spanish_civil_war_museum

স্পেনের গৃহযুদ্ধ- ইতিহাসের শিক্ষা

বাবিন ঘোষ

“Its 1988 now. Margaret Thatcher is entering her third term of office and talking confidently of an unbroken Conservative leadership well into the next century. My youngest daughter is seven and the tabloid press are circulating the idea of concentration camps for persons with AIDS. The new riot police wear black visors, as do their horses and their vans have rotating video cameras mounted on top. The government has expressed a desire to eradicate homosexuality, even as an abstract concept and one can only speculate as to which minority shall be the next legislated against.

Good night, England. Good night, Home Service and V for victory.”

Alan Moore, “V for Vendetta”.

১৯৮৮ সালে, সাহিত্যিক-আঁকিয়ে এলান মুর তাঁর V for Vendetta গ্রাফিক নভেলের মুখবন্ধে ওপরের কথাগুলো লিখেছিলেন। এলান মুর কম্যুনিস্ট ন’ন, বরং নৈরাজ্যবাদী। তিনি জেরেমি কর্বিনের বাম-ঘেঁষা লেবার পার্টির ইস্তাহারকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন। অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলনকেও মুক্তকন্ঠে সমর্থন করেন। তাঁর এই “ভি ফর ভেনডেট্টা” গল্পের নায়কের মুখোশ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের আন্দোলনকারীরা ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের তিন দশকের মাথায় যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে (থ্যাচার আর রেগানের নেতৃত্বে) দুনিয়া জুড়ে যখন দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটতে শুরু করে দিয়েছে, এলান মুরের ওপরের এই পর্যবেক্ষণকে একটি ঐতিহাসিক স্টেট্মেন্ট হিসাবে দেখা যেতে পারে। ফ্যাসিস্মের “জুজু” শুধুমাত্র কম্যুনিস্টরাই দেখেনা। যে কোন মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাওয়া মানুষের কাছেই ফ্যাসিস্ম একটি ভীতিপ্রদ সম্ভাবনা আর সেই সম্ভাবনা দেখলেই রুখে দাঁড়ানো একটি অবশ্যকর্তব্য।

ফ্যাসিজমের যে সংজ্ঞা অধুনালুপ্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি দিমিত্রভের প্রস্তাবনায় গৃহীত হয়, আজ অবধি তার চেয়ে accurate কোনো ব্যখ্যা নেই ফ্যাসিস্মের। সপ্তম কংগ্রেসের মাত্র ১ বছরের মধ্যেই আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে স্পেনে। ১৯৩৬ সালের ১৮ই জুলাই শুরু হওয়া সেই ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধকে মনে রাখা প্রয়োজন কেন? বর্তমানে গোটা দুনিয়া’য় যে নয়া ফ্যাসিবাদীদের উত্থান দেখা যাচ্ছে, সেই প্রেক্ষিতে স্পেনের গৃহযুদ্ধের ইতিহাস আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া কি জরুরি?

ফ্যাসিস্তদের ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে এটা একটা আবশ্যিক শর্ত- পুরনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজবিপ্লবকে আর ঠেকাতে পারছে না। স্পেনের ক্ষেত্রে ১৯৩৪ এর গণঅভ্যুত্থান ক্ষমতাসীন ভোটে-জেতা উদারনৈতিক দক্ষিণপন্থী সরকারকে বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেনাবাহিনীকে নামিয়ে বর্বরোচিত আক্রমণের মুখে এই অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করে সরকার। ধর্মঘটি শ্রমিক কর্মচারী, কৃষকদের রক্তে ভেসে যায় খনি অঞ্চল থেকে ক্ষেতখামার। এই গোটা অধ্যায় থেকে স্পেনের বাম-গণতান্ত্রিক মানুষজন যেমন শিক্ষা নেয়, তেমনি শিক্ষা নেয় পুঁজিপতিরা, সামন্ততন্ত্র এবং যাজকতন্ত্র। বিভিন্ন বামপন্থী দল এবং গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে অনৈক্য’ও নিঃসন্দেহে খানিকটা দায়ী ছিল এই অভ্যুত্থানের পরাজয়ের পেছনে। বুর্জোয়া-উদারনৈতিক দক্ষিণপন্থা’র ওপর আস্থা হারায় শাসক শ্রেণী। প্রয়োজন হয়ে পড়ে আরো খোলাখুলি হিংস্র রাষ্ট্রশক্তির, সামনে এগিয়ে দেওয়া হয় ফ্যালাঞ্জিস্টদের। পেছনে মদতদাতা হয় রাজতন্ত্রের সমর্থক কার্লাইল-রা, খ্রীষ্ঠান যাজকতন্ত্র, সেনাবাহিনীর মধ্যেকার উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশ। প্রায় তিন বছরের যুদ্ধের শেষে, ফ্যাসিস্ত ইতালি আর নাৎসী জার্মানীর প্রত্যক্ষ সামরিক মদতে এবং পশ্চিম ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রশক্তিগুলির “হস্তক্ষেপ না করার” নীতির কারণে অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন মদতে জয়ী হয় ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন অতিদক্ষিণপন্থী শিবির, পরবর্তী ৩৬ বছরের জন্য স্পেনে প্রতিষ্ঠা হয় সামরিক একনায়কতন্ত্রের।

“ফ্যাসিস্তরা রটাচ্ছিল যে স্পেনের ঘরোয়া ঝগড়ায় আন্তর্জাতিকবাহিনী অযথা নাক গলাচ্ছে। এই ছুতোয় ফরাসি বা ইংরেজ সরকার খোলাখুলি অস্ত্র আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করতে দিত না। অতচ ইতালি ও জার্মানি কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছিল- যে কথাটা অনেকেই যেপে যান। যাঁরা রক্ষণশীলদের বা প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষ থেকে বই লেখেন, তাঁরা সবসময়েই দেখাবার চেষ্টা করেন, কমিউনিস্টরা বাইরে থেকে লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছিল। অথচ আসলে ইতালি বা জার্মানি সরাসরি সীমান্ত খুলে দিয়েছিল। আমাদের সভায়-সমিতিতে আমরা এটাই জোর দিয়ে বলতাম, আর তাই সীমান্ত খুলে দেবার জন্য ধ্বনি তলতাম- যাতে ইংরেজ বা ফরাসি সরকারও সীমান্ত খুলে দেয়। বলতাম, তোমরা তো অবরোধ করেই যাচ্ছ, এদিকে মুসোলিনি যে বৈধভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে খোলাখুলি লড়াই করছে, তার বেলা? তাতে তোমাদের টনক নড়ছে না? কাজেই অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হত লুকিয়ে, পাহারার চোখে ধূলো দিয়ে।

ব্রিটিশ সরকার যেহেতু স্পেনকে কিছুই সাহায্য করেনি, সেজন্যে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তখন আমাদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুদ্ধ আর স্পেনের গৃহযুদ্ধ ওতপ্রোত জড়িয়ে গিয়েছিল।“

উপরের অংশটি জ্যোতি বসুর লেখা। স্পেনের থেকে শতসহস্র কিলোমিটার দূরের অবিভক্ত বাংলার এক তরুণ ছাত্র তখন জ্যোতি বসু। বিলেতে গেছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। সেখানে লন্ডন মজলিশ, ইন্ডিয়া লীগের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সভাসমিতি তে অংশ নিয়েছেন স্পেনের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ত আগ্রাসনের প্রতিবাদে। কেন সেদিন জ্যোতি বসুর মত আরো দেশ বিদেশের কম্যুনিস্ট, এনার্কিস্ট, শান্তিকামী, গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষজন জোরালো সমর্থন করেছিলেন স্পেনের নির্বাচিত রিপাব্লিকান সরকারের সমর্থনে আর ফ্রাঙ্কোর মিলিটারি জোটের বিরুদ্ধে? কেনই বা দেশ বিদেশের প্রচুর বুদ্ধিজীবি এই যুদ্ধে সরাসরি রিপাব্লিকান সরকারের সমর্থনে পপুলার ফ্রন্টের পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড গ’ড়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে অবধি নেমেছিলেন? এর কারণ, আবারো সেই গোড়ার কথাঃ কোনো একটি দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের মানে হল’ গোটা দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষের ওপর অত্যাচারের, শোষণের সবচেয়ে হিংস্র রাস্তা খুলে দেওয়া। ইতালি আর জার্মানীতে ফ্যাসিস্তদের ধারবাহিক অগ্রগতি হতে হতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং তার কিছু বছর পড়েই স্পেনের রাজনীতিতে ফ্রাঙ্কোর উল্কার গতিতে উত্থানে ইউরোপীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এবং ভীতিপ্রদ বাঁকটা বুঝতে ভুল হয়নি দেশ বিদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই কম্যুনিস্ট পার্টি অফ গ্রেট ব্রিটেনের সেন্ট্রাল কমিটির বিশেষ অধিবেশনে হ্যারি পলিট বলেছিলেন “স্পেনের গৃহযুদ্ধ ছিল পরবর্তীকালে কীভাবে ফ্যাসিবাদ প্রবর্তন করা হবে, তারই মহড়া; আবিসিনিয়ার যুদ্ধ’ও তাই। ব্রিটিশরা তাতে কিছু করেনি, চুপ করে থেকে ফ্যাসিবাদকেই সাহায্য করছিল। কিন্তু এখন তো তাদেরও লড়াইতে প্রত্যক্ষভাবে নেমে পড়তে হয়েছে”। সোভিয়েত রাশিয়া সে সময় আরেকটি এগিয়ে আসা বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিতে ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তার মধ্যেও আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিবিধ বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও যথাসাধ্য সহযোগীতা করে গেছে রিপাব্লিকান সরকার আর পপুলার ফ্রন্টের প্রতিরোধকারী বাহিনীকে। শুধুমাত্র কমিউনিজমের “জুজু”কে ঠেকানোর জন্য কীভাবে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে দুই পশ্চিম ইউরোপীয় শক্তি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সরকার প্রচ্ছন্নভাবে ফ্যাসিস্তদের বাড়তে সাহায্য করেছে, তার উদাহরণ স্পেনের গৃহযুদ্ধ। মেরি শেলীর বিখ্যাত উপন্যাস “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন”-এর সেই বৈজ্ঞানিকের তৈরি করা দানবের মতই সে কিন্তু নিজের স্রষ্টাকেও রেয়াত করেনি।

আসলে সাংবিধানিক উপায়েও বামপন্থীদের জয় যে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা মেনে নেবে না, বরং যেভাবেই হোক না কেন’, সেই ন্যায্য রাজনৈতিক অর্জন থেকে বামপন্থী তথা যে কোনো গণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করবে, তার সম্ভবতঃ প্রথম পরীক্ষা ঘটে স্পেন নামের এক ল্যাবরেটরিতে। ১৯৩৪ সালের গণ অভ্যুত্থানকে যতই পিষে মারার চেষ্টা করে থাকুক না কেন জমিদার-পুঁজিপতিদের সরকার,১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সাধারণ নির্বাচনে দেখা গেল’ মানুষের ভোটে স্পেনের ফ্যাসিস্ত দল “ফ্যালাংস” কে প্রায় ধুয়ে মুছে দিয়ে জয়ী হয় বামপন্থীদের নেতৃত্বে থাকা পপুলার ফ্রন্ট। ১৮ই জুলাই ১৯৩৬ এ তাই প্রায় অখ্যাত এক সেনাপতি ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কো কে মরক্কো থেকে তার বাহিনী নিয়ে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য তোল্লাই দিল ইতালি আর জার্মানির সরকার। স্পেনের উত্তর দিকের বিভিন্ন অঞ্চলের ফ্যাসিস্ত গ্রুপগুলোকে পয়সা যোগান’ শুরু হল’ দেশের দক্ষিণপন্থী দলগুলোর মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে যে এর ১০ মাস আগেই, ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে মুসোলিনি আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) দখল করে লীগ অফ নেশন্স কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। স্পেনের উত্তর আফ্রিকার মরোক্কো’র  উপনিবেশে কর্মসূত্রে সে সময় ফ্রাঙ্কো ছিল’। চোখের সামনে ফ্রাঙ্কো দেখল’ যে ফ্যাসিস্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাকৃত দুর্বলতা। আবার এও সে বুঝল’ যে কোনো ধরনের বামপন্থী বা গণতান্ত্রিক সঙ্ঘশক্তির বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রশক্তিগুলোর ভয় এবং বিদ্বেষ ষোল’ আনা। কিন্তু শুধুমাত্র সামরিক অভ্যুত্থান বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে ইউরোপের একটি দেশে যে যথেষ্ট পরিমাণে রাজনৈতিক বৈধতা দেবেনা সরকার দখলের প্রচেষ্টাকে, এ ক’থাও ফ্রাঙ্কো এবং তার মদতদাতারা বুঝল’। প্রয়োজন হল’ প্রাতিষ্ঠনিক ধর্মকে ব্যবহার করার। এগিয়ে এলো স্পেনের ক্ষমতাশালী চার্চের যাজকতন্ত্র। চার্চের মালিকানায় যুগ যুগ ধরে হাজার হাজার বিঘা জমিতে চাষ করা গরিব চাষীরা বুঝে নিতে চেয়েছিল তাদের হকের দাবি। নিজেদের ফলানো ফসলের ওপরে কোনো অলীক ঈশ্বর নয়, বরং নিজেদের কলজে নিংড়োনো শ্রমের অধিকার কায়েম করতে চেয়েছিল। ১৯৩১ সালের সরকারি হিসেব অনুযায়ী স্পেনের তাবৎ জমির অর্ধেকের বেশি অংশের মালিকানা ছিল জনসংখ্যার ১% এর কম মানুষের হাতে। এর ঠিক ৭ বছর আগেই ১৯২৯ সালে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত সরকার রোম্যান ক্যথলিক চার্চকে ল্যাতেরান চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাটিকান সিটি’র সার্বভৌমত্ব দিয়েছে। পোপ ষষ্ঠ পায়াসের নেতৃত্বাধীন ভ্যাটিকান যাজকতন্ত্রের ক্ষমতাসীন অংশ তখন মুসোলিনি তথা গোটা ইউরোপের সকল ফ্যাসিস্ত শক্তির পাশে। ফ্রাঙ্কোর অনৈতিক সামরিক অভ্যুত্থানকে খ্রীষ্টীয় ধর্মরক্ষার জন্য প্রায় এক ক্রুসেড বলে প্রচার করল’ স্পেনের ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতাসীন অংশ (Warren Caroll, “The Last Crusade: Spain 1936”, Christendom Press, 1996)। পপুলার ফ্রন্টকে দাগানো হল’ খ্রীষ্টবিরোধী হিসাবে। আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে দেশী সামন্তবাদ-পুঁজিবাদ জোট বাঁধল’ আর পাশে পেল’ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় মতের যাজকদের বড় অংশকে, যারা কিনা মিলিতভাবে ক্ষমতায় তুলে আনল’ এক ফ্যাসিস্ত সেনাপতিকে। বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির বিরোধীতার একেবারে ক্লাসিকাল একটি ছবি পাওয়া যায় ১৯৩৬-৩৯ এর স্পেনে। এর ফল হল’ পরবর্তী প্রায় সাড়ে তিন দশকের নিরবচ্ছিন্ন একনায়কতন্ত্র, কম্যুনিস্টদের নিধন দিয়ে শুরু হয়ে যে কোনো গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা, স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর অত্যাচারের এক লম্বা অধ্যায়। মধ্যবিত্তের একটা অংশের সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও, ক্ষমতা সংহত করার পরেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বর্বর সব বিধিনিষেধ বসালো ফ্রাঙ্কো’র সরকার।  মধ্যবিত্ত থেকে ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী হয়ে চার্চের পাদ্রীরা অবধি,শেষ পর্যন্ত কেও রেহাই পেল’না একনায়কতন্ত্রের যন্ত্রণার থেকে।

চিরকালের চরিত্র অনুযায়ী ক্ষমতা দখল করেই স্পেনে বৌদ্ধিক চর্চার সংহারে নামল’ ফ্যাসিস্তরা। নির্মমভাবে খুন করা হল’ বিখ্যাত কবি-নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা কে। জেলের মধ্যে আটকে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হল’ মিগুয়েল এর্নান্দেথ কে। কোনক্রমে পালিয়ে বাঁচতে পারলেন রাফায়েল আলবের্তি। কলম ধরলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বললেন যে আবিসিনিয়া আক্রমণ করে মুসোলিনি যে “শান্তি” প্রতিষ্ঠা করছে তার “বুক-ফাটা আওয়াজ”-এর মতই স্পেনে “যুদ্ধের হুঙ্কার” সারা বিশ্বে “বিভীষিকা” ছড়াচ্ছে। আরো লিখলেন তিনি “স্পেনের গণফ্রন্ট আর তার সরকারকে দিতে হবে সকলের সহায়তা”। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বাম-বিরোধী ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি পে’য়েনে’ও এ কথা স্বীকার করেছেন যে স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টি (PCE) তথা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-ই সর্বপ্রথম এই দক্ষিণপন্থী সামরিক-রাজনৈতিক জোটের ফ্যাসিবাদী চরিত্র বুঝতে পেরেছিল (Stanley G. Payne, “The Spanish Civil War, The Soviet Union, and Communism”, Yale University Press, New Haven, 2004)  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি শুরু থেকেই সোচ্চার বিরোধীতা করে গেছিল ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে। নেহরুর নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস ও ফ্রাঙ্কোর আগ্রাসনের বিরোধীতা করে। স্পেনের শহর গের্নিকার ওপর নাৎসী বিমান বাহিনীর বোমাবর্ষণ নিয়ে পিকাসো’র আঁকা “গের্নিকা” ছবিটি আজো ফ্যাসিবাদের বিরোধীতার অন্যতম এক শিল্পকর্ম হিসাবে গন্য করা হয়। স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রী দলরেস ইবারুরির সেই বিখ্যাত ডাক “নো পাসারন” আজো দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের সকল লড়াইয়ের স্লোগান হয়ে ওঠে।

সাহিত্য জগতের মানুষ, কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক রাজনীতির সাথে সাধারণতঃ খুব বেশি মাখামাখি না করা মানুষ, প্রবলভাবে ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট, বিবেকম্পন্ন এক মানুষ বুদ্ধদেব বসু’ও লিখলেনঃ

“আফ্রিকার শেষ কালো ছায়াটুকু শোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই লাগল’ স্পেনের গৃহযুদ্ধ। এই স্পেনের যুদ্ধে যেটুকু আমার চোখ খোলবার বাকি ছিল সেটুকুও খুলে গেলো; বোঝা গেলো পৃথিবীতে লোভ উন্মত্ত হয়ে উঠেছে; বিশেষ একটি শ্রেণীর স্বার্থ সম্পূর্ণ বজায় রাখার জন্য শুধু যে দুর্বল বিদেশি জাতির ওপরেই অত্যাচার চলে তা নয়, স্বজাতিকেও রক্তস্রোতে ভাসানো হয়; শুধু যে বিদেশের ধনরত্ন লুন্ঠন করে নিজেদের উন্নতিসাধন করা হয় তা নয়য়, নিজের দেশের মধ্যে যাঁরা মুক্তির আদর্শ মানেন, যাঁরা সাম্য ও মৈত্রীর মন্ত্রে দীক্ষিত তাঁদের বধ করতে লুব্ধতার ছুরি সর্বদাই উদ্যত।

অন্যদিকে আমাদের চোখের সামনে ছিল সাম্যবাদী রাশিয়া- রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি পড়েছিলুম। জারের আমলে যে দেশ ছিলো দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের ভয়াবহ অন্ধকারে মগ্ন, মাত্র কুড়ি বছরের সাধনার ফলে সে-দেশের কী আশ্চর্য নবজন্ম! ফরাসি বিপ্লবের পরে মানুষের মুক্তির ইতিহাসে এত বড়ো ঘটনা আর ঘটেনি।“

স্পেনের গৃহযুদ্ধের সবচাইতে বড় কৃতিত্ব বোধহয় ঠিক এইখানে। নাৎসী কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ছবি এই পৃথিবী দেখার আগে, স্পেনের গৃহযুদ্ধ’ই তদানীন্তন বিশ্বের চেতনাকে সর্বপ্রথম জাগ্রত করেছিল’ ফ্যাসিস্মের বিরুদ্ধে। মুল্‌ক রাজ আনন্দ থেকে শুরু করে স্নেহাংশুকান্ত আচার্য অংশগ্রহন করেন এই যুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডের হয়ে। যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট স্বেচ্ছাসেবীরা প্রবল অসমান এক যুদ্ধেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্তর্জাতিকতাবাদী দায়িত্ব পালনে এক অমর ইতিহাসের সৃষ্টি করেন। তাঁদের এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে নাৎসী অধিকৃত যুগোশ্লাভিয়ার গেরিলা পার্টিজান প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বহু মানুষ এই প্রতিরোধের লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলেন।

স্পেনের গৃহযুদ্ধের শিক্ষা

১৯৩৯ এ কেন’ পরাজয় ঘটল’ স্পেনের প্রগতিশীল রাজনীতির? কীসের জোরে ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কো’র মত একটি ইতালো-জার্মান ফ্যাসিবাদের হাতের পুতুলের এমন নৃশংস বিজয় সেদিন সম্ভব হয়েছিল? এ বিষয়ে নানা জনের নানা মত। বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের অভাব রয়ে গেছে ইতিহাসের এই মোড়-ঘোরানো তিনটে বছরের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে। মাথায় রাখতে হবে যে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই “অফিশিয়ালি” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। গোটা বিশ্বরাজনীতির সমীকরণ পরবর্তী ৬ বছরে আমূল পালটে যায়। তারপরেই শুরু হয় দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর ধরে চলা শীত যুদ্ধ। ১৯৪৫ পরবর্তী সময়ের পশ্চিমা মিডিয়ার অন্ধ কমিউনিস্ট তথা সোভিয়েত বিদ্বেষের আবহে স্পেনের গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্ট তথা সোভিয়েত রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির ভূমিকা কে চেপে দেওয়ার প্রচুর চেষ্টা করা হয়েছে। জর্জ ওরওয়েলের “হোমেজ টু ক্যাটালনিয়া” বা জেরাল্ড ব্রেনানের “দ্যা স্প্যানিশ ল্যাবারান্থ”এ ফ্রাঙ্কো বিরোধীতা এবং রিপাব্লিকান সরকারের পক্ষ নেওয়া হয়ে থাকলেও সেসব লেখায় বেশ কিছুটা উগ্র সোভিয়ত বিরোধীতা রয়েছে। শীত যুদ্ধ শেষ হওয়ার বেশ কিছুটা সময় পরে যে সকল গবেষণা হয়েছে স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে, সেসবে কিছুটা চোখ বুলোলে দেখা যাচ্ছে যে ওরওয়েল বা ব্রেননের মত সেলিব্রিটি লেখকদের তরফেও স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে কমিউনিস্ট তথা “স্তালিনবাদের” বিরোধীতার ক্ষেত্রেও প্রচুর অতিরঞ্জন এবং ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যে কথাও লেখা হয়েছে। “হোমেজ টু ক্যাটালনিয়া” প্রকাশিত হওয়ার পরের ৬ বছরে যা বিক্রি হয়েছিল (১৯৪৫ অবধি) তার বহুগুন বেশি বিক্রী হয় ১৯৪৫-৫৫ সালের মধ্যে যখন ডালাস-ম্যকার্থী’দের নেতৃত্বে উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধীতা চূড়ান্ত রূপ নেয়। “দ্যা স্প্যানিশ ল্যাবারান্থ” তো ১৯৭৪ সাল অবধি স্পেনে নিষিদ্ধ ছিল (ফ্রাঙ্কো বিরোধীতার কারণে, উগ্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষে ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও), যদিও ব্রেনন কে ফ্র্যাঙ্কো’র সরকার আদর করে স্পেনে পুনর্বাসন দেয় ১৯৫৩ সাল থেকে, ঠিক যেই সময়টা থেকে তিনি সিআইএ’র কাছের লোক এবং পেশায় প্রকাশক জেমস হ্যামিল্টনের প্রকাশনা সংস্থার কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। ব্রেননের পরবর্তী তিনটে বড় লেখা এবং তাঁর আত্মজীবনী সিআইএ ঘনিষ্ঠ এই প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করা হয় যারা দ্যা গড দ্যাট ফেইল্ড এর মত সস্তা কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী ‘নন-ফিকশন’ প্রকাশ করে। সোভিয়েত আর্কাইভ বিবিধ ভূরাজনৈতিক কারণে বিদেশী ইতিহাসবিদদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি গত শতকের শেষ দিক অবধি। অধুনা উন্মুক্ত সেই সকল আর্কাইভ থেকে দেখা যাচ্ছে যে অরওয়েল বা ব্রেননের মত “বেস্টসেলিং” লেখায় সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও আসলে সোভিয়েত রাশিয়া আর মেক্সিকো, এই দুটি দেশের সরকার-ই সেদিনের স্পেনের রিপাব্লিকান সরকার পক্ষে দ্ব্যার্থহীন ভাবে দাঁড়িয়েছিল (Darryl Anthony Burrowes, “Historians At War: Cold War Influences On Anglo-american Representations Of The Spanish Civil War”, Sussex Academic Press, 2018)। বাম-বিরোধী ইতিহাসবিদ রেমন্ড কার অবধি এ কথা মেনে নিয়েছেন যে সোভিয়েত অস্ত্রসাহায্য ব্যাতিরেকে এবং স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পপুলার আর্মির তরফে “কঠিন সশস্ত্র একশন” ছাড়া ফ্রাঙ্কো এই যুদ্ধ বহু আগেই জিতে যেত’।

কিন্তু, পরাজয় যখন শেষ পর্যন্ত ঘটল’ই, তখন মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে ফ্যাসিবিরধী রিপাব্লিকান পক্ষের বেশ কিছু দুর্বলতা ছিল। সেসব দুর্বলতা বা বিচ্যুতির চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়েও যেটা জরুরি, তা হল’ আজকের বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সেসব ইতিহাস থেকে সিক্ষাগ্রহণ। প্রথম শিক্ষা হল’ বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তরফে ভোটে জিতে ক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের রীতির মধ্যে থেকেই যে দক্ষিণপন্থীরা সেই সরকারের বিরোধীতা করবে, তেমনটা ভাবা ভুল। ক্ষমতা (সীমিত সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে প্রশাসনিক ক্ষমতাটুকু হলেও) হাতের বাইরে যেতে দেখলেই পুঁজিবাদ-সামন্তবাদ সীমিত গণতান্ত্রিক ভদ্রতাটুকু ঝেড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এর প্রমাণ ১৯৩৬-৩৯ সালের পরেও বহুবার পাওয়া গেছে ১৯৭৩ এর চিলিতে, ১৯৭৫ এর ভারতে বা ১৯৬৭-৬৯ এবং ২০০৬-২০১১’র পশ্চিমবঙ্গে। বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তরফে এই গায়ের জোরের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সাথেও জুঝে যাওয়ার শক্তি অর্জন করা আর সেই শক্তিকে ধরে রেখে তা বাড়ানোর প্রতি যত্নশীল হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

বামগণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করা মানেই যে গোটা প্রশাসন বাম-মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠেনা, তার ও প্রমাণ মেলে আমলাতন্ত্রের একটা বড় অংশের রিপাব্লিকান সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায়। আবারো, এই একই প্রবৃত্তির পুনরাবৃত্তি বারবার দেখা গেছে বিশ্ব রাজনীতি তথা এই দেশে।

প্রশাশনিক ক্ষমতা অর্জন করলেই বামপন্থীদের তরফে অতি দ্রুত আশু আদায়যোগ্য দাবিগুলি মানুষের হয়ে অর্জন করতে হয়। তবেই নির্দিষ্ট পার্টি-বৃত্তের বাইরে বৃহত্তর জনভিত্তি গ’ড়ে ওঠে বামপন্থীদের। এ ক্ষেত্রে এই “দ্রুততা” বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রতিক্রিয়ার শক্তি জানে যে কীভাবে বৃহত্তর জনমানস কে দ্রুত অধৈর্য করে বামবিরোধীতায় নিয়ে যাওয়া যায়। ক্যাথলিক চার্চের প্রচারের মাধ্যমে ভূমি পুনর্বন্টনের যে কর্মসূচি স্পেনে শুরু হয়েছিল’, তাকে একটা শক্তিশালী স্তরে পৌছতেই দেওয়া হয়নি। রিপাব্লিকান শিবিরের শরিকদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ বিবাদ ভূমিসংস্কারের কর্মসূচির প্রয়োজনীয় গতি শ্লথ করে দেয়।

প্রোলেতারিয়েতের যেমন আন্তর্জাতিকতাবাদ আছে, তার নিজস্ব জাতীয়তাবাদ ও আছে। সেই জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরণা কে বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলন উৎসাহিত না করতে পারলে বুর্জোয়া-সামন্তবাদী সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ বড় জায়গা করে নিতে পারে জনমানসে। আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্বহারা শ্রেণীর এই নিজস্ব জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানো জরুরি, না হলে আন্তর্জাতিকতাবাদ একটা চাপিয়ে দেওয়া ধারণা হিসাবেই থেকে যায় বেশিরভাগ মানুষের কাছে।

উপসংহার

ফ্যাসিবিরোধী লড়াইয়ের যুক্তফ্রন্টের গুরুত্ব এবং সেই যুক্তফ্রন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বপ্রদানকারী ক্ষমতা যে জরুরি, এই শিক্ষাও মেলে। নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা না থাকলে যুক্তফ্রন্টের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলা বিভিন্ন দল/গোষ্ঠী যে ফ্যাসিবাদ বা উগ্র দক্ষিণপন্থাকে মদত যোগাতে পারে, তাও স্পেনের এই মহান শ্রেণীযুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। অতএব কমিউনিস্টদের স্বাধীন শক্তির বিকাশ যে অত্যন্ত জরুরি শুধুমাত্র সমাজতন্ত্র গঠনের জন্য তা নয়য়, তারো বহু আগের স্তরে, অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের পতাকাকে তুলে ধরে রাখার জন্যেও তা অপরিহার্য।

স্পেনের গৃহযুদ্ধ আজো গোটা দুনিয়ার মুক্তিকামী, ফ্যাসিবিরোধী মানুষের মুক্তির সংগ্রামের একটা বড় মাইলফলক। তার থেকে নেওয়ার মত শিক্ষা’ও অফুরান। সেই নির্দিষ্ট তিন বছরে কোন পক্ষ জিতেছে কিংবা হেরেছিল’, সেই তথ্যটি ইতিহাসের মহাভাষ্যে যত’না গুরুত্বপূর্ণ, তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল’ যে সেই যুদ্ধ ফ্যাসিবাদের স্বরূপ এই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার দেখিয়েছিল। ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো’র দীর্ঘ ৩৫ বছরের দক্ষিণপন্থী একনায়কত্ব কে ফ্যাসিবাদ হিসাবে দেখা যায় কিনা সেই নিয়ে বিতর্ক হয়তো চলবে। কিন্তু ফ্রাঙ্কোর উত্থান যে খোলাখুলি ফ্যাসিস্ত ইতালি আর জার্মানির প্রত্যক্ষ মদতে ঘটেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ২৯ বছর যে সেই চরম স্বৈরাচারী দক্ষিণপন্থী সরকার টিকে থেকেছে মার্কিন-পশ্চিম ইউরোপীয় পুঁজিবাদী অক্ষের প্রত্যক্ষ মদতে, তা তর্কাতীত। প্রবল ক্ষমতাশালী স্বৈরতন্ত্রের পতন ও যে দেশের বাইরের খুব বেশি সাহায্য ছাড়াও ঘটানো যায়, তা ফ্রাঙ্কো বিরোধী স্পেনের গণ আন্দোলন দেখিয়েছে। এই আন্দোলনে যে সর্বহারা মজুর, কর্মচারীদের অগ্রণী ভূমিকা কতখানি প্রয়োজন, তাও প্রমাণিত সত্য। আজকের ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বাড়তে থাকা দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী প্রবণতা, যা কিনা যুগে যুগে ফ্যাসিবাদের ফেউ হিসাবে কাজ করে, তার বিরুদ্ধে দেশের মানুষের লড়াইয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধ তো বটেই, সেই গৃহযুদ্ধ পরবর্তী স্পেনের ফ্রাঙ্কো বিরোধী গণআন্দোলন ও জরুরি শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেয়।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন