দিনটি ছিল ২রা সেপ্টেম্বর। ২০১৫।
সেদিনও ধর্মঘট হয়েছিল। সর্বাত্মক। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ডাকা ধর্মঘট ‘ব্যর্থ’ করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যাবতীয় প্রশাসনিক হাতিয়ার ব্যবহার করেছিলেন। অস্ত্র হাতে সেদিন তান্ডব চালিয়েছিল তৃণমূলও। সেদিন বিকালে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর কিছু বক্তব্যের জবাব দিয়েছিলেন সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। তারই কিছু অংশ হোক আলোচনার মুখবন্ধ। মমতা ব্যানার্জিঃ ‘‘এই বন্ধকে আমরা চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারি। দিতে চাইও।’’
সূর্য মিশ্রঃ ‘‘ধর্মঘট শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকার। এই অধিকার সংবিধান দিয়েছে। উনি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করার কে? আমরা সরকারে থাকাকালীনও শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থে ধর্মঘটকে সমর্থন করতাম। ভবিষ্যতেও করব।’’
মমতা ব্যানার্জিঃ ‘‘কারখানায় নেগোশিয়েশন করে সমস্যা মোটানো যেতে পারে।’’
সূর্য মিশ্রঃ‘‘কারখানা বন্ধ থাকলে কার সঙ্গে আলোচনা হবে?’’
বন্ধ কারখানা এবং ধর্মঘটের সম্পর্ক আছে। পশ্চিমবঙ্গে তা প্রবল। বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি মালিক শুধু নন, রাজ্যের সরকারও কারখানায় ‘ওয়ার্ক সাসপেনশন’ বোর্ড ঝুলিয়ে রাখে — এমন উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গে আছে। তাই রাজ্যের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা এবং রুগ্ন সংস্থাগুলির শ্রমিক, কর্মচারীদের খিদে, যন্ত্রণাও বিচার্য ধর্মঘট প্রসঙ্গে। কিন্তু সে বিষয়ে তথ্য জরুরি। তাই বলব রাজ্যের বাজেট নথীর একটি মাত্র পাতার বিষয়ে — যে পাতাটি গত দশ বছরে ক্রমশঃ গুরুত্বহীন করে তুলেছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার — ঠিক নরেন্দ্র মোদীর সরকারের মত।
তাই বাজেট নথীর সেই পাতা থেকে ধর্মঘটের ইস্যুতে পৌঁছোতে চাই। অনেক কথা বলার নেই। শুধু সামান্য তথ্য আছে, বলার মত। স্পষ্ট হবে দুটি বিষয় — প্রথমত, রাজ্যে কেন ধর্মঘট দরকার। দ্বিতীয়ত, এই ধর্মঘট মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তো বটেই। কিন্তু একই সঙ্গে তা মমতা ব্যানার্জির সরকারের বিরুদ্ধেও! রাজ্য সরকারের একটি দপ্তর আছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কাল থেকে আছে। বামফ্রন্ট সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিত দপ্তরটিকে। এই গুরুত্বের পিছনে ছিল রাজ্যে শিল্পবিকাশ এবং শ্রমিক, কর্মচারীদের প্রাপ্য, অধিকার রক্ষায় সিপিআই(এম)-র দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাব। দপ্তরটির নাম — ‘পাবলিক এন্টারপ্রাইজেস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিকনস্ট্রাকশন।’ মোদ্দা বিষয় — রাজ্য সরকারের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলির উন্নয়ন এবং প্রয়োজনিয় পুনর্গঠন এই দপ্তরের দায়িত্ব। মমতা ব্যানার্জি দশ বছর সরকার চালিয়েছেন। এই দশ বছরের মধ্যে ৫ বছর এই দপ্তরের জন্য রাজ্য সরকারের বরাদ্দ ছিল ‘শূণ্য।’ রাজ্যের অর্থ দপ্তরের নথী বলছে, এই দপ্তরের জন্য ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ — এই পাঁচটি বছর একটি পয়সা বরাদ্দ করেনি রাজ্য সরকার। বাজেট নথী উল্টে দেখা যাচ্ছে দপ্তরের নাম আছে। তার কোন্ কোন্ খাতে টাকা বরাদ্দ হতে পারে তার উল্লেখ আছে। কিন্তু বরাদ্দের জায়গায় ‘শূণ্য।’ মমতা-শাসনে বাকি যে পাঁচ বছর টাকা খরচ হয়েছে রাজ্যের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা এবং শিল্প পুনর্গঠনের জন্য, তাতে মোট খরচ হয়েছে ২২৭ কোটি ৩৬ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা। এটিও আরও কমতে পারে। কারন, ২০২০-২১-এ শেষ পর্যন্ত এই দপ্তরের জন্য কত টাকা খরচ করল সরকার, তার চূড়ান্ত বিশ্লেষণ রাজ্য সরকার করেনি। বাজেট ‘রিভাইস্ড’ পর্যায়ে আছে। আর বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দু’বছর এই দপ্তরের জন্য খরচ হয়েছিল ২৩২কোটি ৩১ লক্ষ ১১ হাজার টাকা। তার মধ্যে ২০০৯-১০-এ এই দপ্তরের খাতে খরচ হয়েছিল ১৬৮ কোটি ২১লক্ষ ৮১ হাজার টাকা। অথচ ২০০৯-১০-এ রাজ্য জুড়ে তৃণমূল-মাওবাদী-বিজেপি-র নৈরাজ্য চলছে। তখনও বামফ্রন্ট সরকার রুগ্ন অথবা সচল রাজ্যের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলিকে রক্ষা করা, চালু রাখার চেষ্টা চালিয়েছে।
মমতা ব্যানার্জির ভূমিকার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
দূর্গাপুর কেমিক্যালস লিমিটেড(ডিসিএল) রাজ্যের একটি রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা। এখন বিপন্ন। ২০১৯-এর ডিসেম্বর থেকে। ডিসিএল’র ১০০ শতাংশ বিলগ্নিকরণ করে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। ২০১০-১১-তে এই কারখানার জন্য রাজ্য সরকার খরচ করেছিল ১৬ কোটি ৫০লক্ষ টাকা। ২০১৯-২০-তে কোনও টাকাই খরচ হয়নি। ২০২০-২১-এ বরাদ্দ করা হয়েছিল ৩৬ কোটি টাকা। অর্থ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এখনও পর্যন্ত ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তার মধ্যে কত খরচ হয়েছে, তা চূড়ান্ত নয়। ফল কী? নিজেদের কারখানায় ক্লোরিন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে এখন অন্য রাজ্যের কাছে হাত পেতেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। জীবাণুনাশক রাসায়নিক ক্লোরিন, সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড, কস্টিক সোডা সরবরাহের জন্য উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ওডিশার কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্য সচিব কয়েক মাস আগে। অথচ দুর্গাপুর কেমিক্যালস লিমিটেড (ডিসিএল) এসব উৎপাদন করে। রাজ্য সরকার সেখানে ওয়ার্ক সাসপেনশন জারি করে রেখেছে। গতবছর ২৯ ডিসেম্বর থেকে। মমতা ব্যানার্জি ধর্মঘটের বিরোধিতা করেন। আর তাঁর সরকার কারখানার গেটে ওয়ার্ক সাসপেনশনের নোটিস টাঙিয়ে রেখেছে। রাজ্যের বন্ধ ও রুগ্ন কারখানাগুলির জন্যও বরাদ্দ করে না মমতা ব্যানার্জির সরকার। যেমন, ২০২০-২১-এ ‘রিভাইভাল অব ক্লোস্ড অ্যান্ড সিক ইউনিট্স’ খাতে রাজ্য সরকার বরাদ্দ করেছিল ৩০লক্ষ ১ টাকা। এখনও পর্যন্ত ৫লক্ষ ১ টাকা খরচ হয়েছে!
অথচ মুখ্যমন্ত্রীর আরাধ্য চেয়ারে বসার আগে মমতা ব্যানার্জি কী বলেছিলেন? ২০১১-তে দলের নির্বাচনী ইশ্তেহারের ২৪ পাতায় মমতা ব্যানার্জি লিখেছিলেন,‘‘সর্বাগ্রে চেষ্টা হবে সম্ভাব্য বন্ধ ও রুগ্ন কারখানাকে বাঁচিয়ে তোলা। পশ্চিমবঙ্গে ৫৬ হাজার বন্ধ কারখানার ৪৪ হাজার একর জমিতে আগের কারখানার পুনরুজ্জীবন, নয়তো নতুন কারখানা করার উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থাৎ ‘শিল্পের জমিতে শিল্প’ — এই নীতিতে কাজ হবে।’’
কিছু হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা খোলা, রুগ্ন শিল্পের পুনরুজ্জীবনে মমতা ব্যানার্জি আর নরেন্দ্র মোদীর পথে তফাৎ নেই। তাই এই প্রশ্নে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে মমতা ব্যানার্জি চুপ। এই সুযোগে রাজ্যের একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বন্ধ করছে মোদী সরকার। উদাহরণ? বেঙ্গল কেমিক্যাল। সংস্থাটি লাভ করে চলেছে, ২০১৬-১৭ থেকে। তবু কেন্দ্রীয় সরকার এটি বিক্রি করার চক্রান্ত করেছে। এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেছে শ্রমিক ইউনিয়ন। তাই বেঙ্গল কেমিক্যাল বিক্রি আপাতত রুখে দেওয়া গেছে। সংস্থার শ্রমিক, কর্মচারীদের বকেয়া মেটানো হচ্ছে না। ২০০৭সাল থেকে ২০১৬-র মার্চের মধ্যে অবসর নেওয়া কর্মচারীরা প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা পাননি।
কিন্তু একটিও কথা নেই তৃণমূলের।
এমন উদাহরণ আরও আছে। যেমন, অ্যান্ড্রুইয়ুলের কলকাতার ইলেকট্রিক কারখানা। বন্ধ করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। কলকাতার খিদিরপুরের ময়ূরভঞ্জ রোড ও ট্রান্সপোর্ট রোডের দু’টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। গত পাঁচ বছর লাভ করেছে সংস্থাটি। ফলে অলাভজনক বলা যাবে না। আশঙ্কা কী? সংস্থার বিপুল জমি ও সম্পত্তি তুলে দেওয়া হবে বেসরকারি হাতে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাকড়া, বেহালার ঠাকুরপুকর-জোকা অঞ্চলে সংস্থার হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ জমিরও হাল একই হতে পারে। কিন্তু চুপ রাজ্যের তৃণমূল সরকার। ২৭শে সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে তাই রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলির পুনরুজ্জীবন প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই প্রশ্নে মোদী-মমতা ব্যানার্জির অভিন্ন পথের মুখোমুখি রাজ্যের শ্রমজীবীরা।
শেয়ার করুন