galelio - davolkar

গ্যালেলিও থেকে দাভোলকর যুক্তিবাদ রক্ষার সংগ্রাম চলবে

৮ জানুয়ারি ২০২৫, বুধবার ১৫৬৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি পিসাতে জন্মগ্রহণ করেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি, আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার সাথে যার নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যদিও তাঁর জীবনের ইতিহাস খুব সুখের নয়। গ্যালিলিও নিজের শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন সময় প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতির দিকে। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন অজানাকে জেনে নিতে, অদেখাকে দেখার প্রবল বাসনায় প্রশ্ন করে গেছে বারংবার। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি পেয়েছেন একের পর এক নতুন ভাবনা। যে ভাবনা, যে আবিষ্কার আলোড়ন ফেলেছে তৎকালীন সমাজে। যে তত্ত্ব নাড়িয়ে দিয়েছিল কুসংস্কারের প্রতিষ্ঠানকে। এ পৃথিবীর পরিচিত ইতিহাস কে চ্যালেঞ্জ ঠুকে যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মননের পাহারাদার ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি, আজ ৮ই জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু দিন। তৎকালীন সমাজে চার্চ কর্তৃক যে শাসন চলতো সেখানে তাদের বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করা ছিল অপরাধ। বাইবেলে লেখা তথ্যের বাইরে অন্য কিছু বিশ্বাস করা ছিল অন্যায়, এবং ধর্ম মোহের বিরুদ্ধাচারণ তো অবশ্যই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু তবু পৃথিবীর ইতিহাসে মেনে নেওয়ার বদলে পাল্টে দেওয়ার মানুষদের জন্ম হয়েছে। যারা ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে যুক্তিবাদের পক্ষে লড়াই চালিয়েছেন। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে শহীদ হয়েছেন অনেকে তবু বিজ্ঞানের জয়যাত্রা থমকে যায় নি। ব্রুনো থেকে দাভোলকরদের হত্যা করা হয়েছে, বন্দী করা হয়েছে গ্যালিলিওদের। তবুও বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের অগ্রগতির ধারা অবিরাম বহমান। যারা ব্রুণোকে পুড়িয়ে মেরেছিল, যারা বাধ্য করেছিল গ্যালিলিওকে ক্ষমা চাইতে তাদের মনে রাখেনি ইতিহাস। সভ্যতার ইতিহাসে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রার গল্পে আলোকবর্তিকা গ্যালিলিও গ্যালিলিদের কাছে আজ ফিরে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি কী কী আবিষ্কার করেছিলেন তা আমরা কম বেশি সকলেই জানি। তাঁর তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা নতুন করে বলে দিতে হয় না। কিন্তু যে সময় দাঁড়িয়ে গ্যালিলিও তাঁর আবিষ্কারের কথা বলছেন, তাঁর ভাবনার কথা বলছেন, প্রমাণ করছেন বাইবেলে লিখে দেওয়া সমস্ত তথ্য সঠিক নয়, আজ নতুন করে তা আলোচনা করা দরকার। ধর্মের ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব দখল করতে অস্ত্র করে ধর্মকে। মানুষের সেই ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে চলতে থাকে ভুল বোঝানো। আর কেউ তার প্রতিবাদ করলে নেমে আসে ধর্মের খাঁড়া। আসলে যুগ যুগ ধরে দেশ, জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে যেখানে যেখানে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ হয়েছে সেখানেই রাষ্ট্রশক্তি বিরুদ্ধমতের গলা টিপে ধরেছে। ইতালিতে বাইবেলকে চিরসত্য প্রমাণ করতে গ্যালিলিওকে বন্দী হতে হয়, পুড়ে মরতে হয় ব্রুনোকে। ভারতেও মনু স্মৃতিকে চিরসত্য প্রমাণ করতে মরতে হয় দাভোলকর থেকে কালবুর্গীদের। আজকের দিনে আমাদের দেশে যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক মননকে রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। যে প্রগতিশীল চেতনা আমাদের দেশের গৌরব ছিল আজকের শাসকের আক্রমণে তা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ভারতবর্ষের যুক্তিবাদীর মনন বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। রামমোহন থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, মধুসূদন গুপ্ত, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রী বাই ফুলে, পেরিয়ার, ডিরোজিও, আম্বেদকর, এম এন রায়, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ইত্যাদি অনেকেই সেই পরাধীন ভারতেও যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন। সেসময়ের জাতপাত বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে অসাম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নারী মুক্তি থেকে যুক্তিবাদী মন গড়ে তোলার যে আন্দোলন হয়েছিল সেই ধারায় পরবর্তী সময়ে দাভোলকর, কালবুর্গী, পানসারে ইত্যাদিদের নাম স্মরণ করা যায়। আসলে আমাদের দেশ স্বাধীনতার লড়াইয়ের সেই সময় থেকেই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, ন্যায়বিচার, সমতা, বিজ্ঞানমনস্কতাকে মূলমন্ত্র করে এসেছে। যা থেকেই বৈজ্ঞানিক মনন তৈরির কাজ শুরু। এই মনন সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে সর্বত্রই দরকারি। বলা ভালো দেশের বিকাশের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক মনন, যুক্তিবাদ, প্রগতিশীলতা অপরিহার্য। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে এই দেশ চলছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে অপবিজ্ঞানের প্রচার চলছে। পৌরাণিক কাহিনী ও ধর্ম শাস্ত্রের কথাকে বৈজ্ঞানিক সত্যের মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। স্বাধীন মত প্রকাশ, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা সর্বোপরি দ্বিমত পোষণ করার মতো বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডকে দেশদ্রোহিতা বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার প্রবেশ হচ্ছে। যেকোনো মৌলিক গবেষণাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে শাসকগোষ্ঠী। প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের নামে জ্যোতিষ শাস্ত্র ও বৈদিক গণিতকে পাঠ্যতালিকায় স্থান দেওয়া হচ্ছে। ছোটদের পাঠ্যে থেকে সচেতন ভাবে বাদ দেয়া হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, পর্যায় সারণী। আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের যৌক্তিক চিন্তার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্যই সিলেবাসে এই আক্রমণ। যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার প্রসারকে রুখতে গিয়ে ব্যবসায়িক, সাম্প্রদায়িক চক্রের হাতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমর্পণ করে দেওয়ার কাজ এগিয়ে চলছে আজকের ভারতে। কিন্তু এই চক্রান্তকে পরাস্ত করতে হবে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে সক্রিয় ভূমিকায় নামতে হবে আমাদের। রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে বিজ্ঞানমনস্কতা বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করতে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা,সহিষ্ণুতা, দ্বিমত হওয়ার স্বাধীনতা, অন্ধ বিশ্বাসের বদলে পরীক্ষা করার জিজ্ঞাসু প্রকৃতিকে লালন করা আমাদের প্রত্যেকের অধিকার।অপবিজ্ঞানের সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাতে যুক্তিবাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে আমাদের। এই সময় দেশের শাসক দল আসলে মস্তিষ্কের দখল নিতে চায়ছে। যে মস্তিষ্ক তর্ক-বিতর্ক থাকবেনা। যুক্তির জাল থাকবে না। বোধ থাকবে না। থাকবে না বিজ্ঞান সচেতনতা, তেমন মাথা দরকার আজকের শাসকের। তারা সমস্ত কিছু নিজেদের মতো করে চালাতে চায় । যুক্তিবাদী মানুষ নয়, আদেশ পালন করা রোবটের মতো প্রজন্ম দরকার শাসক শ্রেণীর। সেই কারণেই এত আক্রমণ। আসলে তারা ভয় পাচ্ছে যুক্তিবাদী মননকে, যারা অন্ধবিশ্বাস কে নয় সঠিক তথ্যকে যাচাই করে নেবে। তাই আক্রমণ ছাত্রদের সিলেবাসে, বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রে, যুক্তিবাদের গবেষণাগারে।
মানুষকে ধর্মের বিভেদে জর্জরিত করে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। যে দেশ চাঁদে রকেট পাঠাচ্ছে সে দেশেই খুন হতে হচ্ছে তথাকথিত' নিচু জাতির' মানুষ হবার অপরাধে। হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রচারের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে 'অনার কিলিং' এর মত জঘন্য ঘটনা। আর যারা এসব জাতের নামে বজ্জাতির বিরুদ্ধে লড়ছেন তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন নীতি চলছে। যুক্তিবাদী মনন তৈরির কারিগরদের খুন হতে হচ্ছে দিনের আলোয়। তবে এদের হত্যা শুধুই কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষের হঠকারিতা নয়। এর পিছনে আছে ভিন্ন মত সহ্য করতে না পারার মানসিকতা, গণতন্ত্রের বিরোধিতা এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। এই শক্তি আসলে প্রতিক্রিয়াশীল, প্রগতিবিরোধীদের জোট যারা ক্ষমতা দখলের রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে মানুষের ভাবাবেককে। তাই এদেশের মাটিতে তাদের হাতে খুন হতে হয় দাভলকার, পানসারে,কালবুর্গির মত যুক্তিবাদীদের। পৃথিবী ঘুরছে বলার মারাত্মক 'অপরাধ' করে ফেলেছিলেন গ্যালিলিও, কারণ তা বাইবেলে লেখা ছিল না।তাই গ্যালিলিওকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল প্রতিদিন বাইবেলের শ্লোক আওড়াতে হবে। সংবিধানের বদলে মনুস্মৃতিকে মান্যতা দিতে চাইছে এদেশের আজকের শাসকেরা। আজকের ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপমানিত হতে হচ্ছে আম্বেদকরকে। এই ধর্মান্ধদের পথ প্রশস্ত হতে দেওয়া যাবে না কোন ভাবেই। কারণ শত আক্রমণ আর ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পরেও গ্যালিলিওর পৃথিবী ঘুরছেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন "ধর্মের বেশি মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে। " মারা আর মরার খেলায় নয়, জীবনের ফুল ফোটানোর দর্শনের পথ আরও সহজ করার দায়িত্ব আমাদের। আমাদের চিন্তায় আমাদের চেতনায় আমাদের প্রজ্ঞায় শব্দের বুননে অক্ষর মিছিলে যুক্তিবাদকে রক্ষা করার শপথ নিয়ে বলে যেতেই হবে "পৃথিবীতে যত আছে খড়্গ আর চাপাতির ধার তার চেয়ে ঢের বেশি শক্তি রাখে ন্যায়ের বিশ্বাস শেষ যুদ্ধে জেতে তাই গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস।"
শেয়ার করুন

উত্তর দিন