PB Statement

পলিট ব্যুরোর বিবৃতি

১৯ জুলাই, ২০২৫

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরো ১৮ জুলাই ২০২৫-এ বৈঠক করে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রকাশ করেছে

ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় পুনর্বিন্যাস – ৮ আগস্ট প্রতিবাদ

নির্বাচন কমিশন বিহারে ভোটার তালিকার একটি বিশেষ নিবিড় পুনর্বিন্যাস (SIR) নির্দেশ দিয়েছে। এখন, কমিশন এটি গোটা দেশে প্রসারিত করতে চাইছে। ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে, নির্বাচন কমিশন ভোটারদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অধিকার গ্রহণ করছে, যা তার সাংবিধানিক কার্যপরিধির বাইরে। বিদেশিদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ভিত্তিহীন অজুহাতে, তারা সংখ্যালঘু এবং অন্য নির্বাচিত গোষ্ঠীর বড় অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। পুরো প্রক্রিয়াটি নানা ধরনের ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ, এবং এমনকি সংবিধান দ্বারা গ্যারান্টিকৃত ভোটাধিকারও অনেকের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হতে পারে। NRC প্রক্রিয়া, যা কোভিড মহামারির আগেই ব্যাপকভাবে জনগণের বিরোধিতার মুখে পড়েছিল, এখন পেছনের দরজা দিয়ে চুপিসারে কার্যকর করার চেষ্টা চলছে। নির্বাচন কমিশন, যা এখন পর্যন্ত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে কাজ করছিল, এখন আরএসএস/সঙ্ঘ পরিবারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহচর হয়ে উঠেছে।

গণতান্ত্রিক অধিকারের এই আক্রমণ, যা গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। লক্ষ্যণীয়, এমনকি বিজেপির কয়েকটি শরিক দল, যেমন টিডিপি-ও এই SIR নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সিপিআই(এম) ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট দেশজুড়ে এই নির্বাচন কমিশনের গণবিরোধী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দিচ্ছে।

মহারাষ্ট্র জননিরাপত্তা বিল বাতিল করো

মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার কর্তৃক গৃহীত জননিরাপত্তা বিল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর একটি বড় আক্রমণ। চরম বামপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে, এই বিল এমন একটি ধারণা তৈরি করতে চাইছে যে, যারা ভিন্নমত পোষণ করে তারাই যেন জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বিলটি ইচ্ছাকৃতভাবে চরম বামপন্থী শক্তি এবং অনুরূপ সংগঠনগুলোর সংজ্ঞাকে অস্পষ্ট রেখেছে, যার ফলে যে কোনো বিরোধী মতকে লক্ষ্য করার অপার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। এই বিলে থাকা কঠোর বিধানগুলোকে ভিন্নমত দমন এবং রাজনৈতিক বিরোধিতা স্তব্ধ করার জন্য ব্যবহার করার গুরুতর আশঙ্কা আছে।

সিপিআই(এম) সমস্ত রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে এই কর্তৃত্ববাদী বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানায় এবং এর অবিলম্বে প্রত্যাহার দাবি করে।

জম্মু ও কাশ্মীর

জম্মু ও কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন যে পাহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলাটি একটি নিরাপত্তা ব্যর্থতার ফল। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে, জম্মু ও কাশ্মীর সরাসরি কেন্দ্রের দ্বারা পরিচালিত হয়, এবং এমনকি নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকেও নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। নিরাপত্তা ব্যর্থতার এই স্বীকারোক্তি কার্যত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতা স্বীকার করারই শামিল, যিনি সরাসরি নিরাপত্তার জন্য দায়ী। সরকারের এমন গুরুতর ব্যর্থতার জন্য তাকে দায়ী করা উচিত এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

উপরাজ্যপাল নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাজকর্মকে দুর্বল করে দিচ্ছেন। কেন্দ্রের নির্দেশে কাজ করে তিনি সেই ছুটির দিনটি বাতিল করেছেন, যা ২২ জন শহিদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পালিত হত — যারা জম্মু ও কাশ্মীরকে সামন্ততান্ত্রিক মহারাজার শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেছিলেন। পরিবর্তে, সেই মহারাজার জন্মদিনকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে — যিনি কৃষকদের হত্যা করেছিলেন এবং মুক্তি আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেওয়া হয়নি। এটি গণতান্ত্রিক অধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর একটি গুরুতর আক্রমণ।

সিপিআই(এম) দাবি জানাচ্ছে যে জম্মু ও কাশ্মীরকে অবিলম্বে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হোক এবং রাজ্য সরকারকে নির্বাচনী নির্দেশের অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়া হোক।

বাঙালিদের বহিষ্কার বন্ধ করো

বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাঙালি ভাষাভাষী জনগণের উপর লক্ষ্য করে আক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে — যেমন দিল্লি, ওড়িশা, অসম, হরিয়ানা, ছত্তীসগড় এবং মহারাষ্ট্রে — বাঙালিদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যথাযথ নথি যাচাই ছাড়াই। তাদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে এবং অমানবিক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার করছে। এমন ঘটনাও ঘটছে যে ভারতীয় নাগরিকদের পর্যন্ত জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে — স্থলপথ এবং এমনকি সমুদ্রপথেও।

সিপিআই(এম) এই বাঙালিদের উপর লক্ষ্য করে চালানো আক্রমণের বিরোধিতা করছে, কারণ এটি ভারতীয় সংবিধান প্রদত্ত চলাফেরার স্বাধীনতার পরিপন্থী। পার্টি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে, এই বেআইনি গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে এবং মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হবে।

আসামে উচ্ছেদ অভিযান

আসাম রাজ্য সরকার অনেক মানুষকে তাদের বৈধ জমি থেকে উচ্ছেদ করছে। মুখ্যমন্ত্রী এই উচ্ছেদ নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছেন এবং সমাজে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে আরো তীব্র করতে এই ঘটনাকে ব্যবহার করছেন। এই জমির নিচে মূল্যবান খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব সম্পর্কিত সাম্প্রতিক রিপোর্ট এবং সেই জমি কর্পোরেটদের ব্যবহারের জন্য তুলে দেওয়ার আগ্রহ — উচ্ছেদের পেছনে আরেকটি বড় কারণ।

বিজেপি ও আরএসএস উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে জাতিগত বিভেদকে কাজে লাগিয়ে বিভাজন তৈরি করতে চাইছে এবং তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই পদক্ষেপগুলো আমাদের দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্য বিপজ্জনক, বিশেষ করে এই অঞ্চলে, যা দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভাগ করে আছে।

কেরালার রাজ্যপালের কার্যকলাপ

কেরালার রাজ্যপাল তার সাংবিধানিক পদকে অপব্যবহার করে আরএসএস ও তার হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শকে প্রচার করছেন। রাজভবনের আয়োজিত জনসাধারণের অনুষ্ঠানে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ও ভারত মাতার ছবি প্রদর্শন করছেন — যেগুলো সংবিধানে স্বীকৃত নয়। তিনি নির্বাচিত এলডিএফ সরকারের পরামর্শকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করছেন এবং সংবিধান সম্মতভাবে সরকারি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে অস্বীকার করছেন। তার কার্যকলাপের মাধ্যমে তিনি আরএসএস ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করছেন, যাতে তারা এলডিএফ সরকারের দ্বারা রক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলোকে দুর্বল করতে পারে।

সিপিআই(এম) সমাজের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে ছাত্রদের দ্বারা সংগঠিত বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচিকে সাধুবাদ জানায়, যেগুলো এই রাজ্যপালের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে।

বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কেরালা সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট থেকে তাদের আবেদন প্রত্যাহার করার অনুমতি দিচ্ছে না, যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে এখন সেই আবেদনগুলো অপ্রাসঙ্গিক। এই রায় শুধুমাত্র তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে নয়, বরং সব রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য। রাজ্যপাল ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য হল মামলা দীর্ঘায়িত করা, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাভাবিকভাবে উপাচার্য নিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। কেরালা হাইকোর্টও নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগে ব্যর্থতার জন্য রাজ্যপালকে তীব্র সমালোচনা করেছে। এটি কেরালার উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে কলুষিত ও ধ্বংস করার সচেতন চেষ্টা।

কেরালার এলডিএফ সরকারের স্বাভাবিক কার্যকলাপকে বাধাগ্রস্ত করার এই চেষ্টা সহ্য করা হবে না। সিপিআই(এম) তার সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে কেরালার জনগণের স্বার্থে কাজ চালিয়ে যাবে এবং বিজেপির ষড়যন্ত্রকে উন্মোচিত করবে।

সংসদের বাদল অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ বিলসমূহ

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসন্ন সংসদের বাদল অধিবেশনে সরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ করানোর পরিকল্পনা করছে — যেমন খনিজ ও খনি (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী বিল, পরমাণু শক্তি আইন ও পরমাণু ক্ষতির জন্য নাগরিক দায়বদ্ধতা আইনে সংশোধনী। খনিজ ও খনি আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য হল দেশের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদকে বেসরকারি ও বিদেশি সংস্থার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। একইভাবে, পরমাণু শক্তি আইন এবং নাগরিক দায়বদ্ধতা আইন সংশোধনের লক্ষ্য হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বিদেশি কর্পোরেটদের এই গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু ক্ষেত্রে প্রবেশে সমস্ত বাধা অপসারণ করা।

সিপিআই(এম) সংসদে অন্যান্য বিরোধী দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবে যাতে এই বিলগুলির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যায়। পার্টি জনসাধারণের মধ্যেও প্রচার চালাবে এবং এইরকম জনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী আইনগুলোর বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করবে।

বাণিজ্য চুক্তি

পলিট ব্যুরো উদ্বেগ প্রকাশ করছে যে, সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশের সঙ্গে যে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার পরিকল্পনা করছে, তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশ পাচ্ছে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। সরকার বিভিন্ন অংশের সঙ্গে আলোচনার আগেই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কেন্দ্র ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নতি স্বীকার করেছে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রকে শোষণের জন্য খুলে দিচ্ছে। সরকারের এই তাড়াহুড়ো করে চুক্তি করার প্রবণতা দেশের স্বার্থের বিরোধী — বিশেষ করে দুগ্ধ, কৃষি, প্রতিরক্ষা, ওষুধ, আর্থিক পরিষেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। সিপিআই(এম) সমস্ত সেই বাণিজ্য চুক্তির বিরোধিতা করে যা আমাদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে এবং দেশের স্বার্থ বিসর্জন দেয়।

৯ জুলাই সাধারণ ধর্মঘট সফল – শ্রমজীবী জনগণকে অভিনন্দন

দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন সর্বভারতীয় ফেডারেশন দ্বারা ডাকা সাধারণ ধর্মঘট ছিল অত্যম্ত সফল। কৃষক ও ক্ষেতমজুররাও তাঁদের নিজ নিজ সংগঠনের নেতৃত্বে এই প্রতিবাদে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সিপিআই(এম) শ্রমিক ও অন্যান্য খেটে খাওয়া শ্রেণির মানুষদের এই সফল সাধারণ ধর্মঘটের জন্য অভিনন্দন জানায় এবং তাঁদের আসন্ন সমস্ত আন্দোলনে সংহতি পুনর্ব্যক্ত করে।

কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক

পরবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ১৩-১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে। এই বৈঠকে আসন্ন বিহার এবং অন্যান্য রাজ্যের নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তুতি ছাড়াও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন