লোকসভা নির্বাচন-২০২৪ পাহাড় ও বনাঞ্চল ঘেরা নতুন জেলা: আলিপুরদুয়ার
নানা জাতি-উপজাতি, নানা ভাষা-উপভাষা, নানা কৃষ্টি-সাহিত্য- সংস্কৃতি, নানা ধর্ম, নানা সম্প্রদায় অধ্যুষিত এবং বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূখণ্ড আমাদের উত্তরবঙ্গ। তারই প্রান্তিক জেলা আলিপুরদুয়ার। উত্তরে সিনচুলাএবং সেখান থেকে ধেয়ে আসা সংকোশ, ডিমা, কালজানি এবং তোর্ষা প্রভৃতি পাহাড়ি নদীর কোলে দিগন্ত বিস্তৃত বনাঞ্চল বক্সা, জলদাপাড়া অভয়ারণ্য এবং তারই পাশে দুটি পাতা ও কুঁড়ির দেশ আমাদের আলিপুরদুয়ার। এই জেলার কৃষি অঞ্চল, বনবসতি অঞ্চল সহ বিস্তৃত চা বাগিচাএবং পাহাড়ি এলাকাতে এত জনজাতির মানুষের বসবাস যে, এই জেলাকে বিভিন্ন জনজাতির মানুষের মিলন ভূমি বলা হয়।যেখানকার আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায় মাদলের দ্রীম দ্রীম আওয়াজ, দোতরার লহরীতে উঠে আসে ভাওয়াইয়ার সুর, বাঁশরীতে বেজে ওঠে নেপালী লোকসংগীতের ধুন যা আমাদের আনমনা করে দেয়।
এ জেলার অর্থনীতি মূলত নির্ভরশীল টি-টিম্বার-ট্যুরিজমের ওপর।এই অর্থনীতিকে ভিত্তি করে আলিপুরদুয়ার লোকসভার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনপদ । যেমন- কুমারগ্রাম, বারোবিশা, কামাখ্যাগুড়ি, কালচিনি, হাসিমারা, হ্যামিলটনগঞ্জ, বীরপাড়া- মাদারিহাট, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা ইত্যাদি। এই লোকসভার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভারতীয় আর্য, দ্রাবিড়,অস্ট্রিক ও মঙ্গোলিয় -এই প্রধান চারটি ভাষা গোষ্ঠীর মানুষ এবং তার অন্তর্গত নানা বর্ণের ভাষা,উপভাষা, বিভাষা নানা অঞ্চলে প্রচলিত। এই ভাবেই চলেছে এই লোকসভার অন্তর্গত বিধানসভা ক্ষেত্রের সাংস্কৃতিক সংহতি ও ঐক্যের স্রোতধারা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়কালে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী বিশেষ করে যুগান্তর অনুশীলন সমিতির বীর বিপ্লবীরা ইংরেজ পুলিশের অত্যাচারে উত্তরবঙ্গে চা বাগিচার বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে এদের একটা বৃহত্তম অংশ লাল পতাকাকে আঁকড়ে ধরে বাগিচা শ্রমিকদের সঙ্গবদ্ধ করে শ্রেণী আন্দোলনকে পুষ্ট করে এসেছেন বছরের পর বছর।এর ছন্দপতন ঘটল ১৯৮৪ সালে। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার চলছে, তার জনমোহিনী কার্যকলাপ সরকারের ভিত্তিকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে চলেছে। চা বাগান গুলিতে পঞ্চায়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হলো। চা বাগানে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটল। ঠিক সেই সময় পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটল । তৎকালীন বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ আর রামধনু জোট তৈরি করে জনদরদী বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকম চক্রান্ত শুরু করল।
আসলে লালঝাণ্ডার আন্দোলন সংগ্রামকে বিরোধীরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে তারা ভয়ংকর চক্রান্তে লিপ্ত হলো। তাহলো ডুয়ার্স-তরাই ও পাহাড়ের মানুষের জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনের নামে জাতিগত আবেগ উসকে দিয়ে ভয়ংকর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মদত দিতে শুরু করল। ফলত: সেই সময় GNLF, আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, পরবর্তীতে গোর্খা জন মুক্তি মোর্চা, KLO, KPP প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন করে উঠল। তাদের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ফলে শ্রেণী আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী নেত্রীর নেতৃত্বে যে অশুভজোট তৈরি হয়েছিল উত্তরবঙ্গে এইসব বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিও সেই জোটে শামিল হয়ে পরিবর্তনের সরকার গঠন করেছিল। ঠিক একই রকম ভাবে ২০১৪ সালে মোদির নেতৃত্বে আর এস এস পরিচালিত বিজেপি একই রকম ভাবে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সাথে অশুভ বোঝাপড়া করে উত্তরবঙ্গের লোকসভা এবং বিধানসভা গুলিতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।আগামী ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ উত্তরবঙ্গের তিনটি লোকসভার আসনে নির্বাচন হতে চলেছে- এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র। এই লোকসভা কেন্দ্রটি সাতটি বিধানসভা নিয়ে গঠিত-তার মধ্যে কোচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ ও জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা অন্তর্ভুক্ত। গত ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী জন বারলা সাংসদ ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন। এই কেন্দ্রের মূল লড়াই সাম্প্রদায়িক বিজেপি ও আরএসএস পরিকল্পনার জন্ম নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জোটের। সারা দেশের সঙ্গে আমরা আলিপুরদুয়ার জেলার জনগণ ১০ বছরের মোদী শাসন প্রত্যক্ষ করলাম এবং সারা রাজ্যের সঙ্গে আমরাও জেলা বাসি ১৩ বছরের তৃণমূলের শাসনে দেশ রাজ্য বিপর্যস্ত, সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন ও অসহায়।
আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্র হল মিশ্র জনজাতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মিলনক্ষেত্র। এই জেলা মূলত বনাঞ্চল, চা বাগান নিয়ে গঠিত, যেখানে বেশিরভাগ জনজাতি মানুষের জীবিকার ক্ষেত্র এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এই জেলার পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে রয়েছে ৬৮ টি চা বাগান পাশাপাশি নাগরাকাটাতেও রয়েছে বেশ কিছু চা বাগান। লোকসভার অন্তর্গত মোট ১১৬ টি চা বাগান। এই মুহূর্তে কেন্দ্র ও রাজ্যের চক্রান্তে কালচিনি, রাইমাটাং, বেজপাড়া সহ প্রায় ১৫ টির বেশি চা বাগান বন্ধ।চা বাগানের মালিক কর্তৃপক্ষ ও তৃণমূল- বিজেপির আভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার ফসল হল এই বন্ধ চা বাগানগুলির শ্রমিকদের অসহনীয় দুর্দশা। ঢেকলাপাড়া ও কালচিনি চা বাগানে না খেতে পেয়ে অনাহারে মৃত্যু সারা রাজ্যকে নাড়িয়ে তুলেছে। এই বিষয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার উভয়েই নিশ্চুপ। চা বাগানের এই কর্মহীনতার ফলে বাধ্য হয়ে বহু শ্রমিক ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। চা- বাগিচার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যারা বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ আলোকিত করত তারা আজ পাচার হচ্ছে আর শিশুরা শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে।
রাজ্য সরকারের চা- সুন্দরী প্রকল্প শ্রমিক বঞ্চনার আরেকটি উদাহরণ। শ্রমিকদের বাড়ি পাওয়ার বদলে, জমির পাট্টার বদলে, তৃণমূল নেতাদের পকেট মোটা হচ্ছে। বাগানের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি বেহাল দশায় ধুঁকছে।আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন স্থানে দুই শাসক দল তৃণমূল ও বিজেপি আবার নতুন করে নতুনভাবে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে ভোট বৈতরণী পার করার জন্য। কিন্তু বর্তমান নির্বাচক মন্ডলী চা-বাগিচা শ্রমিক থেকে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তাদের জীবন যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরছেন এই শাসকদলের কাছে- যেমন:- ১)চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কেন ঘোষণা করা হলো না? ২) বন্ধ চা বাগান খোলার প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? ৩) চা শ্রমিকদের জমির পাট্টা দেবার প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল? ৪) শ্রমিকদের জমির পাট্টা দেবার অধিকার কোথায় গেল? ৫) চা- শ্রমিকদের PF, Gratuity এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কোথায় গেল?
তীব্র বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার আমাদের দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে জেলার বন বস্তির মানুষও। ফরেস্ট আমেন্ডমেন্ট বিল পাস করে সারাদেশের অরণ্য ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ ভূমি যেমন কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি এই আইনকে হাতিয়ার করে জয়ন্তী, বক্সা ভুটিয়া বস্তি সহ এক বিশাল অংশের বনবস্তি উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা চলছে। জেলার অন্যতম আকর্ষণ পর্যটন শিল্প আজ পরিকল্পনার অভাবে ধুঁকছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়েই নতুন পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনে ভীষণ অনিহা প্রকাশ করছে; ফলে কর্মসংস্থান দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। রাজ্যের ও কেন্দ্রের আইনের অজুহাত দেখিয়ে পর্যটন শিল্পকে পঙ্গু করে দেওয়ার চক্রান্ত যার ফলশ্রুতি দিন দিন ডুয়ার্সের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
আলিপুরদুয়ারের বিদায়ী সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বারলা, যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার অধিকাংশই তিনি পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তার কয়েকটি নমুনা- ** রেলের উদ্যোগে সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল তৈরীর ঘোষণা বাস্তবায়ন হয়নি। ** সাংসদের বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখলের অভিযোগ। ** লক্ষ্মীপাড়া চা বাগানে কান পাতলেই শোনা যায় মন্ত্রীর ফুলে ফেঁপে ওঠার নানা কাহিনী। ** বারংবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও হাসিমারা বিমানবন্দর তৈরি করতে ব্যর্থ। ** ২০১৯ সালে ঘোষিত কুমারগ্রাম, টোটোপাড়া,ফালাকাটার বড়ডোবায় তিনটি বড় সেতু তৈরী করার কথা- এক কোদাল মাটিও সেখানে পড়েনি। ** বক্সা ফোর্ট -এ ওঠা নামার রোপওয়ে তৈরির কথা ছিল - তা আজ রূপকথায় পরিণত। ** গত পাঁচ বছর সাংসদ থাকার সময়কালে তিনি একদিনও তুফানগঞ্জে পা দেয়নি বলে অভিযোগ।
আমাদের আলিপুরদুয়ারের বিদায়ী সাংসদের লোকসভার পারফরমেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস এন্ড ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ-এর বিচারে ৫৪৩ জন সাংসদ এর মধ্যে জন বার্লার স্থান ৪৭২ নম্বর। এই পাঁচ বছরে লোকসভার অধিবেশনে তিনি মোট উপস্থিত ছিলেন ১১০ দিন, যা মাত্র ৪০.৩ শতাংশ এবং সংসদে এই পাঁচ বছরে মোট প্রশ্ন করেছেন মাত্র ৩০ টি।
জেলায় বাম আন্দোলন গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। যেমন - আলিপুরদুয়ার রেলওয়ে ডিভিশনের গুরুত্বকে কোনভাবেই হ্রাস করা যাবে না। জেলার সর্বত্র জলাশয় দখল মুক্ত করা, বেহাল নিকাশি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় রেলওয়ে গেটের ওপর ওভার ব্রিজ তৈরি, জেলার বিভিন্ন স্থানে বাস টার্মিনাস নির্মাণ, সারা জেলাতে অবৈধভাবে বালি পাথর উত্তোলন বন্ধ করে স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া, জেলার বিভিন্ন স্টেশনে দূরপাল্লাগামী ট্রেনের স্টপেজ, পাশাপাশি একাধিক মহকুমা, পৌরসভা ও ব্লকের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। জেলার হাট গুলির আমূল সংস্কার করতে হবেl আলিপুরদুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রে আমাদের বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জোটের প্রার্থী আর.এস. পি. দলের কমরেড মিলি ওরাওঁ (যার প্রতীক কোদাল ও বেলচা)। যিনি নির্বাচিত হলে সংসদে আলিপুরদুয়ার জেলায় মেডিকেল কলেজ, রেলের কোচ ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্য সংসদে জোড় লড়াই চালাবেন। পর্যটন শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি বন্ধ চা বাগান খোলা, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, তাদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য ও আদিবাসী বনাঞ্চলের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেনl