই অজুহাতে ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্পের নাম করে দেশের লাভজনক সংস্থাগুলোকে একের পর এক আদানি-আম্বানিদের হাতে কম পয়সায় বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন মোদি। আস্ত পাহাড়, গোটা জঙ্গল, ইস্পাত কারখানা, কয়লা খনি , জীবন বিমা সংস্থা, বিএসএনএল, ইন্ডিয়ান অয়েল, ভারতীয় রেল — বিক্রির তালিকা লম্বা হয়েই চলেছে। এই কাজে মোদিকে যোগ্য সহায়তা করছেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু মমতা ব্যানার্জি। পাথরের বেআইনি ব্যবসার লোভে এই বাংলাতে তিলাবনী পাহাড়টাই রাজ্য সরকার বেচে দিয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিলে গাছপালা ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়। সেই গাছপালা পরিষ্কার করার অংশ হিসেবে বেআইনিভাবে কাঠ পাচার করা হয়, যেগুলো বেসরকারি হাতে বিক্রি হয়। কাঠ পাচারের পর সেই জায়গাটা পরিষ্কার হয়ে গেলে রীতিমতো জেসিবি মেশিন দিয়ে মোরাম ও বোল্ডার তুলে বেআইনিভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। গোটাটাই রাজনৈতিক মাতব্বরদের হাতে নিয়ন্ত্রিত।
মমতা ব্যানার্জির সরকারও মোদিজির রাস্তা অনুসরণ করে একটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলেছেন। নতুন নতুন চাকরি দুর্নীতি। সাদা খাতা জমা দিয়ে বিডিও হওয়া থেকে তৃণমূল এবং বিজেপি নেতার ছেলেমেয়েদের দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি চাকরি পাওয়ার ঘটনা এখন প্রায় গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দুই জন মন্ত্রী ও দুইজন বিধায়ক জেলে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তদন্ত এমনই হচ্ছে যে মাননীয় বিচারপতিও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, লোকসভার নির্বাচনের জন্যে কোনো ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে কীনা!
বাস্তব ছবিতে রাজ্য সরকারের প্রাইমারি স্কুলগুলোতেই শূন্যপদের সংখ্যা ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯২! সরকারি স্কুলে শূন্যপদ প্রায় ৩লক্ষ। পঞ্চায়েতে ১২ হাজার। পুরসভায় ৪০ হাজার। মিড ডে মিলের ডিম চুরি করে বিধায়কদের মাইনে ৪০ হাজার টাকা করে বাড়িয়েছে এই সরকার। তারসাথেই স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্কুল বন্ধের সংখ্যা।
এই সর্বগ্রাসী যন্ত্রণার বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, দমবন্ধ করা পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ইনসাফ চাইতেই আমরা রাস্তায় নেমেছি। পথের দু’ধারে হাজারে হাজারে মানুষ অপেক্ষা করছেন নিজেদের যন্ত্রণার কথা আমাদের বলার জন্য। ওঁরা চাইছেন এই ইনসাফ যাত্রা তাঁদেরও ইনসাফের কথা বলুক। উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘিতে একটি গ্রামে ১০০ দিনের কাজের নাম করে ১৩৭টা পুকুর কাটার হিসাব খাতায়-কলমে দেখানো হয়েছে। একটি গ্রামে অতগুলো পুকুর থাকলে গিনেসবুকে নাম ওঠার কথা! চুরিকে আক্ষরিক অর্থে পুকুর চুরিতে পরিণত করে ফেলেছেন তৃণমূলের নেতারা। এই ইনসাফ যাত্রা সেই চুরির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। শিলিগুড়িতে মেডিকেল কলেজ পেরিয়ে আসার পর ঘোষপুকুর মোড়ে আমাদের পদযাত্রাকে একটি অল্পবয়স্ক মেয়ে হাত দেখিয়ে থামালো। ঘোমটায় সম্পূর্ণ মুখ ঢাকা, কারণ কিছুদিন আগেই পরপর দুদিন ধরে ওই এলাকার তৃণমূল মাতব্বররা তাঁর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। লজ্জা তো মেয়েটিরই পাওয়ার কথা, তাই না? থানা তাঁর অভিযোগ নিতে চায়নি। অশ্লীল ইঙ্গিত করে তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে বাড়িতে। এলাকার বিধায়ক বিজেপি’র। যে বিজেপি গোটা দিন ধরে টিভি মিডিয়াকে ব্যবহার করে তৃণমূল বিরোধিতার নাটক করে।বিজেপি বিধায়ক কিন্তু একবারের জন্যও মেয়েটির কাছে খোঁজ নিতে আসেননি। গায়ে তীব্র জ্বর নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় খালি এইটুকুই বলতে পেরেছিল, ‘‘মুঝে ইনসাফ চাহিয়ে!’’
ইনসাফ যাত্রা কুশমণ্ডিতে ঢোকার পর এলাকার কৃষকেরা তাঁদের যন্ত্রণার কথা জানালেন। চাষের সারের প্যাকেটের গায়ে দাম লেখা রয়েছে ১৪০০ টাকা। কিন্তু এলাকার চাষিদের অভিজ্ঞতা হলো যে, ন্যূনতম ২৭৫০ টাকার কমে ওই সারের প্যাকেট বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। এই কালোবাজারির বিরুদ্ধে তৃণমূল কিংবা বিজেপি’র নেতারা কথা বলেন না। সেখানকার মানুষের কাছে আমরা জানলাম — স্কুলের মিড ডে মিলে ডিম সেদ্ধ তো দূরের কথা সামান্য নিউট্রিলাও পাওয়া যায় না। প্রায় রোজই পালং শাক দিয়ে ভাত খাইয়ে বাচ্চাদের রাখা হয়। তাঁরা ইনসাফ যাত্রার কাছে এই যন্ত্রণার বিরুদ্ধে ইনসাফ চাইতে এসেছেন। মুর্শিদাবাদের সাগরপাড়া পেরোচ্ছে ইনসাফ যাত্রা। দূর থেকে চোর চিটিংবাজরা নজর রাখছে কারা কারা মিছিলে গেল। হাজার হাজার সংগ্রামী যৌবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া মিছিলের মধ্যেই দ্রুতগতিতে ডিওয়াইএফআই নেতার হাতে কেউ একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে গেল। তাতে লেখা, ‘‘আমরা ভিলেজ রিসোর্স পার্সনরা তিন চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। আমাদের যন্ত্রণার কথা ইনসাফ যাত্রায় তুলে ধরার অনুরোধ করছি।’’ শ্যামলডিহি গ্রামের আদিবাসী খেতমজুর সাইনি হেমব্রম অন্যের জমিতে জন খেটে দিনে আড়াইশো টাকা রোজগার করেন। অকালে স্বামী মারা যাওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়ে মাইনি ও ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে কাজলকে সাথে নিয়ে মাঠে আলু কুড়ানোর কাজ করেন। অভাব অনটনের বাধ্যবাধকতায় মা তাঁর সন্তানকে স্কুলছুট হতে বাধ্য করছেন কারণ মায়ের সামনে আর কোনো উপায় নেই। দেউচা পাঁচামীর সাধারণ মানুষের কথা না শুনে পরিবেশ ধ্বংস করার যে চক্রান্ত সরকার করছে তার বিরুদ্ধেও ইনসাফ যাত্রীদের কাছে অভিযোগ জানান এলাকার মানুষ। রায়না, খণ্ডঘোষ ও মাধবডিহি থানা এলাকায় সুগন্ধি চালের চাষ ও রপ্তানির ওপরে এলাকার বহু মানুষ নির্ভরশীল। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ চাল রপ্তানির ওপর ২০শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। রপ্তানি মার খাচ্ছে, আদতে মার খাচ্ছেন গরিব কৃষক। একইরকম সুগন্ধি চাল উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাটেও তৈরি হয়। তার রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ আবগারি শুল্ক মুকুব করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। দিনরাত জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে টিভিতে ভাষণ দেওয়া তৃণমূলের নেতারা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নীরব। ওই এলাকার কৃষকেরা ইনসাফ যাত্রায় শামিল হয়েছিলেন তাঁদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। ইনসাফ যাত্রা যত এগিয়েছে ততই গত পঞ্চায়েতে ভোটলুঠের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এলাকার মানুষ। যে পেশী শক্তির প্রয়োগে গত পঞ্চায়েতে ভোটলুটের চেষ্টা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের গনগনে আঁচ ইনসাফ যাত্রীরা প্রত্যক্ষ করেছেন।
ছোটবেলায় কবিতায় পড়েছিলাম :—
‘‘প্রয়োজন হলে দেবো একনদী রক্ত।
হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,
অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে
একদিন সে-পাহাড় টলবেই।
চলবেই চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’’
এই ইনসাফ যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপের অভিজ্ঞতা আসলে এই কবিতার সার্থকতা বর্ণনার মতো। অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষের পথ হেঁটেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে হারানো সম্ভব হয়েছিল, এই সংঘর্ষের পথ হেঁটেই বাবরি কিংবা গোধরার পর দাঙ্গাবাজদের রুখে দেওয়া গেছিল — সেইপথে আমরা আবার নেমেছি ইনসাফ চাইতে। ওই পথের প্রতিটা বাঁকে ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, বিনয়-বাদল-দীনেশ, কল্পনা দত্ত, মুজফ্ফর আহ্মদ, মাস্টারদা, আশফাকুল্লাহ, রামপ্রসাদ বিসমিল সহ আরও অনেকে নিজের যৌবন বাজি রেখে উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। সেই লড়াইয়ের মশাল আজ আমাদের হাতে।
গোটা দেশ জুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে ধারাবাহিক মুদ্রা স্মৃতির ফলে মুদ্রাস্ফীতির ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে এবং দেশীয় সম্পদের নির্বিচারে লুট চলছে দেশের অর্থনীতি কার্যত আম্বানি আদানিদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই কাজ করছে। এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে 'কর্পোরেট কমিউনাল নেক্সাস' দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই জন্যই প্রধানমন্ত্রী নিজেই রাজনীতি বা সমাজনীতির ক্ষেত্রে তীব্র সাম্প্রদায়িক বয়ান হাজির করছেন। জীবন জীবিকার ইস্যুর ক্ষেত্রে তীব্র যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মীয় মেরুকরণকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে। এই রাজ্যেও তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় আরএসএস ধারাবাহিকভাবে তাদের সাম্প্রদায়িক নোংরা ভাষ্যকে প্রচার করে চলেছে। বিভিন্ন সরকারি অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকারের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে রাজনৈতিক আনুগত্য। তীব্র কর্মহীনতা ও অধিকারহীনতার পরিবেশ যৌবনের শক্তিকে যথাযথভাবে সংগঠিত হতে দিচ্ছে না। এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুটি রুজির দাবিতে বিকল্প ভাষ্য তৈরি করা ভীষণ জরুরি।
ইনসাফ চাই। চুরির বিরুদ্ধে। স্বচ্ছভাবে স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে। গোটা দেশের সম্পদ বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে। জাত ধর্ম পোশাকের নামে লড়াইয়ের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশের আসল লড়াইটা এই ধর্ম বনাম ওই ধর্ম নয়, এই জাত বনাম ওই জাত নয়। দেশের মানুষের ঘাম, রক্ত, স্বপ্ন যারা লুটে খেতে চায় তাদের বিরুদ্ধে খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইটাই এই দেশ ও তার মানুষদের বাঁচানোর মূল লড়াই। দেশবেচার দালালদের বিরুদ্ধে দেশ বাঁচানোর প্রেসক্রিপশন এই ইনসাফ যাত্রা।
ইনসাফ চাইতে আগামী ৭ই জানুয়ারী যৌবনের ডাকে জনগণের ব্রিগেড হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই বাংলায় ব্রিগেড মেহনতি মানুষের লড়াই এর অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাজ, শিক্ষা, রুটি রুজির লড়াইয়ের বার্তা এই ব্রিগেডে উচ্চারিত হয়েছে। এই ব্রিগেড সাক্ষী থেকেছে সাম্প্রদায়িকতার নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের। আগামী ৭ জানুয়ারি এই ব্রিগেড সাক্ষী থাকবে জনতার আদালতের। জনতাই ঐদিন বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চোর চিটিংবাজ দাঙ্গাবাজদের শাস্তি ঘোষণা করবে।