পর্ব ১২
নিঃশর্ত জমির অধিকারী নয়, বাস্তুহারাদের ‘দখলদার’ করছেন মমতা
বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে দপ্তরটির নাম ছিল ‘উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তর।’ তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের আমলে দপ্তরটির নাম হয়েছে ‘ভূমি ও ভূমিসংস্কার এবং শরণার্থী পুনর্বাসন দপ্তর।’
দুটি বদল ঘটিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। প্রথমত, উদ্বাস্তুদের সমস্যা সংক্রান্ত দপ্তরটিকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন ভূমি ও ভূমিসংস্কার দপ্তরের সঙ্গে। ‘উদ্বাস্তু পুনর্বাসন’-র পৃথক দপ্তরের গুরুত্ব নেই মমতা-শাসনে। দ্বিতীয়ত, ‘উদ্বাস্ত’ শব্দটি তুলে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। তার বদলে বসিয়েছেন ‘শরণার্থী।’ যদিও এখন ‘উদ্বাস্তু পুনর্বাসন’ কোথাও কোথাও লেখা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। ‘শরণার্থী’ শব্দটি রাষ্ট্রীয় স্ববংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং বিজেপি-র। মুসলমানরা ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং হিন্দুরা ‘শরণার্থী’ — এই হলো সঙ্ঘের ধারনা। সঙ্ঘের এই শব্দটি জুড়ে, দুটি দপ্তর মিলিয়ে দপ্তরটির এতবড় নাম হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে — ‘ভূমি ও ভূমিসংস্কার এবং শরণার্থী পুনর্বাসন দপ্তর।’ দপ্তরের মন্ত্রী — মমতা ব্যানার্জি।"
দপ্তর হলো। কাজ কী হলো?
২০১৯-র ২৭ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রীর সভা ছিল উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে। বাস্তুহারাদের উদ্দেশ্যে সেদিন তাঁর বাণী ছিল, ‘‘কোনও চিন্তা করবেন না। আমাকে সব চিন্তা দিয়ে দিন।’’
দেড় মাস পরে জানা গেলো, তিনি আদৌ নেননি। দুশ্চিন্তা আরও চাপিয়ে দিয়েছেন বাস্তুহারাদের কাঁধে। উল্লেখ্য, একাধিকবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কখনও রাজ্যের উদ্বাস্তুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনও সহযোগিতা করেননি। এখন সব দুশ্চিন্তার ধারক হওয়ার ঘোষণা করলেন, তাও প্রায় ন’ বছর সরকার চালানোর পর। বিজেপি সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের পর অনেকের মধ্যেই নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কা চড়িয়েছে। বিশেষত আসামের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। মূলত সংখ্যালঘুদের তাড়ানোর লক্ষ্যে মোদীর এই আইন হলেও অনেক হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষও বাদ পড়েছেন তালিকায়। এই অবস্থায় জমির অধিকার প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই রাজ্যেও। মমতা ব্যানার্জি এই ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমেছেন। অথচ এই আইনের সংশোধনী যখন শুরু হয় বাজপেয়ী আমলে, তখন তার শরিক ছিল তৃণমূল কংগ্রেস।
কিন্তু কী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস বাস্তুহারাদের জন্য, গত সাড়ে ন’ বছরে?
মুখ্যমন্ত্রী এ’ কথা মুখে জানাননি। জানিয়েছে তাঁর সরকার, লিখিতভাবে। ২০২০-২১-র বাজেট পেশ হয়েছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে। বাজেটের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে ফেলে আসা বছরে রাজ্য সরকারের কাজের খতিয়ানের দাবি — আর্থিক সমীক্ষা-২০১৯-২০। আর সরকার স্বীকৃত নিজেদের কাজের সেই পর্যালোচনায় অত্যন্ত তুচ্ছ আকারে ছাপানো হয়েছিল একটি তথ্য। গত বছরটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার বাস্তুহারাদের ১৩১১টি নিঃশর্ত দলিল(ফ্রী হোল্ড টাইটেল ডীড-এফএইচটিডি) বিলি করেছে। লক্ষ্যমাত্রা কত ছিল? তা লেখা নেই। সেটি জানতে দেখতে ঠিক তার আগের বছরের আর্থিক সমীক্ষা। সেখানে লেখা ছিল — ‘‘১০,৩১৪টি নিঃশর্ত দলিল দেওয়া বাকি আছে। তা দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাবে ২০১৯-র মধ্যে।’’
অর্থাৎ ঘোষনার ১২.৭১ শতাংশের কাজ করেছে ভূমি ও ভূমিসংস্কার এবং শরণার্থী পুনর্বাসন দপ্তর।
এখানেও যদি থামা যেত, ভালো হত। কিন্তু — না। এবারের আর্থিক সমীক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৫,৪৮১টি নিঃশর্ত দলিল বিলি হবে আগামী বছরে। কিন্তু কী করে হবে? গতবারই তো সরকার জানিয়েছে, বাকি থাকা নিঃশর্ত দলিলের সংখ্যা ১০,৩১৪! হঠাৎ তা প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে গেলো কী করে? যে প্রায় ১৫,১৬৭টি পাট্টার কথা সরকার গতবছর গোপন করেছিল, তার উদ্দেশ্য কী? বাস্তুহারাদের জমি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসীদের কোনও বিশেষ পরিকল্পনা ছিল কী?
মমতা ব্যানার্জি ইদানিং দাবি করছেন যে, তিনি যখন যাদবপুরের সাংসদ ছিলেন তখন উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত জমির দলিল দেওয়া শুরু হয়। তিনি বলছেন,‘‘উদ্বাস্তুরা যে নিঃশর্ত জমির দলিল পাচ্ছেন, সেটি আমি করে দিয়েছিলাম।’’
জেনেশুনে ভুল বলেছেন তিনি। কারন, তাঁরই আওতায় থাকা তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের নথী জানাচ্ছে, ১৯৭৮ থেকে রাজ্যে উদ্বাস্তুদের নিঃশর্ত দলিল দেওয়ার কাজ শুরু হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোনও সুবিধা না পাওয়া সত্বেও এই কাজ হয়েছে। শুধু ২০০৬-র ৩১ মার্চ পর্যন্তই ২,৩৯,৪৭৯টি নিঃশর্ত দলিল দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে আরও ১৭,৮৩৮টি দলিল দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রাজ্য সরকার ঠিক করেছিল। কিন্তু আইনী জটিলতার কারনে দেওয়া যায়নি। পরবর্তীকালেও এই কাজ চলেছে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারগুলির কাছে বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বাস্তুহারাদের পুর্বাসন, জমির পাট্টার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য দাবি জানানো হয়। কিন্তু সহায়তা মেলেনি। এই সরকারগুলির বেশ কয়েকটিতে মমতা ব্যানার্জি মন্ত্রী ছিলেন।
তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার এখন উদ্বাস্তুদের পাট্টা দেওয়া শুরু করেছে। কিন্তু তা বামফ্রন্ট সরকারের মত ‘নিঃশর্ত’ নয়। চলতি বছরের গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকার আরেকটি দলিলের বয়ান প্রকাশ করেছে। তার সরকারী নোটিফিকেশন অর্ডার নম্বর -১৮৫, ১৫.৯.২০২০। তাতে আগের দলিলের বয়ানের পরিবর্তন করা হয়েছে।। যেমন, প্রথমত, DONOR বা দাতা (রাজ্য সরকার মালিক হয়ে ) বদলে হয়ে গেছে EXECUTOR(রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত বহনকারী )। দ্বিতীয়ত, DONEE বা গ্রহীতা (যাকে জমি দেওয়া হচ্ছে) পালটে হয়ে গেছে POSSESSORS। অর্থাৎ দখলকার। তৃতীয়ত, Acquired land বা অধিগৃহীত জমির বদলে হয়ে যাচ্ছে Notified land বা ঘোষিত জমি। চতুর্থত, জমি হস্তান্তরের অধিকার সূত্র (জমি অধিগ্রহণ কোনও আইনে হয়েছে এবং কিভাবে, কবে হস্তান্তর হয়ে সরকার মালিক হয়েছে যার ভিত্তিতে রাজ্য সরকারের দানপত্র করার অধিকার জন্মেছে )। পঞ্চমত, Government to make a gift of the said plot-র বদলে হয়ে গেছে Government to execute a deed for the said plot অর্থাৎ দানপত্র নয় সিদ্ধান্ত জানানো সংক্রান্ত দলিল।
গত ৬ নভেম্বর রাজ্য সরকার একটি নির্দেশিকা জারি করে। রাজ্যের সব জেলা শাসকদের কাছে উদ্দেশ্যে জারি করা নির্দেশিকায় (2243/RR/2P-25/2020) সরকার জানিয়ে দিয়েছে, নিঃশর্ত দলিল লেখা হলেও আসলে ‘দখলদার’ বলে জমির কাগজ দেওয়া হচ্ছে। দলিলের কাগজে কী লেখা থাকছে? লেখা হবে ‘এফএফটিডি(ফ্রি হোল্ড টাইটেল ডিড) মূলে দং’। এই শব্দই আসলে ফারাক করে দিয়েছে নিঃশর্ত দলিলের তকমা। ‘মূলে দং’এর অর্থ হলো মূলগতভাবে দখলদার। ১৯৬৫-তে কেন্দ্র-রাজ্যের তৎকালীন সরকার বলেছিল, ৯০ বছরের লিজযুক্ত শর্তসাপেক্ষ দলিল দেওয়া হবে। সিপিআই(এম) প্রত্যাখ্যান করেছিল। ইউসিআরসি বলেছিল চাই নিঃশর্ত দলিল। সেই দলিল হলো বামফ্রন্ট সরকার আসার পর। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে উদ্বাস্তুদের দেওয়া হত নিঃশর্ত দলিল। তখন দলিলের কাগজেও মন্তব্যের কলাম ছিল। সেখানে লেখা থাকত, ‘রায়তি’। এখন তৃণমূল কংগ্রেস যাঁদের জমির কাগজ দিচ্ছে নির্বাচনের আগে, তাঁরা হচ্ছেন ‘দখলদার।’ দুই সরকারের নিঃশর্ত দলিলের এই ফারাকই বুঝিয়ে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার ও বেসরকারি জমিতে গড়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দাদের সঙ্গে কার্যত প্রতারণা করছে মমতা ব্যানার্জির সরকার।
আবার উদ্বাস্তুদের নিয়ে চালাকি করছেন মমতা ব্যানার্জি।
প্রশ্ন উঠে গেছে — প্রথমত, ব্যক্তি মালিকানার জমি বা কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার জমি অনুমোদন ছাড়াই বা অধিগ্রহণ, হস্তান্তর ছাড়াই শুধুমাত্র মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজ্য সরকার কোনও ব্যক্তিকে কী ভাবে দিতে পারে? দ্বিতীয়ত, মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত রেজিস্ট্রি করে রূপায়িত করা কি দলিল (স্বত্বের) হিসাবে বা দানপত্র হিসাবে বিবেচিত হতে পারে? তৃতীয়ত, জমির বর্তমান মালিক যদি ‘দখলদার’কে জমি থেকে উৎখাত করতে চায় বা উচ্ছেদ করতে চায় আদালত কী রক্ষাকবচ হিসাবে গ্রহণ করবে? চতুর্থত, প্রয়োজনে উদ্বাস্তুরা কি এই জমি হস্তান্তর করতে পারবে? এই জমির ভিত্তিতে তিনি কী ঋণ পাবেন? পঞ্চমত, কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃত একটি স্থায়ী স্বত্বের দলিল বয়ান থাকা সত্ত্বেও আরেকটি অস্বচ্ছ দলিল কেন?
বাস্তুহারাদের জমির অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সহায়ক বামপন্থীরা। ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। কেন্দ্রীয় সরকারে থাকাকালীন মমতা ব্যানার্জি কোনও সাহায্য করেননি। বিজেপির সরকারও কখনও এদের পাশে দাঁড়ায়নি। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার স্বীকার করছে প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার দলিল দিতে হবে। গত বিগত সাড়ে ন’ বছরে সুযোগ ছিল। করেননি। দরকার ছিল বকেয়া কলোনির স্বীকৃতির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কলোনি তালিকা পেশ করে উদ্বাস্তু দাবি আদায়ের চেষ্টা করা। উচিত ছিল বকেয়া কলোনি উন্নয়ন,দলিল- পরচা দেওয়ার কাজের পরিকল্পনা করা। বামফ্রন্ট সরকারের মতো উদ্বাস্তুদের আইনগত নাগরিক অধিকার ও স্বত্ব দেওয়ায় উদ্যোগী হওয়া।
কিছুই করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। এখন রাজ্যের উদ্বাস্তদের আবার ভাঁওতা দেওয়ার পথ নিয়েছেন এই প্রশ্নে বিজেপির পক্ষপাতি তৃণমূল কংগ্রেস।
ধারাবাহিক চলবে....
শেয়ার করুন