গৌতম গাঙ্গুলী
এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে সময়ের পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখাটা জরুরী। ১৮৯১ সালের ২২ জানুয়ারী গ্রামসির জন্ম। প্রয়াত হয়েছেন ১৯৩৭ সালে। ৪৬ বছরের জীবন। নভেম্বর বিপ্লব ১৯১৭ সাল। গ্রামসি তখন ২৬। মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট সরকারের কোপে পরে গ্রেপ্তার হন ১৯২৬। মাত্র ৭ বছর সোভিয়েত বিপ্লবের কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর রেখেছেন। তারপর দীর্ঘ কারাবাস,আমৃত্যু। ১১ বছর। কথা ছিলো বিশ বছরের কারাবাস। ফলে কারাবাসে সোভিয়েত বিপ্লবের পরবর্তী ফলাফল,সে সাফল্যই হোক বা ত্রুটি,খুব বিষয়গত ভাবে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সু্যোগ ছিলো কম। তার প্রিজন নোটবুক খুঁটিয়ে পড়লে ইঙ্গিত অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু বিশ্লেষণ মূলক ভাষ্য প্রায় অনুপস্থিত। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) শুরুর থেকে নভেম্বর বিপ্লবের বছর অর্থাৎ ১৯১৭ অবধি,সময়, এই আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ।নভেম্বর বিপ্লব ১০৭ বছর পার করলো। তবু এই আলোচনা প্রাসঙ্গিক। পুঁজিবাদের ঘৃণ্য আক্রমণের মুখে।
১৯১৪ সালে গ্রামসি তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিষয় ভাষাতত্ত্ব। তাঁর অন্য সুপরিচিতি সংবাদজগতের মাধ্যমে এক৷ সমাজতন্ত্রী বা সমাজ-গণতন্ত্রী হিসাবে।ছাত্র হিসাবে পরিচিতি ছাড়াও অ্যাভন্তি পত্রিকার সাথে সহযোগিতার ভিত্তিতে তুরিনের আঞ্চলিক সংবাদপত্রে Il Grido del popolo কর্মরত সাংবাদিক। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার ফেব্রুয়ারী বিপ্লব ও কেরেনেস্কির সরকার গঠন সংক্রান্ত খবর ইতালিতে এসে পৌঁছাত খুবই কম। লণ্ডন ও প্যারিসের সংবাদসংস্থার প্রচারিত খবরের উপর ইতালির সংবাদমাধ্যমকে নির্ভর করতে হ'ত। এছাড়া রাশিয়া থেকে বহিস্কৃত সমাজ গণতান্ত্রিক বিপ্লবী ভ্যাসিলোভিচ সুচোমলিস ‘জুনিয়র’ ছদ্মনামে অ্যাভন্তিতে প্রবন্ধ পাঠাতেন,তাতে রাশিয়ার খবর থাকতো। কিন্তু সেই খবরের সাথে জমির সংযোগ কতটা তা বলা মুশকিল। ইতালিতে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কর্মীদের পার্টি ইতালির সোশ্যালিষ্ট পাটির নেতৃত্ব (পিএসআই) ইতালির সংসদের সোশ্যালিষ্ট পার্টির প্রতিনিধি সদস্য ওদ্দিনো মরগারিকে (Oddino Morgari) পেত্রোগাদ গিয়ে রাশিয়ার বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন। যাতে তা়ঁরা জমির খবর জানতে পারেন। মারগারি তখন হেগ শহরে। তিনি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। ২০ শে এপ্রিল ১৯১৭ তে অ্যাভান্তিতে গ্রামশির একটি লেখা প্রকাশিত হয়। মরগারির এই প্রচেষ্টা নিয়ে। যেহেতু প্রবল উৎসাহ তখন ইতালির সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে রাশিয়ায় আসলে কি হচ্ছে, তা জানার। গ্রামসি রাশিয়া সম্পর্কে তাঁর এই প্রথম লেখায় মরগারিকে ‘লাল অ্যাম্ব্যাসডার’ বলে অভিহিত করেন। গ্রামসি তখন বিশ্বাস করতেন যুদ্ধের মুখোমুখি হবার জন্য ইতালির শ্রমিক শ্রেণির প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য শক্তির সরাসরি সম্পর্ক আছে রাশিয়ার সর্বহারাদের শক্তির সাথে। তিনি মনে করতেন রাশিয়ার বিপ্লবের সাথে সাথে সমস্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলগত পরিবর্তন হবে।
শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদের যে তত্ত্বে আমরা বিশ্বাস করি, নভেম্বর বিপ্লব যার ভিতের উপর দাড়িঁয়ে, কমিউনিস্ট ইস্তাহারে যার আহ্বান আমরা শুনি/পড়ি, তার ভ্রুণ আমরা গ্রামসির এই অবস্থানে খুঁজে পাই। গ্রামসির যুদ্ধ বিরোধী মনোভাব আমরা বুঝতে পারি মরগারি সংক্রান্ত প্রবন্ধে। সেখানে প্যান-রাশিয়ান সোভিয়েত সম্মেলনে গৃহীত রাশিয়ার সমাজ-গণতান্ত্রিকদের এক বিবৃতি তিনি উদ্ধৃত করেন যা ইতালির Corriere della sera পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত। সেই বিবৃতিতে ইউরোপের সমস্ত সরকারের কাছে তাদের সমস্ত সামরিক আগ্রাসন পরিত্যাগ করার আবেদন করা হয়। জার্মানীর আক্রমণকে আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গীতে অতিক্রম করার আবেদন করা হয়। বোঝাই যায় দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সভায় গৃহীত প্রস্তাবের সাথে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ। যে প্রস্তাব লেনিনের পার্টি ছাড়া দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে অংশগ্রহণ কারী কোন দেশের পার্টি মানেননি। অ্যাভন্তিতে পরে এই সম্মেলনের প্রস্তাবলী (জুনিয়রের অনুবাদ) ছাপা হয়। ইতালির সমাজতন্ত্রী /সমাজ গণতান্ত্রিকরা রাশিয়া থেকে নতুন নতুন যে খবর পৌঁছাচ্ছিল, তার বিশ্লেষন করে রাশিয়ার ঘটনাবলীকে নতুন ‘ফ্রান্সের বিপ্লব’ বলে ব্যাখ্যা করতে চাইছিলেন। জ্যাকোবিয়ান মডেল বলে অভিহিত করছিলেন। গ্রামসি এর ব্যতিক্রম। তিনি তাঁর নিজস্ব মতামত তৈরী করছিলেন। Il Grido popoloতে এপ্রিলের শেষের দিকে তিনি রাশিয়ার বিপ্লব সম্পর্কে একটি নোট প্রকাশ করেন। প্রচলিত মতের বিপরীতে তিনি রাশিয়ার ঘটনাবলীকে ‘সর্বহারার প্রচেষ্টা’ বলে অভিহিত করেন যা নেতৃত্ব দেবে সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যেতে। রাশিয়া সম্পর্কে গ্রামসির এটি দ্বিতীয় লেখা। গ্রামসি মনে করেছিলেন আন্দোলনের প্রবহমানতা বজায় রাখতে, শ্রমিকদের বিপ্লবের দিকে অগ্রসর করাতে রাশিয়ার সমাজ-গণতন্ত্রীদের নির্দিষ্টভাবেই জ্যাকেবিয়ান মডেলের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। কারণ এই মডেল চিহ্নিত হয়ে আছে ধারাবাহিক হিংসা ও নীচ সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সাথে। গ্রামসির সাথে পি এস আই এর মধ্যেকার আরো যৌক্তিক ও যুদ্ধবিরোধী অংশের যোগাযোগ আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি তিনি বলশেভিকদের বক্তব্য কাজ ও আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। যার পরিণতি প্রাপ্তি ঘটে রাশিয়ান ম্যাক্সিমালিষ্ট (Russian Maximalists) প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে নভেম্বর বিপ্লবের নেতা ভি আই লেনিনের প্রতি গ্রামসি তাঁর পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। এই প্রবন্ধে তিনি ব্যাখ্যা করেন ‘ম্যাক্সিম্যালিষ্ট রাজনীতির অর্থ কি’। তাঁর কথানুযায়ী ম্যাক্সিম্যালিজম হ'ল ‘বিপ্লবের ধারাবাহিকতা, বিপ্লবের ছন্দ ও শেষ পর্যন্ত বিপ্লব নিজেই।’ তার মতে ম্যাক্সিম্যালিজম হ'ল ‘সমাজতন্ত্রের সীমাবদ্ধ চিন্তার অবয়ব, অতীতের প্রতি যার কোন দায় নেই’। গ্রামসি মনে করতেন বিপ্লবকে মাঝপথে আটকে রাখা যায় না, তাকে বুর্জোয়া বিশ্বকে অতিক্রম করতেই হবে। বিপ্লবের বিশেষ করে রাশিয়ার বিপ্লবের সবচাইতে বড়ো বিপদ হ'ল এই ভাবনা ছড়িয়ে পড়া যে প্রক্রিয়াটি সমাপ্তি বিন্দুতে পৌঁছেছে। ম্যাক্সিম্যালিস্টরা এই আটকে রাখার বিরুদ্ধে, তাই এটি বিপ্লবী প্রক্রিয়ার শেষ যৌক্তিক সূত্র। গ্রামসির কাছে বিপ্লবী প্রক্রিয়া হ'ল এক শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলনের ঘুর্ণন প্রক্রিয়ার সাথে আবদ্ধ। এই পর্যায়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কঠোর পর্যবেক্ষণমূলক পাঠ জরুরী।
আগের অনুচ্ছেদের এক অসতর্ক পাঠে মনে হতে পারে গ্রামসি ট্রটস্কির ‘একটি দেশে সমাজতন্ত্র সম্ভব নয়। তাই গোটা বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রয়োজন’ - এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। আবার এটাও মনে হতে পারে মার্কস বর্ণিত সমাজের বিভিন্ন স্তর (উৎপাদন স্তর) অতিক্রম করেই বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে অগ্রসর হতে হয়। চর্চা এগোক। দেখা যাক গ্রামসি কোথায় নিয়ে যান আমাদের। গ্রামসির চিন্তা থেকে ১৯১৭'র ইতালির জমিতে আবার ফিরতে হবে। গ্রামসির চিন্তার উত্তরণ অনুধাবন করতে। ১৯১৭ সালের ৫ আগস্ট জোসিফ গোল্ডেনবার্গ ও আলেকজান্ডার স্মিরনভ’কে নিয়ে গঠিত রাশিয়ার এক প্রতিনিদিদল তুরিনে এসে পৌঁছায়। তাদের এই সফর ইতালির সরকার অনুমোদিত। সরকারের আশা জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার সরকার যোগ দেবে। পিএসআই নেতৃবৃন্দও অপেক্ষায়, রাশিয়া সম্পর্কে রাশিয়ার সরকারের অবস্থান জানার জন্য। তারা এই প্রতিনিধি দলের সম্বর্ধনার ব্যবস্থাও করেন। Il Griedo Popolo তে সেই সমাবেশের বিষয় লেখেন গ্রামসি। কিন্তু প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনার পর পিএসআই নেতৃবৃন্দ হতাশ হ'ন। ১১ আগস্ট Il Grrico del Popolo পত্রিকার সম্পাদক পত্রিকায় লেখেন ‘যখন আমরা শুনলাম রাশিয়ার প্রতিনিধিরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পক্ষে ওকালতি করছেন, আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি, এর অর্থ কি এটা নয় যে রাশিয়ার সর্বহারাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পুঁজিবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্য যুদ্ধে যোগ দেবার ইচ্ছা বা যুদ্ধকে গ্রহন করার ইচ্ছা?’ কেরেনেস্কি সরকারের স্বরূপ উন্মোচিত হ'ল। আগস্ট মাসেই তুরিনে রুটির দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। যুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে যার সরবরাহ অনিয়মিত থেকে বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। বেকারী ও কারখানা লুঠ হয়। কারো আহ্বান ছাড়াই এই বিক্ষোভ বা সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে। এক রাজনৈতিক চেহারা এই আন্দোলন গ্রহণ করে। ২৪ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলে। পুলিশ ও মিলিটারির গুলিতে ২৪ জন শহীদ হ'ন। ১৫০০ গ্রেপ্তার হ'ন। প্রায় দু ডজন সমাজ-গণতান্ত্রিক নেতা ও কর্মী গ্রেপ্তার হ'ন। তাৎক্ষণিক অভ্যুত্থানের অবসান হয়। এই সময় জুড়ে Il Grido del’র প্রচার ও প্রকাশ বন্ধ থাকে। ১লা সেপ্টেম্বর থেকে গ্রামসির দায়িত্বে তা আবার প্রকাশিত হতে শুরু করে। কারণ সমাজ- গণতান্ত্রিক নেতা মারিয়া গিউডাইস গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেন্সরের কঠিন নিষেধ তখন জারি। অভ্যুত্থানের খবর ছাপা যাবে না। এই রকম পরিস্থিতিতেও গ্রামসি সুযোগ খুঁজছিলেন নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সুস্পষ্ট করার। সু্যোগ মিলতেই তিনি লিখলেন ‘কেরেনেস্কি ঐতিহাসিক প্রাণঘাতী ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই লেনিন প্রতিনিধিত্ব করেন সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠার। আমরা আমাদের সবরকম উৎসাহ ও উদ্যমের সাথে লেনিনের সাথে’ এই লেখা তিনি লেখেন রাশিয়াতে জুলাই মাসে ঘটা এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে বলশেভিকদের উপর নিপীড়ন করা হয় এবং যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন বাধ্য হ'ন ফিনল্যাণ্ডে আশ্রয় নিতে। দুনিয়া কাঁপান দশ দিনের ঘটনা তখন পাঁচ দিনে পা দিয়েছে। নভেম্বরের ১২ তারিখ ইতালির সৈন্যবাহিনী ক্যাপোরেট্রোর যুদ্ধে পরাজিত হ'ল। সমাজ-গণতান্ত্রিকদের সংসদীয় অংশের দুজন ফিলিপ টুরাটি ও ক্লদিও ট্রোভসে ‘জাতীয়তাবাদী’ অবস্থান গ্রহণ করে পিএসআই এর বিগত সময়কার ‘নিরপেক্ষতা'র অবস্থান থেকে সরে আসেন। তাঁরা Critica Socialle পত্রিকায় এক প্রবন্ধে বিপদের সময় দেশের সর্বহারাকে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। পিএসআই-এর মধ্যে দোলাচল তৈরী হয়। এর মধ্যেকার স্থির থাকতে না পারা বিপ্লবী অংশ ফ্লোরেন্সে এক সভায় মিলিত হ'ন। নতুন পরিস্থিতিতে করণীয় কি তা ঠিক করার জন্য। গ্রামসি এই সভায় ছিলেন। দুটি মত বেরিয়ে আসে। আমাদেও বোর্দিগা যিনি পরে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্পাদক হবেন, তার মত ছিলো এটাই যে সেই সময় যখন জঙ্গী আন্দোলনে নামা প্রয়োজন। পিএসআই-এর প্রধান সেরেটি ও তার অনুগামীরা পুরোন নিরপেক্ষতা ধরে রাখার পক্ষে। যা স্থবিরতার নামান্তর। সভা শেষ হয় বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতার উপর আস্থা জ্ঞাপন ও যুদ্ধের বিরোধীতার অবস্থান বজায় রেখে। গ্রামসির মত ছিলো আন্দোলন শুরু করার পক্ষে। আশাবাদ ও বলশেভিকদের ক্ষমতা দখল দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে ডিসেম্বর মাসে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘পুঁজির বিরুদ্ধে বিপ্লব’ ইংরেজিতে Revolution Against Capital।
গ্রামসির এই লেখায় নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে তাঁর ধারণা অনেকটাই স্পষ্ট। এই লেখায় তিনি ঘোষণা করছেন ‘বলশেভিক বিপ্লব নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার জনগণের সাধারণ বিপ্লবের ধারাবাহিকতা’। স্থবিরতা থেকে বিপ্লবকে রক্ষা করতে লেনিনের পার্টিজানেরা ক্ষমতার অবস্থানে এসেছেন ‘তাদের একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে, বিস্তৃত করতে’ সেই সামাজিক শক্তিগুলিকে, যাকে বিপ্লব নিশ্চিতভাবেই মানানসই করবে যাতে ধরণগুলির বিকাশ সুরেলা ভাবে হয়’। গ্রামসির মতে বলশেভিক বিপ্লব ‘ঘটনার থেকে বেশি মতাদর্শের উপর দাঁড়িয়ে’। সেই কারণে এই বিপ্লবকে ‘মার্কসের লেখার’ ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যাবে না। গ্রামসি মন্তব্য করছেন ‘পুঁজি গ্রন্থ’ রাশিয়ায় ‘শ্রমিকদের তুলনায় বুর্জোয়াদের জন্য’। এখানে গ্রামসি পুঁজি গ্রন্থের ১৮৬৭ সালের ভূমিকার কথার প্রেক্ষিতে মন্তব্য করছেন। সেখানে মার্কস বলছেন, যে দেশগুলিতে পুঁজিবাদের বিকাশ তুলনামূলক ভাবে বেশি, তারা অনুন্নত দেশগুলিকে পথ দেখাবে। ‘প্রগতির স্বাভাবিক ধাপগুলিকে এড়ানো যায় না’ স্বাভাবিকভাবেই মার্কসের তত্ত্বানুযায়ী মেনশেভিকরা রাশিয়ার সামাজিক বিকাশের যে সূত্রায়ণ করেন তা হ'ল- বুর্জোয়া শ্রেণি গঠন,এক সম্পূর্ণ ভাবে বিকশিত শিল্পায়িত সমাজ আগে গড়ে তুলতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজ গঠনের আগে। সত্যিই তো বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়াকে বলা হত ইউরোপের পিছনের উঠোন। এত পিছিয়ে পড়া ছিলো রাশিয়ার সামাজিক -অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। ফলে সাদা চোখে মার্কসের নিদান অনুযায়ী মেনশেভিকদের সূত্রায়ন ভুল বলা কঠিন।
গ্রামসি কি বলছেন? তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিরা ‘সঠিক অর্থে মার্কসবাদী না। অর্থাৎ যদিও তারা মার্কসের অন্তর্নিহিত অর্থ প্রত্যাখান করেন না, তারা পুঁজি গ্রন্থের কিছু বিকৃতি ত্যাগ করেন’, এবং একে ‘এক বহিঃস্থ ছোট মতবাদ হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন যা তর্কাতীত ও একগুঁয়ে বিকৃতিতে পরিপূর্ণ। গ্রামসি তার অবস্থান ব্যাখ্যাও করেছেন। পুঁজিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে মার্কসের ভবিষ্যতবাণী এক স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে সঠিক। যেখানে ‘জনপ্রিয় ইচ্ছার’ গঠন চলে একগুচ্ছ দীর্ঘ শ্রেণি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু যুদ্ধ রাশিয়ার সমাজের এই অস্থিরতা, সাময়িক সামাজিক কাঠামোকে তরান্বিত করেছে, এমন এক অনির্দেশ্য পথে যাত্রা করিয়েছে যে তিন বছররের মধ্যে রাশিয়ার শ্রমিকরা নিম্নোক্ত প্রভাবগুলি গভীরভাবে অনুভূত করেছে- ‘জীবনযাত্রার উচ্চ মূল্য, ক্ষুধায় মৃত্যু পৌঁছেছে সবার কাছে, একসাথে কয়েক মিলিয়ন মানুষের ধ্বংস’। এর বিরুদ্ধে মতামত ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, প্রথমে যান্ত্রিকভাবে, তার পর প্রথম বিপ্লব (ফেব্রুয়ারী), এর পর আত্মিকভাবে। এই একত্রিত হওয়া জনপ্রিয় ইচ্ছা সমাজতন্ত্রীদের প্রচার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে, বর্ধিত হয়েছে। এই সমবেত জনপ্রিয় ইচ্ছাই এক ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে রাশিয়ার শ্রমিকদের এক নিমেষে সর্বহারার পূর্ণ ইতিহাসে বাঁচতে সাহায্য করেছে। শ্রমিকরা তাদের পূর্ব প্রজন্মের প্রচেষ্টাকে পুনর্গঠিত করেছে যাতে তারা নিজেরা নিজেদের ‘দাসসুলভ বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারে, হতে পারে ‘ভবিষ্যতের পৃথিবীর বর্তমান সাক্ষী’। তারা এই চেতনায় আসছে যখন আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। রাশিয়ার সর্বহারারা দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ অর্জন করবে যা এই একত্রীকরণের পূর্বশর্ত। ১৯১৭ থেকে ১৯২৬ তার গ্রেপ্তার হওয়া অবধি এবং ১৯৩৭ তার মৃত্যুর আগে অবধি, নভেম্বর বিপ্লব ও লেনিনের নেতৃত্বের বিষয়ে গ্রামসি তার অবস্থান পরিবর্তন করেছেন বলে কোন কথা জানা যায় না। তাঁর কারা রচনাতেও এমন কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।