দেবাশিস বসু চৌধুরি
আজ, ১ মে ২০২৫। আমাদের দেশ সহ সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী মে দিবস উদযাপন করছে, যা গভীর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা। এই দিবসটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শ্রমিক ও শ্রমিক আন্দোলনের সংগ্রাম ও অর্জিত অধিকারকে সম্মান করে। চলমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পরিবেশগত সংকট এবং শ্রম অধিকারের উপর আক্রমণের মধ্যে, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের শ্রমিকরা ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আমাদের দেশে, মে দিবসের নিজস্ব সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার রয়েছে। ১৯২৩ সালে প্রথম উদযাপনের পর থেকে, মে দিবস সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য বৃহত্তর সংগ্রামের দিকে ভারতে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের প্রতীক। ২০২৫ সালে, নতুন এবং আরও জটিল পরিবর্তনের মধ্যে মে দিবস পালিত হচ্ছে।

বিগত এক দশকে ভারতের শ্রমিক শ্রেণী বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, যেমন, ব্যাঙ্ক, বীমা, রেলওয়ে এবং অন্যান্য উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি সহ সরকারি উদ্যোগের বেসরকারীকরণ; শ্রমিকদের অধিকার এবং সুরক্ষা দুর্বল করার জন্য চারটি নতুন শ্রম কোড বাস্তবায়ন; সকল শিল্পে স্থায়ী চাকরির বদলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং চাকরিচ্যুতি বিশেষ করে যুব ও গ্রামীণ শ্রমিকদের মধ্যে; আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতাকে সংকুচিত করছে। জলবায়ু-সম্পর্কিত স্থানচ্যুতি লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবি মানুষকে প্রভাবিত করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্দোলন হয়েছে, ব্যাঙ্ক শিল্পেও হয়েছে। বিগত এগার বছর যাবত NDA-র যে তিনটি কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচিত হয়েছে তাদের মূল লক্ষ্য সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার (ব্যাঙ্ক সহ) বেসরকারীকরণ। আবার ব্যাঙ্ক সহ শ্রমিক শ্রেণীর নিরন্তর লড়াই-এর ফলশ্রুতিতে সরকারের অপচেষ্টা এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি। কিন্ত বর্তমান সরকার বিভিন্ন নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে দুর্বল করার অভিনব প্রক্রিয়ার অবতারণা করেছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিএসএনএল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন উপায়ে একে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে। অপর্যাপ্ত স্থায়ী কর্মচারী সংখ্যা; ব্যাঙ্কের বিপুল কাজের আউটসোর্সিং; স্থায়ী কর্মচারীর তুলনায় অস্থায়ী কর্মীদের নিয়োগের বর্ধিত প্রবণতা; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অপ্রতিযোগিতামূলক সুদের হার; রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আমানতের স্থানান্তরণ; ডিজিটালাইজেশনের ঋণাত্মক প্রভাব; মিউচুয়াল ফান্ড ও ফিনটেক সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্ত; ব্যাঙ্ক শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের প্রভাব; ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ বকেয়া ঋণের অব্যাহত নয়ছয় ইত্যাদি প্রক্রিয়া গ্রহণের মাধ্যমে এই কাজ সরকার করছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানগুলিও উপরোক্ত বেশ কিছু দাবী সহ নিজেদের দাবীদাওয়া নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাচ্ছে। বেসরকারী ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদে, সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা কর্পোরেটাইজেসনের বিরুদ্ধে, রিজিওনাল রুরাল ব্যাঙ্কের কর্মচারী-আধিকারিকরা জাতীয় গ্রামীন ব্যাঙ্ক গঠনের দাবীতে, নাবার্ডের কর্মচারীরা ডিএফআই চরিত্র শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্মচারীরা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বতন্ত্র চরিত্র রক্ষার লক্ষ্যে লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করছেন।
৩১ মার্চ, ২০২৪ আমাদের দেশে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক হিসাবে ১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, ২১টি বেসরকারী ব্যাঙ্ক, ৪৫টি বিদেশী ব্যাঙ্ক, ১২টি স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক, ৬টি পেমেন্টস ব্যাঙ্ক, ৪৩টি আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও ২টি লোকাল এরিয়া ব্যাঙ্ক কাজ করছে। এর মধ্যে ১৩৭টি Scheduled Commercial Bank হিসাবে নথিভুক্ত। আজকের আলোচনা মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কেন্দ্রিক। ১৯৯১ সালে নয়া আর্থিক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে মূলতঃ ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে সংস্কার ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বিগত তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে চলছে। কিন্ত ২০১৪ সালে এনডিএ সরকার গঠিত হবার পর যে নীতি প্রনয়ণ করা হয়েছে তার ফলে গোটা ব্যাঙ্ক শিল্প অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন।
দেশের বেকারত্বের পরিস্থিতি গত এক দশকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা গত অর্ধ-শতাব্দীতে নজিরবিহীন। শিক্ষিত যুবকদের যে কোনো চাকরি পাওয়ার জন্য যে মরিয়া পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের সামনে আছে।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর সম্মিলিত কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেয়ে ২০২৪ অর্থবর্ষে ৭,৪৬,০০০-এ নেমে এসেছে, যা আগের বছরে ছিল ৭,৫৬,০০০ এবং ২০১৪-১৫ সালে ছিল ৮,৫৯,০০০। অন্যদিকে, বেসরকারি ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কগুলোর কর্মীসংখ্যা ২০২৪ অর্থবর্ষে ৮,৪৬,০০০-এ দাঁড়িয়েছে, যা ২০১৪-১৫ সালে ছিল মাত্র ৩,১৯,০০০। কর্মীর অপ্রতুলতার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কাজের চাপ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভারতবর্ষে বিপুল বেকার থাকার ফলে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না করে ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ কাজ বর্তমানে ঠিকা, অস্থায়ী, কমিশন-ভিত্তিক কর্মচারীদের দিয়ে করানো হচ্ছে। এই ধরণের কর্মচারীদের সংখ্যা স্থায়ী কর্মচারীদের থেকে অনেক বেশী। এই ক্ষেত্রে সব থেকে বেশী সংখ্যক হচ্ছেন Business Correspondents বা ব্যাঙ্ক মিত্র। মূলত ব্যাঙ্কের শাখা নেই এইরকম স্থানে পরিষেবা পৌঁছনোর জন্য RBI-এর নির্দেশিকা অনুসারে এঁদের নিয়োগ করা হয়। তবে অনেক এলাকায় শাখা থাকা সত্ত্বেও ব্যাঙ্ক মিত্র নিযুক্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন। অত্যন্ত অল্প কমিশনের বিনিময়ে ব্যাঙ্ক মিত্র ৫৬ প্রকারের কাজ করছেন। এতদসত্বেও ব্যাঙ্ক মিত্ররা প্রতিদিন চূড়ান্ত শোষণ, বঞ্চনা, অপমানের শিকার হচ্ছেন। সারা দেশে সমস্ত ব্যাঙ্ক মিলিয়ে ৩১ জানুয়ারী, ২০২৫ ব্যাঙ্ক মিত্রর সংখ্যা ১৩,৯৮,৯৫১ (সূত্র: লোকসভার প্রশ্নোত্তর)।
ব্যাঙ্কে শিক্ষানবিশীর প্রচলন আগে থেকেই ছিল। তবে এই শিক্ষানবিশরা নির্দিষ্ট স্টাইপেন্ডের বিনিময়ে ব্যাঙ্কের কাজ শিখতেই আসতেন, এঁদের কোনভাবেই ব্যাঙ্কের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা হত না। শিক্ষানবিশদের ব্যাঙ্কের কাজে ব্যবহার করার প্রচলন শুরু হয়েছে কমবেশী ৫ বছর। বর্তমানে এই শিক্ষানবিশদের নামমাত্র স্টাইপেন্ডের বিনিময়ে এক বছরের জন্য কোনরকম সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়াই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ব্যবহার করা হচ্ছে যাবতীয় নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে, চূড়ান্ত শোষণের প্রতীক হিসাবে।
২০১১ সালে সঞ্চয়ী আমানতের সুদের হার নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার পর, বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মধ্যে সুদের হারে বিশাল পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। সাধারণত, সরকারি ব্যাঙ্কগুলো তুলনামূলকভাবে কম সুদের হার দিচ্ছে, যেখানে অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক বেশি সুদ দিচ্ছে। এর ফলে, সঞ্চয়ী আমানতের একটি বড় অংশ সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে বেসরকারি ব্যাঙ্ক ও ছোট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং বহু গ্রাহক স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারী ব্যাঙ্কের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। অন্যদিকে চালু আমানতের (Savings deposit) উপরও অনেকগুলি বেসরকারী ব্যাঙ্ক ও স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্ক বেশী সুদ দিচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সহ অনেক ব্যাঙ্ক আমানতকারীদের মিউচুয়াল ফান্ড বা শেয়ার বাজারে অর্থ স্থানান্তর করতে উৎসাহিত করছে, যা ব্যাঙ্কের আমানতের অনুপাতকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উল্লেখ করেছেন যে, ‘গৃহস্থালীগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের সঞ্চয় মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা তহবিল এবং পেনশন তহবিলে বিনিয়োগ করছে।’ বর্তমানে, মোট গৃহস্থালী সঞ্চয়ের হার জিডিপির ৫.১%, যা গত ৪৭ বছরে সর্বনিম্ন। গত এক দশকে, ভারতের মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের অধীনে পরিচালিত সম্পদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩০ জুন, ২০১৪-তে যা ছিল ৯.৭৯ লক্ষ কোটি টাকা, ৩০ জুন, ২০২৪-এ সেই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬১.১৬ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৬২৫ শতাংশ বৃদ্ধি।
ফিনটেক (FinTech) সংস্থাগুলিকে এমন প্রতিষ্ঠান হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যারা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তাদের জন্য আর্থিক পণ্য ও পরিষেবার সরবরাহে প্রযুক্তিগত সমাধান প্রদান করে। যেমন, পেটিএম, ফোন-পে, গুগল-পে ইত্যাদি। বর্তমানে ভারত ফিনটেক সংস্থার বৃদ্ধির হারে বিশ্বে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। শিল্প ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচার বিভাগ (DPIIT) অনুযায়ী, ২২ জুলাই, ২০২৪ পর্যন্ত ভারতে ৮০১১টি ফিনটেক কোম্পানি রয়েছে। সম্প্রতি ব্যাঙ্ক ও ফিনটেকের মধ্যে অংশীদারিত্বের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বহুধরণের কাজ অচিরেই আউটসোর্স হবার সম্ভাবনা বাতিল করা যাচ্ছে না। একটি সাম্প্রতিক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, ফিনটেক কোম্পানিগুলো ব্যক্তিগত ঋণের (Personal Loan) বাজারের ৫২% শেয়ার দখল করেছে। অনুমান করা হচ্ছে যে আগামী তিন বছরের মধ্যে ফিনটেক কোম্পানিগুলি তাদের গ্রাহক সংখ্যা দ্বিগুণ করে ২০ কোটিতে পৌঁছে যেতে পারে। গ্রাম ও আধা-শহর এলাকায় ফিনটেকের প্রবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যাঙ্কিং পরিষেবার ডিজিটালাইজেশন অব্যাহত রয়েছে। গত এক দশকে ডিজিটাল লেনদেনের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এর সাক্ষ্য বহন করে। কাগজভিত্তিক লেনদেন ব্যতীত, বাকি সমস্ত লেনদেন ডিজিটাল লেনদেনের মধ্যে পড়ে। ২০০৫-০৬ সালে খুচরা লেনদেনের মোট মূল্যের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেনের অংশ ছিল ১.৩%, যা ২০২৩-২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০%। অনেক ব্যাঙ্ক পরিষেবা ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে। ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (NPCI) দ্বারা তৈরি ইউনাইটেড পেমেন্টস ইন্টারফেস (UPI) এখন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য জনপ্রিয় পেমেন্ট মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ২০২৩-২৪ সালে খুচরা লেনদেনের মোট লেনদেনের ৭৯.৬% UPI-র মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে, UPI প্রতিদিন প্রায় ৪৫ কোটি লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ করছে (জুন ২০২৪), যার সিংহভাগ ফিনটেক সংস্থা ও বেসরকারী ব্যাঙ্কগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে।
ব্যাঙ্কগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং (ML) ব্যবহার করছে প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করতে, তথ্য বিশ্লেষণ করতে এবং গ্রাহকদের আরও পরিষেবায় আরও বেশি সুযোগ দিতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ফলে সারা পৃথিবীতেই কর্মচ্যুতির সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতের ব্যাঙ্ক শিল্প এর বাইরে নয়। ব্যাঙ্ক শিল্পে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অবাধ হয়েছে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ব্যাঙ্কে বিভিন্ন কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ হয়েছে। আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত আরবিআই-এর ২০২৪ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিবর্তন এবং প্রয়োগ সাইবার ঝুঁকির পরিস্থিতি তৈরি করছে। ব্যাঙ্কে ইতিমধ্যেই রোবট চালিত শাখার প্রবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বল্গাহীন AI ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। উন্নত দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের বিরুদ্ধে হলিউডের চিত্রনাট্য লেখকদের আন্দোলন এক্ষেত্রে উল্লেখের দাবী রাখে।
এছাড়াও ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণকে কেন্দ্র করে ঋণ মকুব (Right off) এবং ইনসলভেন্সি ও ব্যাঙ্করাপ্টসি কোড (IBC) ২০১৬-র মাধ্যমে রেজলিউশনের ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়ছয় চলছে। ২০১৪-১৫ অর্থ বর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষ পর্যন্ত মোট ঋণ মকুবের পরিমাণ ১৬,৩৫,৩৭৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে বৃহৎ শিল্প সংস্থার ক্ষেত্রের পরিমাণ ৯,২৭,১৪৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৫৬.৬৯ শতাংশ (সূত্র: লোকসভার প্রশ্নোত্তর)। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী শেষ দুটি অর্থ বর্ষে IBC-তে পাঠান বকেয়ার যথাক্রমে ৬১ শতাংশ ও ৭১.৭ শতাংশ ঋণ চিরকালের মত বিসর্জন দিতে হয়েছে, যার ১০০ শতাংশ সুবিধাভোগী হল বড় ঋণ গ্রহীতারা।
ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা বিগত বছরগুলিতে যে বিষয়গুলির উপর প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করেছে সেগুলি হোল: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে; পর্যাপ্ত স্থায়ী নিয়োগের দাবীতে; আউটসোর্সিং ও ঠিকাকরণের বিরুদ্ধে ; অস্থায়ী কর্মচারীদের নিয়োগ ও সামাজিক সুরক্ষার দাবীতে; ব্যাঙ্ক মিত্রদের শোষণের বিরুদ্ধে; গ্রাহক পরিষেবার উন্নতির দাবীতে; ব্যাঙ্কের বকেয়া ঋণের নয়ছয়ের বিরুদ্ধে; আমানতের উপর দেয় সুদ বৃদ্ধির দাবীতে; খুচরো গ্রাহকদের উপর আরোপিত সার্ভিস চার্জ হ্রাস করার দাবীতে।
এই আন্দোলন শুধুমাত্র ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের স্বার্থেই নয়, ব্যাঙ্ক শিল্প ও তার গ্রাহক এবং গোটা দেশের স্বার্থ এর সাথে জড়িত। ২০২৫ সালে, আমাদের দেশে মে দিবস পালনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং সেক্টোরাল ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে ২০ মে ২০২৫ তারিখে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সফল উদযাপনের প্রস্তুতিকে আরও জোরদার করবে। ব্যাঙ্ক শিল্পের একাধিক সংগঠন সাধারণ ধর্মঘটে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। ব্যাঙ্ক বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে, পর্যাপ্ত স্থায়ী কর্মী নিয়োগের দাবীতে, আউটসোর্সিং-এর বিরুদ্ধে, নয়া পেনশন আইন বাতিল করে পুরাতন পেনশনের দাবীতে, শ্রম কোড বাতিল সহ বীমা শিল্পের ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের বিরুদ্ধে ও সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বীমা কোম্পানীর সংযুক্তিকরণের দাবীতে ব্যাঙ্ক ও বীমা শিল্পে ২০ মে ২০২৫ ধর্মঘট সর্বাত্মক করার লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক ও বীমা শিল্পের সংগঠনগুলি যৌথ প্রচারাভিযান শুরু করেছে। এই ধর্মঘট সর্বনাশা নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের এক নয়া মাইলফলক হিসাবে প্রতিভাত হবে।