গৌতম ঘোষ
চা শিল্প একটি শ্রমনিবিড় শিল্প। আমাদের রাজ্যে এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লক্ষ। এই শিল্পে কর্মরত বেশির ভাগই আদিবাসী জনজাতীর। অস্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ধরলে এবং নতুন গড়ে ওঠা চা বাগানগুলি এবং বটলিফ কারখানার শ্রমিক সংখ্যা ধরলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় কুড়ি লক্ষ। এই বিশাল সংখ্যার শ্রমিক কাজে নিযুক্ত মূলত উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জেলায়। কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ এবং আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমার কিছু অংশে এই শ্রমিকরা কর্মরত। বিগত ১০ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে চা শিল্পে উৎপাদন ও মুনাফা বেড়ে চলেছে। বৃহৎ প্রতিষ্ঠিত চা বাগান গুলিতে চাষের নিবিড়তা বাড়ছে। কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হচ্ছে। সমান তালে বৃহৎ বাগান গুলির জন্য ভর্তুকী বাড়াচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। শ্রমিকদের প্রাপ্য রেশন যা ভর্তুকী মূল্যে মালিকরা শ্রমিকদের প্রদান করত তা খাদ্য সুরক্ষা আইন চালু হওয়াতে মালিকদের আর্থিক বোঝা সরকারের কাঁধে চলে যায়। মালিকদের প্রদেয় রেশন শ্রমিকদের প্রাপ্ত মজুরীর অংশ। রেশন বাবদ মাত্র নয় টাকা দৈনিক মজুরীর সাথে যুক্ত করে বর্তমানে চা শিল্পের শ্রমিকরা মাত্র ২৫০ টাকা মজুরী পায়। চা শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরীর দাবীতে আন্দোলন চলছে ১০ বছর ধরে। ন্যূনতম মজুরির ধারনা আসলে জীবন ধারনের জন্য একেবারেই ন্যূনতম তা কোন মতেই অধিকতর ভোগ বিলাসের জন্য নয়। এই পরিমান মজুরি শ্রমিকদের না দিলে সে পরিবারের সকলের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য যথোপযুক্ত আহারে ব্যবস্থা করতে পারে না। এবং নিজেও পরের দিন শ্রম দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত সক্ষমতা নিয়ে কাজে আসতে পারে না । চা শিল্পে মিনিমাম ওয়েজ আদায়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ চা শিল্পের জয়েন্ট ফোরামের নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে রাজ্য সরকার একটি মিনিমাম ওয়েজ এ্যাডভাইসারি কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। এই কমিটি ২০ বার বৈঠক করার পর নানা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে তিন ইউনিট কনজাম্পশন কে ধরে মালিক শ্রমিক ও সরকার পক্ষ মিনিমাম ওয়েজ নির্ধারনের বিষয়ে একমত হন। সম্প্রতি শ্রমমন্ত্রী শিলিগুড়ির একটি সভায় ঘোষণা করলেন মিনিমাম ওয়েজের বিষয়টি প্রডাক্টিভিটি কাউন্সিলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত। এছাড়া হাইকোট সিদ্ধান্ত দিয়েছে ৬ মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে চা শিল্পের শ্রমিকদের জন্য মিনিমাম ওয়েজ ঘোষনা করতে হবে। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের মিনিমাম ওয়েজ আইন পার্লামেন্টে পাশ হয়। সেই সময় গঠিত হয় ফেয়ারওয়েজ কমিটি। এই কমিটি আলোচনার মাধ্যমে তিনরকম ওয়েজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে।১৯৫৭ সালে পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনে সরকার,মালিক পক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন গুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে উপরিউক্ত তিনটি প্রসঙ্গ মিনিমাম ওয়েজ,ফেয়ার ওয়েজ, লিভিং ওয়েজ সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়, এছাড়া এটাও ঠিক হয় যে যতদিন না লিভিং ওয়েজ দেওয়া যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে মিনিমাম ওয়েজ, সংগঠিত ক্ষেত্রে ফেয়ার ওয়েজ সুনিশ্চিত করতে হবে। মিনিমাম ওয়েজ নির্ধারনের জন্য একটি ফর্মুলা এই সভায় সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। চা শ্রমিকদের শুধু মজুরী নয়, প্লান্টেশন আইন ১৯৫১ অনুযায়ী শ্রমিকদের বসবাসের জায়গা এবং ঘর, চিকিৎসা, পরিশুদ্ধ পানীয় জল, নিকাশী ব্যবস্থা, মহিলা শ্রমিকদের জন্য বাচ্চা রাখার ক্রেস, ছেলে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা এই প্রাপ্য। অথচ বাগান মালিকরা কার্যত কিছু না দিয়েই আজ বাগান চালাচ্ছে। সর্বশেষ মজুরী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২১ শে মার্চ ২০১৫ এই চুক্তির মেয়াদ ছিল ২০১৪ র এপ্রিল থেকে ২০১৭সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত।

৯ই জুলাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন গুলির আহবানে সারা ভারত ধর্মঘট। একে কেন্দ্র করে পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্স সর্বত্র চা শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে সিটু সহ জয়েন্ট ফোরাম ভুক্ত সমস্ত সংগঠন গুলির পক্ষ থেকে প্রচারের ঝড় তোলা হয়েছে। ইউনিয়ন গুলির পক্ষ থেকে বিগত এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ তরাই অঞ্চলে সমস্ত চা বাগান গুলিতে এক ঘন্টার গেট মিটিং সংগঠিত করা হয়। চা শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত সনদপত্র তুলে দেওয়া হয় চা বাগান ম্যানেজারদের কাছে। পরবর্তীতে শিলিগুড়ি এসডিও দপ্তরে তরাইয়ের চা শ্রমিকরা দার্জিলিং ডিস্ট্রিক চিয়া কামান মজদুর ইউনিয়নের নামে জমির অধিকার সহ সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা করা টি টুরিজম এলাইড বিজনেসের নামে ৩০ শতাংশ জমি কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোষণাকে প্রত্যাহারের দাবি এবং অন্যান্য দাবি নিয়ে স্মারক লিপি জমা করা হয়। এছাড়া জুন মাসের ২৩-২৪ ২৫ এবং ২৬ তারিখ লাগাতার দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্ট চিয়া কামান মজদুর ইউনিয়নের উদ্যোগে এবং জয়েন্ট ফোরামের উদ্যোগে সর্বত্র চা বাগানের গেটে গেট মিটিং করা হয়। গেট মিটিং গুলিতে চা শ্রমিকদের জীবন যন্ত্রণার কথা উঠে আসে। বিভিন্ন বক্তারা এই গেট মিটিং গুলিতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ম্যানেজারদের উদ্দেশ্যে ৯ই জুলাই ধর্মঘটের নোটিশ এই সময়ে প্রদান করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে চা শিল্পের বিভিন্ন সংগঠন জয়েন্ট ফোরামের মাধ্যমে দাবি তুলেছে শ্রমিকদের বসবাসের জন্য জমির অধিকার দিতে হবে। রাজ্য সরকার গেজেট নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে পনের শতাংশ জমি তে টি ট্যুরিজম এলাইড বিজনেস করবার জন্য অনুমতি দিয়েছেন। এছাড়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হঠাৎ করেই বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে ঘোষণা করে দিলেন চা বাগানের সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত জমি বাগান মালিকদের হোটেল-রিসোর্ট, অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনার জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। এই ঘোষণার পর কর্পোরেট জমি হাঙ্গররা উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলির লিজ হোল্ডে থাকা জমি লিজ ফ্রী করে হোটেল,রিসোর্ট,প্রমোটিং এর জন্য থাবা বাড়িয়েছে। সম্প্রতি দার্জিলিং এর রাঙ্গারুন চা বাগান সেখানে জিটিএ চেয়ারম্যান নতুন টাউনশিপ গড়ে তোলার ঘোষণা করেছেন।
এই ঘোষণার সাথে সাথেই জয়েন্ট ফোরামের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছে। তরাইয়ের দাগাপুর চা বাগানে প্রায় ২২ একর জমি থেকে চা গাছ তুলে ফেলে আইটিসির হোটেল তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘটনারও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। চিয়া কামান মজদুর ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বাগানে শ্রমিকদের একত্রিত করে হোটেল তৈরির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের হাতে থাকা চাষের জমি জোরপূর্বক দখল নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন চা বাগান গুলিতে। সম্প্রতি এরকম একটি ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে। পাহাড়গুমিয়া চা বাগানের নন্দভিটা ডিভিশনে কেলেবর টোপ্পো নামে এক স্থায়ী শ্রমিকের বাগানের লিজ হোল্ডে থাকা প্রায় ২ একর জমি যা কেলেবরের বাবা দাদু জঙ্গল ঝাড় কেটে চাষযোগ্য জমি তৈরি করেছিল, বংশপরম্পরায় এই জমি কেলেবররা চাষ করে আসছে। বাগান ম্যানেজারের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে ওই জমি কেড়ে নেওয়ার জন্য। কেলেবরকে নোটিশ দিয়ে ওই জমি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নোটিশ দেওয়ার পরে তাকে কাজ থেকেও বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে ম্যানেজারের নেতৃত্বে কেলেবরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে জেসিবি নিয়ে জোরপূর্বক কেলেবরকে জমি থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করলে জেসিবির সামনে কেলেবর বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ম্যানেজার কেলেবর কে মারতে মারতে গাড়িতে তুলে ফাঁসিদেওয়া থানায় নিয়ে যান। এই ঘটনায় চা শ্রমিকদের মধ্যে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। সম্মিলিত প্রতিরোধের মাধ্যমে কেলেবর কে ছাড়িয়ে আনা হয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বেশ কয়েকদিন তরাইয়ের এর বৃহৎ চা বাগান পাহাড়গুমিয়া টি এস্টেট বন্ধ থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে প্রায় ১৫০ বছর আগে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় আদিবাসীদের জমির অধিকার রক্ষায় এবং মহাজনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজ গর্জে উঠেছিল। সিধু কানু বিরসা মুন্ডা তীর ধনুক নিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জল জমি জঙ্গলের অধিকার রক্ষায়। আজও একই ভাবে আদিবাসী সমাজকে জল জমি জঙ্গল থেকে উচ্ছেদের কর্পোরেট চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকার ৮ ডেসিমেল জমি চা শ্রমিকদের বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা হবে বলে ঘোষণা করেন।
বাগানে বাগানে জমি সার্ভের কাজ শুরু হয়। প্রথমে পাহাড়ে এলাকার শ্রমিকরা এই আট ডেসিমেল জমি দেওয়ার বিরোধিতা করে এবং সরকারি সার্ভেতে বাধা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তরাই ডুয়ার্সের শ্রমিকেরাও সার্ভের কাজে বাধা প্রদান করেন। চা শিল্পের শ্রমিকদের বৃহৎ সংগঠন জয়েন্ট ফোরাম এর সিদ্ধান্ত যে যতোটুকু জমিতে বসবাস করে এবং স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সেই জমির সবটুকুই "এস ইজ হোয়ার ইজ" পদ্ধতি মেনে শ্রমিকদের জমির অধিকার দিতে হবে। রাজ্য সরকারের ঘোষিত চা সুন্দরী প্রকল্প যা শ্রমিকদের আবাস তৈরি জন্য নেওয়া হয়েছিল সেই প্রকল্প বর্তমানে মুখ থুবড়ে পড়েছে।। এই সময়কালে চা শ্রমিকদের মিনিমাম ওয়েজেস, বসবাসের জন্য জমির অধিকার, পাতা ডাবলি পয়সা, এক্সট্রা লিভ প্রাইস, চা শ্রমিকদের অবসরকালীন বয়স ৫৮ থেকে বাড়িয়ে ষাট করা, শিক্ষা, পানীয় জল এবং শ্রম কোড এর নামে ২৯ টি শ্রম আইনকে তুলে দেওয়ার ঘটনা যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকার পার্লামেন্টে পাশ করিয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ৯ই জুলাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি পক্ষ থেকে ২৪ ঘন্টা হরতাল চা বলয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। ইতিমধ্যেই গেট মিটিং গুলিতে আহ্বান জানানো হয়েছে '৯ ই জুলাই ধর্মঘট সফল করো শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার রক্ষা করো' এবং "বাগান ছোড়ো রাস্তা পে চালো"।