শমীক লাহিড়ী
৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০। লখনউ-র সিবিআই এর বিশেষ আদালত, ২৮ বছরের পুরনো এক মামলার রায় দেয়। যে রায়ে ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় মূল অভিযুক্ত ৪৯ জনকে বেকসুর মুক্তি দেয়। বলা হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে এরা কেউ যুক্ত ছিলেন না। এমনকি এই ধ্বংস করার কাজ পূর্ব পরিকল্পিত নয়, ষড়যন্ত্রও নয়।
আদালতের ঐ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমারের বক্তব্য – এটা নাকি হঠাৎ ঘটে যাওয়া স্বতঃস্ফূর্ততার ফল। ২,৩০০ পাতার রায়ে বলা হয়- “মসজিদ ভাঙায় অভিযুক্তদের কারও হাত ছিল না। উন্মত্ত জনতাই এই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন। এর পিছনে সমাজবিরোধীদের হাতও ছিল। অভিযুক্তরা বরং মসজিদ ভাঙায় বাধা দেওয়ারই চেষ্টা করেছিলেন।”
বিচারক আরও বলেন- এই ৪৯ জন অভিযুক্ত নাকি মসজিদ রক্ষার জন্য খুবই চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মসজিদ ধ্বংসে আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কোনো ভূমিকাই ছিলনা।
তাই লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী, কল্যান সিং, উমা ভারতী সহ ৪৯ জনকেই বেকসুর মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা করেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার। এর মধ্যে ১৭ জন অবশ্য মামলা চলাকালীন অবস্থায় প্রয়াত হন।
তাহলে ভাঙলো কে? আদালতের মতে সমাজবিরোধীরাই এই কাজ করেছে। তারাই মসজিদ ভেঙেছে, তারাই ইঁট পাটকেল ছুড়েছিল।
কোনটা সত্য- স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষে নাকি সমাজবিরোধীদের আক্রমণে ভেঙেছিল মসজিদ? সমাজবিরোধীদের কিভাবে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা বলে চিহ্নিত করলো আদালত?
এখন প্রশ্ন- হঠাৎ করে দেড় লক্ষাধিক লোক ৬ই ডিসেম্বর নিজেরাই শাবল, গাঁইতি, কোদাল, বিশাল বিশাল দঁড়ি নিয়ে জড়ো হয়ে গিয়েছিল? এদের কেউ বা কোনও রাজনৈতিক দল বা মৌলবাদী শক্তি কি সত্যিই জড়ো করেনি?
বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী শক্তি বা দল তাহলে এর আগে সুপ্রীম কোর্টে হলফনামা দিয়ে, ৬ই ডিসেম্বর তাদের ডাকা সমাবেশ শান্তিপূর্ণই থাকবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল কেন? এর অর্থ এরাই করসেবকদের জড়ো করেছিল। এরপরেও বিচারপতি কিভাবে বলেন, এটা পরিকল্পিত ঘটনা নয়?
‘জনরোষ স্বতঃস্ফূর্ত’ ছিল নাকি দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল ছিল?
পরিকল্পনা স্বাধীনতার সময় থেকে
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট দেশের স্বাধীনতা। সংবিধান রচনার সময়েই স্পষ্ট হয়ে যায়, ভারতবর্ষ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র রূপেই গড়ে তুলতে চায়, পাকিস্তানের মতো মৌলবাদ নিয়ন্ত্রিত ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। ফলে প্রথম থেকেই নানাভাবে হিন্দু মৌলবাদী শক্তিগুলো নানা ফন্দিফিকির আঁটতে থাকে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য। এরই অংশ হিসাবে ১৯৪৯ সালেই রাতের অন্ধকারে বাবরি মসজিদে একটি বালক রামের মূর্তি (রাম লালা) কেউ রেখে দিয়ে যায়।
পরদিন ভোর থেকেই রটানো শুরু হয়- রাম নাকি নিজেই নিজের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন ভারতে সেই শুরু করা হয় পরিকল্পনা মাফিক বাবরি মসজিদ বিতর্ক। ফলে পরের দিনই শান্তি রক্ষা করার জন্য মসজিদে তালা লাগায় স্থানীয় প্রশাসন।
১৫২৮ সালে বাবরি মসজিদ স্থাপনার ৩৫৭ বছর পরে হঠাৎ কার অনুপ্রেরণায় এই মসজিদকে রামের জন্মস্থান হিসাবে দাবী করে মামলা করা হয়েছিল, সেটা অবশ্যই গবেষণা স্বাপেক্ষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে কেঁপে যাওয়া ব্রিটিশ শাসকরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি নিজেদের হাতে শাসন ক্ষমতা নিয়ে নেয়। একদিকে নির্বিচার হত্যা ও অত্যাচার, অন্যদিকে ভারতের মানুষকে ধর্মের নামে বিভক্ত করে দাও – এই নীতিই গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা।
মামলার ক্রমবিবর্তন
পরে এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ৩টি মামলা হয়।
১) ১৯৫০ সালে রামচন্দ্র দাস এবং আরও কয়েকজন রামলালার মূর্তিটি যথাস্থানে রক্ষা করা এবং সেখানে পূজা অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়ে একটা মামলা করেন।
২) ১৯৫৯ সালে ‘নির্মোহী আখড়া’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান রাম মন্দির নির্মাণের জন্য মসজিদের পুরো সম্পত্তির দখল চেয়ে একটা মামলা করে।
৩) ১৯৬০ সালে মুসলিম ওয়াকফ্ বোর্ড মসজিদের সম্পত্তির সম্পুর্ণ দখল চেয়ে পৃথক একটা মামলা করে।
এর আগে অবশ্য ১৮৮৫ সালে রঘুবীর দাস নামে এক পুরোহিত রামের জন্মস্থান দাবী ক’রে বাবরি মসজিদ চত্বরের পাশে একটা অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করে, সেখানে পূজা করার অনুমতি চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতে একটা মামলা শুরু করে।
১৯৮৬ সালে স্থানীয় আদালত একটি অর্ন্তবর্তী মামলার রায়ে হঠাৎই মসজিদ চত্বরের তালা খুলে দিতে বলে সেখানে রামলালার পুজো করার জন্য। কিন্তু এই রায়ের বিরুদ্ধে আশ্চর্যজনকভাবে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ বা কেন্দ্রীয় সরকার কেউই উচ্চ আদালতে যায়নি। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই সংক্রান্ত সবকটি মামলার প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ মামলার রায় দেয়। এই রায় অনুযায়ী বাবরি মসজিদের সম্পত্তিকে ৩ ভাগে ভাগ করে দেয় – নির্মোহী আখড়া, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এবং রামলালার মধ্যে।
ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের রক্ষাকর্তা আদালত স্বাধীনতার পর প্রথম কোন রায়ে একটি পৌরাণিক চরিত্রকে সম্পত্তির মালিকানা সংক্রান্ত বিবাদে একটি পক্ষ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সেই শুরু, যার অবসান ঘটে ২০১৯ সালের ৯ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে। যে রায়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাকে অবৈধ বলা হয়, কিন্তু সমগ্র জমি প্রস্তাবিত রাম মন্দির তৈরী করার জন্য সরকার মারফৎ সংশ্লিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের নেপথ্যে
২৩ শে নভেম্বর, ১৯৯২। দিল্লীতে জরুরী ভিত্তিতে ডাকা হয়েছিল জাতীয় সংহতি পর্ষদের সভা। এই সভায় তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও সিপিআই(এম) পার্টির সাধারণ সম্পাদক হরকিষাণ সিং সুরজিৎ উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সাথে। অবশ্য বিজেপি’র কেউ উপস্থিত হয়নি। সভায় জ্যোতি বসু ও সুরজিৎ দু’জনেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাওকে বলেন, দেশের সংবিধানে রক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে যে কোনও মূল্যে বাবরি মসজিদকে ধ্বংসের করার ষড়যন্ত্রকে রুখতেই হবে। তার জন্য প্রয়োজনে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে সেই সময়ের কল্যাণ সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি’র রাজ্য সরকারকে ভেঙে দিতে হবে। জ্যোতি বসু বলেছিলেন, সিপিআই(এম) দল, বরাবর ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের বিরোধিতা করলেও, দেশের সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থেই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করার পক্ষে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী মত দিচ্ছে। নরসিংহ রাও যখন তাঁদের বলেন, হিন্দুত্ববাদীরা সুপ্রীম কোর্টে হলফনামা দিয়ে শান্তি বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তখন প্রত্যুত্তরে জ্যোতি বসু বলেন, এদের বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
৬ই ডিসেম্বর – ঘটনাক্রম
জ্যোতি বসুর কথা যে কতটা সত্য ছিল তা ৬ই ডিসেম্বরের ঘটনায় প্রমাণিত হয়ে যায়। ৬ই ডিসেম্বর সকালে দেড় লক্ষাধিক উন্মত্ত ও সশস্ত্র করসেবক বাড়ি ভাঙার প্রস্তুতি নিয়ে উপস্থিত হয়। এই খবর পেয়ে সেদিন দুপুরেই জ্যোতি বসু আবার প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন। তার আগে ৪ঠা ডিসেম্বরেও তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে উদ্বেগ প্রকাশ করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু কার্যত বিনা বাধায় হিংস্র করসেবকরা বিকাল ৫টার মধ্যে বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করে দেয়। এই দিনের বিস্তারিত বিবরণ বহু প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক তাঁদের রিপোর্টিয়ে উল্লেখ করেছেন, যার থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল পরিকল্পনা মাফিক ষড়যন্ত্র করেই।
দু-তিন দিন আগে থেকেই করসেবকরা সেখানে জড়ো হতে থাকে। ৬ই ডিসেম্বর করসেবা করা হবে বলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বহু আগে থেকেই প্রচার সংগঠিত করা শুরু করে। সুপ্রিমকোর্টে হলফনামা দিয়ে এরা জানায়, অযোধ্যায় করসেবকরা কেবলমাত্র করসেবা অর্থাৎ ‘পূজন-ভজন’ করার জন্যই শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হবে। আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণভাবে বজায় থাকবে। দু:খের কথা সর্বোচ্চ আদালত এদের কথা বিশ্বাস করে এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারও এদের কথায় ভরসা রাখে।
৬ই ডিসেম্বরের আগের রাত থেকেই হাজার হাজার করসেবক অযোধ্যায় জড়ো হতে থাকে। ভোর ৫টার মধ্যেই কার্যত অযোধ্যা শহরের দখল নিয়ে নেয় এরা। এদের গন্তব্যস্থল ছিল বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণ। অথচ সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া হলফনামায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি জানিয়েছিল যে সরযূ নদীর ধারে করসেবকরা সমবেত হবে। বাবরি মসজিদ চত্বরে রামলালার পূজার জন্য সামান্য কয়েকজন পূজারী প্রবেশ করবেন এবং পূজা শেষে বেরিয়ে আসবেন। ‘রামকথা কুঞ্জ’ অর্থাৎ করসেবার স্থল সংলগ্ন একটি বিশাল মাঠে অফিস থাকবে। তার পাশের মাঠে কংক্রিটে বাঁধানো স্থানে সরযূ নদীর বালি নিয়ে ছোট ছোট গ্রপে করসেবার স্থলে করসেবকদের পাঠানো হবে। কিন্তু সরয়ূ নদীর ধারে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সব করসেবক সমবেত হতে থাকে করসেবার স্থলেই। আরএসএস-এর পোশাক পড়া স্বেচ্ছাসেবকরাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ছিলেন।
ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন
সকাল ১০টা নাগাদ সুপ্রিমকোর্টের নিযুক্ত পর্যবেক্ষক সাংবাদিকদের জানান – Everything is fine অর্থাৎ সব কিছুই ঠিক আছে। সেখানেই বেনারসের বিজেপি সাংসদ শ্রীশচন্দ্র দীক্ষিত, যিনি একসময় উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ডিজি ছিলেন, তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ফৈজাবাদ ডিভিশনের তৎকালীন কর্মরত ডিআইজি উমাশংকর বাজপেয়ীকে। এর থেকে বোঝা যায় কেন বাবরি মসজিদ পাহারায় থাকা কয়েক হাজার পুলিশ সমগ্র ঘটনায় নীরব দর্শক ছিল।
বেলা ১২.১৪ মিনিটে পূজো শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু সকাল ১১টার মধ্যে এলাকার সম্পূর্ণ এলাকার দখলদারী নিয়ে নেয় উন্মত্ত সশস্ত্র করসেবকরা। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার তৎকালীন সাংবাদিক লিখছেন – ‘আমরা এইমাত্র (সকাল ১১টা) পিছন দিক থেকে আসছি। ওখানে গাঁইতি শাবল হাতুড়ি আর মোটা দড়ি নিয়ে কয়েকশত করসেবক জড়ো হয়েছে’। বাড়ী ভাঙার উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই করসেবকদের নিয়ে আসা হয়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি পত্রিকার সাংবাদিক এস এন এন আবদি লিখেছিলেন – তখনই মনে হয়েছিল বাবরি মসজিদ অক্ষত থাকবে না।
আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক দেবব্রত ঠাকুরের বর্ণনা অনুযায়ী – মহারাষ্ট্রের বারামতি জেলা থেকে আগত করসেবক শংকর তাঁকে বলছেন, আদালতের আদেশ মানিনা। আমাদের নিয়ে প্রত্যেকবার রাজনীতি হচ্ছে। বারবার ডেকে ফেরত পাঠাচ্ছে নেতারা। এবার একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। …. উন্মত্ত করসেবকরা বিতর্কিত কাঠামোর দিকে বন্য বাইসনের মতো ধেয়ে আসছে। শুরু হয়ে গেল গুটিকতক দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের ওপর ইট বৃষ্টি। …. ডান পাশের গম্বুজের মাথায় সেই অন্ধ্রপ্রদেশের দুই প্রতিনিধি।
তাঁরই রিপোর্ট অনুযায়ী পুলিশের এসএসপি ডি বি রাইয়ের টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ার নির্দেশ অমান্য ক’রে উত্তর প্রদেশ পুলিশ বাবরি মসজিদ এলাকা ছেড়ে চলে যায়। এমনকি সিআরপিএফ-এর দলও এলাকা ছেড়ে চলে যায়। বেলা ১২টায় মসজিদের প্রথম গম্বুজ ভেঙ্গে ফেলা হয়। বিকাল ৪.৪৯ মিনিটের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয় বাবরি মসজিদ। এই সমগ্র ঘটনার সময় সম্পূর্ণ উপস্থিত ছিলেন এল কে আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী, অশোক সিঙ্ঘল, কে সুদর্শন সহ বিজেপি ও আরএসএস-এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। প্রথম দিকে করসেবকদের মসজিদ ধ্বংস না করতে আবেদন করলেও বেলা ১২টার পর থেকেই উমা ভারতী, স্বাধ্বী ঋতাম্ভরা মাইকে শ্লোগান দিতে থাকেন – এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো।
তাহলে মসজিদ ভাঙল কে?
যাদের উপস্থিতিতে এই সৌধ ভেঙে ফেলা হল, যারা উসকানি মূলক শ্লোগান দিলেন তাঁরা কিভাবে বেকসুর খালাস পেলেন? এই জন্যই আদালতে ৪৯জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস দেবার পর এই প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই গোটা দেশে উঠেছিল – কেউ দোষী না হলে, বাবরি মসজিদ ভাঙল কে? সশস্ত্র সমাজবিরোধীরা পরিকল্পিতভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও বাড়ী ভাঙার সরঞ্জাম সহ উপস্থিত হয়েছিল ভজন-পূজন করবার জন্য? বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির গড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৯০ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর তৎকালীন বিজেপির সভাপতি এল কে আদবানী ঘোষনা করেছিলেন ২৫শে সেপ্টেম্বর থেকে দেশজুড়ে রথযাত্রা হবে। সেই অনুযায়ী দেশজুড়ে করসেবকদের জড়ো করার কাজ শুরু হয়েছিল। এর পরেও কিসের ভিত্তিতে আদালত বলতে পারে যে, এটা পরিকল্পিতভাবে ভাঙা হয়নি, এটা স্বত:স্ফুর্ত জনরোষের ফল?
বাবরি মসজিদ ভাঙার পর নরসিমা রাওয়ের সরকার বিচারপতি লিবারহান এর নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বার করবার জন্য। এই কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু ১৯৯৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী কলকাতায় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং এর বক্তব্যের রেকর্ডিং জমা দেন। এই বক্তৃতায় কল্যান সিং মসজিদ ভাঙায় তাঁর উল্লাস প্রকাশ করে বলেন – আমরা যদি শ্রমিকদের দিয়ে মসজিদ ভাঙার উদ্যোগ নিতাম তাহলে দেড় মাসেরও বেশি সময় লাগত। কিন্তু করসেবকরা মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এই কাজ সম্পন্ন করেছে। আমি আনন্দিত এবং গর্বিত। এই রেকর্ডিং শোনার পরেও কিসের ভিত্তিতে আদালত কল্যান সিং কে নির্দোষ ঘোষণা করে?
অসভ্য বর্বর
১৯৯৯, ২০শে মার্চ কলকাতায় এসেছিলেন তৎকালীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাথে সেইদিন রাজভবনে প্রশাসনিক বৈঠকের সময় অটল বিহারী বাজপেয়ী তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন – আপনি কেন বারবার বিজেপিকে অসভ্য বর্বর বলেন? উত্তরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন – যারা পরিকল্পিতভাবে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলে দেশে দাঙ্গা লাগায় তাদের আর কি বলা যায়! সেদিন বাজপেয়ী তাঁকে বলেছিলেন – এটা একটা দুর্ঘটনা, সংগঠিতভাবে এটা করা হয়নি। অথচ তারপর বহুবার বাজপেয়ী বলেছেন – বাবরি মসজিদ ভাঙার সাথে জাতীয় আবেগ যুক্ত। তার মানে এই আবেগকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবেই এই সংগঠিত অপরাধ করা হয়েছিল।
ভারতবর্ষকে হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রথম সফল পদক্ষেপ ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংস। ধ্বংসের অব্যবহিত পরেই দেশজোড়া দাঙ্গায় ২ হাজারেরও বেশি মানুষ খুন হয়। এরপর গুজরাটে পরিকল্পিত সংগঠিতভাবে দাঙ্গা লাগানো হয়। তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদী সরকারের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এই দাঙ্গায় ৭৯০ জন মুসলমান খুন হয়েছিল। এছাড়াও ২৫০০জন গুরুতর আহত হয়েছিল, ২০ হাজার মুসলমানের ঘরবাড়ী ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। দেড় লক্ষাধিক মানুষ নিজের বাড়ী-ঘর-পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই দাঙ্গা নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল অবশ্য ১৯২৬ জনকে খুন করা হয়েছিল বলে জানায়। আসলে এটা দাঙ্গা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত ও সংগঠিত গণহত্যা।
কোন হিন্দুর লাভ?
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিষাক্ত সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষকে বিভক্ত করার কাজ চালিয়ে আসছে বিজেপি। উদ্দেশ্য একটাই – হিন্দুত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন। হিন্দুত্ব আর হিন্দু ধর্ম এক নয় – একথা নিজেই বলেছিলেন গোলওয়ালকর। হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, আসলে ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করার একটি প্রকল্প। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে কি হিন্দু শ্রমিকের মজুরী বাড়বে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ সব মানুষের জন্য খাদ্য-বাসস্থান-কাজ-শিক্ষা- চিকিৎসার সুযোগ তৈরী হবে? হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী আদানী-আম্বানি সহ বৃহৎ পুঁজিপতিরা কি হিন্দু ধর্মাবলম্বী শ্রমিকদের শোষণ করা বন্ধ করে ভজন-পূজন করবে?
এর কোনটাই হবে না, আরএসএস- বিজেপি হিন্দুত্ববাদীদের প্রস্তাবিত হিন্দু রাষ্ট্রে। আসলে হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষমতায় এনে, দেশের সম্পদ ও জনগণকে অবাধ লুঠ করার জন্যই হিন্দু রাষ্ট্রের অবতারনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্যও ‘হিন্দুত্ববাদী মোদীজি’ পেট্রোল- ডিজেল- কেরোসিন-গ্যাস-ভোজ্যতেল সহ সব জিনিষের দাম বাড়িয়েছেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষের এতে কোনও উপকার হয়েছে? বরং এরফলে আদানী-আম্বনি সহ বৃহৎ পুঁজিপতিদেরই উপকার হয়েছে। তাই হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আদানী-আম্বানিরাই শুধু হিন্দু, সাধারণ মানুষ নয়।
আসলে পাকিস্তান যেমন মুসলিম মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তেমনই হিন্দু মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষকে একটা দাঙ্গা-সন্ত্রাস বিধ্বস্ত দেশে পরিণত করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি।
তাই শান্তি-গণতন্ত্র প্রিয় মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা ও রাখার লড়াই নিরন্তরভাবে চালিয়ে যাওয়াই এখন মূল কাজ।