পর্ব ১১
রাজ্যকে পথে বসিয়েছেন মমতা
এক বছরে রাজ্যের একজন খেতমজুরের মজুরি বেড়েছে ৪ টাকা!
একবছরে খেতমজুরসহ যে কোনও একজন রাজ্যবাসীর মাথার উপর ধার বেড়েছে ৩৬৬০ টাকা ৫০ পয়সা!
বামফ্রন্ট নয়। বলছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, তার গত অক্টোবরের রিপোর্টে। কিন্তু তাতে কী হুঁশ ফিরেছে তৃণমূল কংগ্রেসের? ‘সবুজসাথী’-র সাইকেল বিলি প্রকল্প বলছে — না।
আবারও ২০লক্ষ সাইকেল কেনার বরাত দিয়েছে রাজ্য সরকার। বিধানসভা নির্বাচনের আগে তা বিলি হবে। এই নিয়ে প্রায় ১ কোটি সাইকেল রাজ্য কিনছে। সরকারের কোষাগার থেকে এই বাবদ গেছে ৪০০০ কোটির বেশি টাকা। কিন্তু এবারও স্থানীয় সাইকেল তৈরির কারখানার কোনও সংস্থা সুযোগ পায়নি। রাজ্যে সাইকেল কারখানা তৈরির কোনও উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হয়নি। কোনও বিনিয়োগকারীকে ডেকে আনার কোনও চেষ্টা হয়নি। ১কোটি সাইকেল বিলি হচ্ছে — কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ — রাজ্যের কোনও লাভ নেই!
এই হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। পশ্চিমবঙ্গকে আর্থিকভাবে ধ্বংসের দোরগোড়ায় এনে হাজির করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। গত সাড়ে ন’ বছরে চাপ বেড়েছে সাধারনের উপর। ২০১০-এ মমতা ব্যানার্জি যখন থালা বাজিয়ে ‘এত দাম খাবো কী’ স্লোগান তুলেছিলেন, তখন রাজ্যের চালের দাম ছিল ১১টাকা কেজি। এখন ৪৫টাকা। ২০০৪ থেকে ২০১১ — রাজ্যে সাত বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছিল ইউনিট পিছু ৪১ পয়সা। ২০১১-২০২০ — এই ন’ বছরে বেড়েছে ইউনিট পিছু ২ টাকা ৭৫ পয়সা। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে সরকারী বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলি গরিব রাজ্যবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত ছাড় দিত। শেষ বাজেটেও এইখাতে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল বামফ্রন্ট। সিইএসসি এলাকাতেও এই ছাড় বলবৎ ছিল। এখন এই ছাড় নেমে এসেছে ৭৫ ইউনিটে। যার কোনও সুবিধা মানুষ পান না। গতবছর, অর্থাৎ ২০১৯-র মার্চে রাজ্যের এক খেতমজুরের দৈনিক মজুরি ছিল ২৬৩ টাকা ১০ পয়সা। এটি সরকারী ঘোষণা অনুসারে। রাজ্যের অনেক জায়গাতেই খেতমজুরদের এর থেকে অনেক মজুরিতে কাজ করতে হয়েছে। যেহেতু পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে তৃণমূল কংগ্রেস, যেহেতু গ্রামগুলির বেশিরভাগ পরিণত হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের দৌরাত্ম, অত্যাচারের ভূমিতে, খেতমজুরদের অনেক অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছেো। বামপন্থী খেতমজুর সংগঠন, কৃষক সভা যতদূর সম্ভব থাকার চেষ্টা করে খেতমজুরদের পাশে। কিন্তু সেখানেও প্রবল বাধা তৃণমূল কংগ্রেসের হুমকি, সন্ত্রাস। ২০২০-র মার্চে রাজ্যের সেই খেতমজুরদের দৈনিক মজুরি পেয়েছেন ২৬৭ টাকা ২০ পয়সা। অর্থাৎ তাঁদের মজুরি বেড়েছে ৪ টাকা ১০ পয়সা। কখন? যখন আলু, চাল, তেল, সাবান — সব কিছুর দাম বেড়েছে এই রাজ্যে। শুধু খেতমজুরই নন, অবিচারের শিকার কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নন, এমন গ্রামীণ মজুরও। তাঁদের মজুরি ২০১৯-র মার্চে ছিল ২৮৭ টাকা। হয়েছে ২৯১ টাকা।
কেরালায় কত? সেখানে খেতমজুরের দৈনিক মজুরি ৭০০ টাকা ৭০ পয়সা। গত একবছরে বেড়েছে ১৮ টাকা। খেতমজুর নন, এমন গ্রামীণ শ্রমজীবীর দৈনিক মজুরি সেখানে ৬৭০ টাকা ১০ পয়সা। একবছরে বেড়েছে ১৩ টাকা। তামিলনাডু, জম্মু ও কাশ্মীরের মত রাজ্যেও কেরালার মত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি। কেন পরিযায়ী শ্রমিকরা এই সব রাজ্যে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তার একটি কারন লুকিয়ে আছে এখানে। রাজ্যে গরিবের মজুরি বানানোর কোনও উদ্যোগ গত দশ বছরে মমতা ব্যানার্জির সরকার নেয়নি। সম্প্রতি দৈনিক মজুরি সংক্রান্ত বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী দোলা সেন মজুরি কত কম বাড়ানো যায়, তা নিয়ে রীতিমত সিআইটিইউ নেতাদের সঙ্গে বচসায় মেতে উঠেছিলেন শ্রম কমিশনারের ডাকা বৈঠকে। এই হলো তৃণমূল কংগ্রেস।
তৃণমূল কংগ্রেস সামাজিক খাতে বিপুল বরাদ্দের দাবি করে। মমতা ব্যানার্জির ‘সাফল্যের’ খতিয়ান জুড়ে থাকে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের বর্ণনা। কিন্তু তারই সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে আদৌ বাড়েনি সামাজিক খাতে বরাদ্দ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানীয় জলের মত খাতগুলিকেই সামাজিক ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে ২০১২-১৩-তে রাজ্যের মোট উৎপাদনের ৬.৬% সামাজিক খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল। সেই সময়ে দেশের গড় এই ক্ষেত্রে ছিল ৬%। আর ২০১৮-১৯-র রিপোর্ট বলছে মোট উৎপাদনের ৬.৭% বরাদ্দ হয়েছিল সামাজিক প্রকল্প খাতে। অথচ জাতীয় হার তখন ৮%।
এই ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প হতে পারে এক দৃষ্টান্ত। মমতা ব্যানার্জি এই প্রকল্পটিকে নিজের অন্যতম ‘অবদান’ বলে দাবি করছেন। কিন্তু বাস্তব কী?
রাজ্যের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প। মমতা ব্যানার্জির দাবি তেমনই। কিন্তু গত তিন বছরে কতজন এর সুবিধা পেয়েছেন?
সরকারের দাবি প্রকল্পটির সুবিধা পেয়েছেন ১৩লক্ষ ৭৮ হাজার ৯৪জন। অর্থাৎ যাঁদের কাছে এই প্রকল্প পৌঁছেছে তাঁদের ১.৮৩% পেয়েছেন প্রকল্পটির সুবিধা।
একে কী বলা যায়? প্রহসন।
আরও আছে। ২০১৬-র ৩০ ডিসেম্বর এই প্রকল্পটির উদ্বোধন হয়। ২০১৭-র জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। প্রায় চার বছর পর রাজ্য সরকার গত সেপ্টেম্বরে জানিবেছে যে, ওই প্রকল্পে ১২লক্ষ ২০ হাজার ৬৩৪ জন রোগীর চিকিৎসা হয়েছে বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী হাসপাতালে। এই চিকিৎসার জন্য সরকারের খরচ হয়েছে ১২৯১ কোটি ৪ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু রোগীর জন্য চার বছরে সরকারের খরচ হয়েছে ১০,৫৭৬ টাকা মাত্র। এই মোট টাকার মাত্র ১৩.৮% টাকা সরকারকে দিতে হয়েছে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য। বাকি পুরো টাকাটিই সরকার বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য খরচ করেছে। যদিও রোগীদের ৩৫.২৮% চিকিৎসা করিবেছেন সরকারী হাসপাতালে।
রাজ্য সরকার জানাচ্ছে, রাজ্যের সরকারী হাসপাতালগুলিতে গত জুলাই পর্যন্ত ৩লক্ষ ৮২ হাজার ৫০১জন রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। তারজন্য এই প্রকল্পে সরকারের খরচ হয়েছে ১৪৭ কোটি ৩২লক্ষ ৫৬৬ টাকা। অর্থাৎ সরকারী হাসপাতালে মাথাপিছু খরচ হয়েছে ৩৮৫১ টাকা ৫০ পয়সা।
অন্যদিকে বেসরকারী হাসপাতালে ৭লক্ষ ২২ হাজার ৬১৭ জন রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। তাঁদের জন্য সরকারকে দিতে হয়েছে ৯৫৪ কোটি ৮২লক্ষ ৩ হাজার ৩২৪ টাকা। মাথাপিছু ১৩, ২১৩ টাকা ৩৭ পয়সা করে।
সাড়ে ৭ কোটি মানুষ যে প্রকল্পে ইতিমধ্যেই যুক্ত বলে সরকার দাবি করছে, সেই প্রকল্পকে এখন ‘সবার জন্য’ করা হচ্ছে বলে ঘোষণা করেছেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু যাঁরা ইতিমধ্যেই এর আওতায় বলেতিনি দাবি করছেন, তার বিরাট অংশ ওই প্রকল্পের সহায়তা গত প্রায় চার বছরে পাননি — সুবিধা প্রাপকদের সংখ্যাই তা বলে দিচ্ছে।
সরকারী হাসপাতালের থেকে বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর প্রবণতা রাজ্যে বাড়ছে, তাও তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারী রিপোর্টই জানাচ্ছে। তাহলে সরকার গঠনের পরেই জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরির জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করা হলো? দরকার ছিল হাসপাতালের পরিকাঠামোর আরও উন্নতি। দরকার ছইল চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো। তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার সেদিকে নজর দেয়নি। ফলে সুপার স্পেশালিটির নামে কতগুলি নীল সাদা রঙের ভবন হয়েছে, কিন্তু সেখানকার পরিকাঠামোসহ অন্যান্য প্রয়োজনিয়তা পূরণ হয়নি। ফলে জেলার মানুষকে চিকিৎসার জন্য এখনও অন্য জেলায় কিংবা কলকাতায় দৌড়তে হচ্ছে। গত সাড়ে ন’ বছরে এমনই অনেক প্রহসন দেখিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের এই সব পদক্ষেপে মানুষের লাভ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে।
অথচ ঋণের বেলায়? সরকার যেন ধার গিলেছে গত সাড়ে ন’ বছরে। ২০২০-র মার্চে পশ্চিমবঙ্গের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪,৩৭,০৩৯ কোটি টাকা। গত একবছরে রাজ্য সরকার ঋণ বাড়িয়েছে ৩৬,৬০৫ কোটি টাকা। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে, অর্থাৎ ২০১১-র মার্চে রাজ্যের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ছিল ১,৯২,৯২০ কোটি টাকা। গত ১০ বছর রাজ্যের ঋণ বেড়েছে ২,৪৪,১১৯ কোটি টাকা। আর ১৯৪৭ থেকে ২০১১ — এই ৬৪ বছরে ঋণ হয়েছিল ১,৯২,৯২০ কোটি টাকা। এই ‘সাফল্য’ তৃণমূল কংগ্রেসের, এই ‘দক্ষতা’ মমতা ব্যানার্জির! পশ্চিমবঙ্গেবাসীদের প্রত্যেকের মাথায় এখন ধার প্রায় ৪৪ হাজার টাকা।
কৃষকের প্রতি দরদের কথা দাবি করেন মমতা ব্যানার্জি। অথচ এই ন’ বছরে বড় কারখানা যেমন কমেছে, তেমনই সেচের এলাকা কমেছে। কমেছে চাষযোগ্য জমিরও। ফলাফল? রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম ধারক কৃষিক্ষেত্রও বিপন্ন। ২০১১-১২-তে রাজ্যের ফসলের মোট দাম ছিল ১৩৯২,৮২,১৯,০০০ কোটি টাকা। সর্বশেষ যে হিসাব হয়েছে এই সংক্রান্ত, তাতে ২০১৮-র তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। জানা যাচ্ছে, ২০১৮-তে সেই ফসলের মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে ২৪৪৩,৯৪,৪৭,০০০ কোটি টাকা। ২০১১-১২-তে দেশে পশ্চিমবঙ্গ ছিল ৫ম। রাজ্যে এবার নেমে এসেছে ৭ম-এ। অর্থাৎ ফসলের দাম নিম্নমুখী রাজ্যে। যদি ফসলের দাম নিম্নমুখী হয়, তাহলে কৃষকের আয় তিনগুণ হলো কী করে মমতা ব্যানার্জির শাসনে? এই প্রশ্নও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ২০১১-১২-তে রাজ্যের আগে ছিল উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, গুজরাট। এখন রাজ্যের আগে রয়েছে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ। রাজ্যকে টপকে গেছে মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ। রাজ্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে তামিলনাড়ু। ভূমিসংস্কারের পরে রাজ্যে উৎপাদন প্রচুর বেড়েছিল। তাই চাষের এলাকা অনেক রাজ্যের থেকে কম হলেও জমিতে কৃষক অধিকার ফসলের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পেরেছিল। ফলে ১৯৭৭ পরবর্তী সময়ে ফসল উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ দেশের সামনের সারিতে উঠে এসেছিল। পরবর্তী কালেও তার রেশ রয়েছে। এর জন্য তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে বিশেষ কোনও উদ্যোগ নিতে হয়নি।
কিন্তু ফসলের দাম নির্ভর করে কৃষক কী দাম পাচ্ছেন তার উপর। রাজ্যের ফসল ফড়েদের দখলে থাকে। তাদের দামকেই হিসাব হিসাবে ধরে রাজ্যের কৃষি বিপণন দপ্তরও। নাহলে অভাবী বিক্রী ধরা পড়ে যাবে। সেই ফড়েদের দাম ধরেই রাজ্য পিছিয়েছে। কৃষক আসলে যে দামে ফসল বিক্রি করছেন, তা ধরলে রাজ্য আরও পিছিয়েছে — সন্দেহ নেই। তা সত্বেও রাজ্যে ফসলের দামের অবস্থা কোন দিকে এগোচ্ছে তার একটি আভাস ‘ভ্যালু অব আউটপুট ফ্রম এগ্রিকালচার, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড ফিশিং’ শীর্ষক এই রিপোর্ট থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।
ধারাবাহিক ....
আগামীকাল পর্ব ১২-উদ্বাস্তু, তফসিলী, আদিবাসীদের প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের বঞ্চনা
শেয়ার করুন