স্বাস্থ্য–বাজার-পুঁজি-মুনাফা (পর্ব-১)

প্রাককথন

শারদোৎসবের সময়। কলকাতার রাজপথে জুনিয়র চিকিৎসকেরা অনশন করছেন। সিনিয়র চিকিৎসকেরাও তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন, অনশন মঞ্চে সক্রিয় উপস্থিতির পাশাপাশি ন্যায্য দাবীর লড়াইকে মজবুত করতে রীতিমত সোচ্চার হচ্ছেন। যদি শুধু এটুকুই কথা হত তবে সম্ভবত বিষয়টি ডাক্তারদের ব্যাপার-স্যাপারে পরিণত হত। তেমনটি আদৌ ঘটেনি, প্রথম থেকেই এ লড়াই গণআন্দোলনের চেহারা নিয়েছে। গোটা রাজ্য, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি বিদেশের মাটিতেও তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। বিচার মানে কি কেবল একজন মহিলা চিকিৎসকের নৃশংস অত্যাচার ও মৃত্যুর প্রতিবাদ? যে ব্যবস্থা, যে তন্ত্র এমন পরিবেশ তৈরি করে অথচ একের পর এক ঘটনাকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে, বুঝতে ও দেখাতে সমর্থ হয়েছে তাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করানোই আজকের লড়াইতে অন্যতম প্রসঙ্গ।

ঠিক এখানেই শাসকের অস্বস্তি। যত বেশি করে এ লড়াই, এ আন্দোলন মানুষের মূল লড়াইের কাছাকাছি যাবে, মূল লড়াইয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে ততই সামনে চলে আসবে আসলে কারা দায়ী? কাদের দায়?

শাসকের বহু প্রচেষ্টার পরেও যা কিছু ঘটছে তাতে স্পষ্ট মানুষ কিছুতেই ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইছেন না। লড়াইটা কিছুতেই একজনের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় পর্যবসিত হচ্ছে না। রাজপথের জনরোষ গণবিক্ষোভে রূপান্তরিত, এতে পর্দার আড়াল নেই। আড়াল যদি কোথাও থাকে তবে তা রয়েছে একে দেখার, দেখানোর কৌশলে। এ হল সেই পন্থা যাতে ধরে নেওয়া হয় জনসাধারণ অনেকটা মাটির তালের মতো, চাইলেই চাপ দিয়ে তার আকৃতি বদলে দেওয়া যায়। এর বিপরীতেই মানুষের লড়াই। এর প্রতিরোধই এ মুহূর্তের কর্তব্য।

একদিকে জনগণ, আরেকদিকে গণশত্রুরা।

এ লড়াই শেষ অবধি সকলের। উৎসবের আবহ মানুষকে ভাগ করেনি, তাদের একে অন্যকে পরস্পরের আরও পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে।

সে কথাই তিন পর্বে প্রকাশিত হচ্ছে।

আজ প্রথম পর্ব।

সম্পূর্ণ লেখাটি প্রকাশিত হবে পর পর তিনদিন, রাজ্য ওয়েবসাইটের নিজস্ব প্রতিবেদন।

শ্যামাশীষ ঘোষ

ডাক্তারদের আন্দোলন–ন্যায়বিচারের দাবি

আর জি কর হাসপাতালে – তিলোত্তমার নিজের কর্মক্ষেত্রে – তাঁর উপর ঘটে যাওয়া নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়বিচারের দাবিতে চিকিৎসকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন আমাদের রাজ্যের জনমানসে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে নিঃসন্দেহে। রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা দেশের এবং বিদেশের মানুষের মনেও ছাপ ফেলেছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত এই আন্দোলনকে মান্যতা দিয়ে এই জঘন্য অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে সি বি আইয়ের তদন্তের নজরদারির ভার নিয়েছে। সি বি আই এই অপরাধের এবং তার সঙ্গে এই ঘটনার তথ্যপ্রমাণ লোপ করার কাজে দোষীদের খুঁজে বার করার এবং উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের কাজে নিযুক্ত। সুতরাং ন্যায়বিচারের প্রাথমিক বিষয় অর্থাৎ দোষীদের শাস্তিপ্রদানের দায়িত্ব সিবিআই’র হাতে।

জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে রাজ্য সরকারের কাছে যে দাবিপত্র পেশ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় দুর্নীতি, হুমকি সংস্কৃতির সমূল উৎপাটন। মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কাউন্সিল, স্বাস্থ্য দফতর এইসব এবং অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এদের তৈরি করা নানা কমিটি ইত্যাদির মাধ্যমে বিগত কিছু বছর ধরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। এই দুর্নীতির রক্ষণাবেক্ষণে পুলিশ সহ সরকারি প্রশাসনও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে অনুমান করা হচ্ছে। সুতরাং, নিছক একটি খুন-ধর্ষণের ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলনের থেকে আর একটু উচ্চস্তরে উঠতে পেরেছে এই আন্দোলন – যে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা সেই ঘটনার জন্য দায়ী, সেই ব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আমাদের রাজ্যে বা দেশে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব, লিঙ্গবৈষম্য দূর করার প্রশ্নও উঠে এসেছে এই আন্দোলনে। কর্মক্ষেত্রে ডাক্তারদের নিরাপত্তা, সঠিক পরিকাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য উপযুক্ত পরিষেবা নিশ্চিত করতে দরকার এই বাস্তুঘুঘুদের বহিষ্কার এবং শাস্তি। কেবলমাত্র নিরাপত্তারক্ষী বা সিসি ক্যামেরার সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা যায় না, একথা সরাসরি বলতে পেরেছে এই আন্দোলন। সেই অর্থেও এই আন্দোলন একটা উত্তরণের দিশা দেখাচ্ছে। এটা নজর করার এবং আশা রাখার মত একটি বিষয়।

ডাক্তারদের এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কলকাতা শহর এবং শহরতলিতে মানুষের মধ্যে যে ব্যাপক সাড়া এবং নাছোড় মনোভাব দেখা গেছে এবং যাচ্ছে, তা অভূতপূর্ব। গ্রামাঞ্চলেও এই আন্দোলনের অনুরণন দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারদের তরফ থেকে বারবার এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক বলা হচ্ছে; সাম্প্রতিককালের রাজনীতির কদর্য চেহারা দেখে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষের কাছেও এই অরাজনৈতিক অভিধা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এত বড় জনসমর্থন না থাকলে শুধু ডাক্তারদের আন্দোলন হিসাবে এর পক্ষে শাসকের চোখে চোখ রেখে একটা দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বেশ শক্তই হত। বর্তমান শাসকদল রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সব শক্তি ব্যবহার করছে এই আন্দোলনকে শেষ করতে, অন্যায় চাপা দিতে। সুতরাং এর একটা রাজনৈতিক চেহারা থাকতে বাধ্য। যেভাবে ডাক্তারদের এই দাবিগুলি নিয়ে টালবাহানা চলছে, তার থেকে দিনে দিনে যেটা পরিষ্কার হচ্ছে, তা হল এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রতিষ্ঠাতা এবং পৃষ্ঠপোষক যে সরকার, তাদের না সরিয়ে সম্ভবত বিশেষ কোনো লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয়। মুলস্রোতের নাগরিক সমাজের এই আন্দোলনের পাশাপাশি উপস্থিত গঠনাত্মক রাজনৈতিক আন্দোলনও নজর এড়িয়ে যেতে পারে না। নাগরিক সমাজের আন্দোলনেও বিভিন্ন মত ও পথের রাজনৈতিক মানুষেরা থাকছেন, পতাকা ছাড়াই। এর পাশাপাশি পতাকা এবং বামপন্থী মতাদর্শ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ছাত্র, যুব, মহিলারা। সংগঠিত বামপন্থী শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুরদেরও দেখা গেছে পথে। এই দুটি ধারা যতক্ষণ একে অন্যের পরিপূরক থাকবে, ততক্ষণই এই আন্দোলন জোরের সঙ্গে টিকে থাকতে সক্ষম হবে। তাই এই আন্দোলন অবশ্যই রাজনৈতিক, তবে দলীয় রাজনীতির নয়, সমগ্র নাগরিক সমাজের। সাধারণ মানুষের এই ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠা একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সচেতন ‘নাগরিক’ই পারে বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে কোনো সরকারের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত অবশ্যই প্রশ্ন করতে শেখা। সচেতনতা দরকার, কয়েকটি পরিষ্কার বোঝাপড়া দরকার।

বৃহত্তর প্রেক্ষিত

দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা আমাদের আরো গভীরে নিয়ে যায়, কাঠামোগত বিষয়ে – নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয়, উগ্র দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দুর্নীতির সনাতন সংজ্ঞাটি হল, ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত লাভ বা স্বার্থসিদ্ধি। এখানে দুর্নীতির পরিসরটি অনেকটাই সীমিত হয়ে যেন ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিন্তু এই নব্য উদার অর্থনীতির যুগে, মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরে আর সবকিছু নির্ভর করে না। তাই এই সীমিত সংজ্ঞাটির বদলে আমরা তাকাতে পারি রাজনীতির অধ্যাপক স্টিফেন মরিস-প্রদত্ত সংজ্ঞায় – রাজনৈতিক দুর্নীতি হল ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাউফম্যান দুর্নীতির ধারণাটি প্রসারিত করেছেন ‘আইনি দুর্নীতি’কেও অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে, যেখানে আইনের সীমার মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয় – কারণ ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের সুরক্ষার জন্য আইন তৈরি করার ক্ষমতা, এবং একইসাথে প্রয়োজনে সেই আইনকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা রাখেন। অর্থাৎ, বৃহত্তর বোঝাপড়ায়, জনগণ-প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির স্বার্থরক্ষা। দুর্নীতি বলতে, এটি বুঝতে পারলে, তবেই পৌঁছতে পারা যাবে সমস্যার গোড়ায়। সুতরাং, শেষ বিচারে, আমাদের তাকাতেই হবে সেই ব্যবস্থা বদলানোর অভিমুখে।

মোটামুটি, বিগত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকেই, দেশে আর্থিক উদারবাদের পা রাখার সাথেসাথেই, আমরা এদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বৃহৎ পুঁজির রমরমা দেখতে পাই। শুধু স্বাস্থ্য কেন, শিক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এটা দেখা গেছে। তবে এই আলোচনায় আমরা স্বাস্থ্যের বিষয়টিতেই নজর রাখব। চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রাইভেট সেট-আপ তার আগেই ছিল, ক্রমে দেশীয় পুঁজিরও প্রবেশ ঘটেছিল স্বাস্থ্য পরিষেবায়। তবে নব্বুইয়ের দশকে বৃহৎ পুঁজির প্রবেশ দেশের চিকিৎসার চালচিত্রে বড়সড় পরিবর্তন আনল। দেখা গেল – ১) চিকিৎসা পরিকাঠামোয় অভাবনীয় উন্নতি, ২) চিকিৎসার লাগামছাড়া ব্যয়; প্রাণে বাঁচতে গিয়ে ধনেপ্রাণে মারা যাওয়ার উপক্রম, ৩) চিকিৎসকদের সামাজিক অবস্থানের অবনতি।

চিকিৎসা পয়সা দিয়ে কিনতে হবে, চিকিৎসাকে ক্রেতাসুরক্ষা বিধির আওতায় এনে এই ‘সিস্টেম’কে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন – এবং, চিকিৎসকদের মধ্য থেকে অল্পবিস্তর বিরোধিতা এলেও, সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে সেরকম কোনো প্রতিবাদ আসেনি। চিকিৎসকদের বিরোধিতার বড় যুক্তিটি ছিল চিকিৎসার মতো পেশার পক্ষে এমন আইনের প্রয়োগ অবমাননাকর। চিকিৎসা যে ক্রয়যোগ্য পণ্য হতেই পারে না, এমন কথা জোরগলায় বলার লোক বেশ কম। যেমন কড়ি ফেলা হবে, তেমন চিকিৎসার বন্দোবস্ত হবে, এমত ভাবনা ‘সিস্টেমে’ পরিণত হতে শুরু করেছিল আগে থেকেই। এখনও লড়াই, প্রতিবাদ যা হচ্ছে তা ওই ‘সিস্টেম’কে শিরোধার্য করেই – অর্থাৎ, বিল বেঁধে দেওয়া যায় কিনা, প্যাকেজ অতিক্রম করে আরও অর্থ আদায় অনুচিত কিনা, সরকার গরিব মানুষের চিকিৎসার বিল মেটাবেন কিনা, ইত্যাদি।

চিকিৎসকেরা, যাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া সম্ভবই নয়, তাঁদের একাংশও এই ‘সিস্টেম’-এর সমর্থক। আরও একটি বড় অংশ এই ‘সিস্টেম’কে পুরোপুরি সমর্থন না করলেও, এমনকি ‘সিস্টেম’টি মূলগতভাবে অন্যায় বলে বিশ্বাস করলেও, একে মেনে নিতে শুরু করেছেন, সেই There is no alternative! অথচ, এই চিকিৎসকই যখন পেশেন্ট বা পেশেন্টপার্টিতে রূপান্তরিত হয়ে টেবিলের অন্য দিকে বসেন, তখন এই সিস্টেমটির স্বরূপ উন্মোচিত হয় তাঁর কাছে – এবং, সেটা অনেক সময়েই, সুখকর নয়। নিজের গায়ে আঁচ আসা অবধি সবই মেনে নেওয়ার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। আর, এই প্রতিটা মেনে নেওয়া, প্রতিটা প্রতিবাদহীন সম্মতি ‘সিস্টেম’কে মজবুত করতে থাকে অবিরত।

নব্বই দশক নাগাদ, মুক্ত অর্থনীতির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা শুনতে লাগলাম, সরকারি হাসপাতাল সাক্ষাৎ নরক, সেখানকার ডাক্তাররা ফাঁকিবাজ, দুর্ব্যবহারী ইত্যাদি। এর পাশাপাশি, কলকাতাতেই এসে গিয়েছে বিশ্বমানের চিকিৎসা, চিকিৎসাপরিষেবা, ওই পাঁচতারা হোটেলের মত হাসপাতালগুলিতে। ঝাড়া সিকি দশকের এইরকম মগজধোলাইয়ের পরে, আমরা এই ব্যবস্থাকেই মান্যতা দিয়ে দিয়েছি – There is no alternative! সরকারি ব্যবস্থা অবশ্যই নিখুঁত নয়। অন্তত এদেশে তো বটেই। কিন্তু, সেটা প্রধানত ডাক্তার ও পরিকাঠামোগত অভাবের কারণে, এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের অনিচ্ছার কারণে। যে-সংখ্যার চিকিৎসক মিলে যে-সংখ্যার রুগী সামলানো হয় সরকারি স্বাস্থ্যকাঠামোয়, আর সেই চিকিৎসার ফল বেশির ভাগ অসুখের ক্ষেত্রেই বিশ্বের গড়ের চাইতে কম নয়, সেটা কি সাফল্য নয়? দক্ষতা নয়?

এই নগ্ন শোষণ ব্যবস্থায়, অনেকসময়ই শোষকের মুখটি থাকে আড়ালে। যে-মুখকে সামনে রেখে শোষণ চলে, তিনিও আসলে শোষিত। কর্পোরেট মালিক মুনাফা আদায় করলেও, সামনে মুখ থাকে চিকিৎসকের, রোগীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের ঠেলা সামলাতে হয় তাঁকেই – শোষক বনাম শোষিতের এই বাইনারিতে তাঁর অবস্থান ঠিক কোথায়? এরপর, চিকিৎসার লাগামছাড়া খরচের মোকাবিলায় এসে গেল বেশি বেশি কভারেজের স্বাস্থ্যবিমা – আরো এক কর্পোরেট। সরকার সরাসরি বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার দায় ঝেড়ে ফেলল। আর এই খেলায় টিকতে না-পেরে রিং-এর বাইরে ছিটকে পড়ছে সাধারণ মানুষ – অবিরত। আর আমরা বলে যাচ্ছি, There is no alternative!

উদার অর্থনীতির বড় প্রবক্তা খোদ আমেরিকায়, বিল ক্লিন্টন বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘প্রতিযোগিতার ওপর নির্ভর করে ভালো ভালো নীতি প্রণয়ন করা গেলেও, সারা পৃথিবী জুড়ে থাকা সমস্যা – যেমন জলবায়ুর বদল, বিভিন্ন অসুখবিসুখ – এসবের সমাধানের জন্য প্রতিযোগিতার চাইতে অনেক বেশি জরুরি হল সহযোগিতা, হাতে হাত ধরে চলার মানসিকতা। বিশেষ করে গরিব, প্রান্তিক মানুষজনের সমস্যাগুলো মেটাতে হলে এই কথাটা আরো বেশি প্রযোজ্য – আর মুশকিল হল, তুলনামূলকভাবে, সমস্যাগুলো গরিব বা প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে অনেক বেশি।’

স্বাস্থ্যপরিষেবাকে যদি বাজারের অনিবার্য নিয়ম মেনে নিয়ে প্রতিযোগিতার হাতে ছাড়া হয়, তাহলে হাজার নিয়ম বা নজরদারি দিয়েও পরিস্থিতির বদল হতে পারে না। প্রথমেই স্পষ্ট করে বোঝা দরকার, দুর্নীতির শিকড় লুকিয়ে এখানেই। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা একটি পণ্য, চিকিৎসার মত একটি অত্যাবশ্যক বিষয়কে যে মুনাফা-অর্জনের প্রতিযোগিতার হাতে ঠেলে দেওয়া যায়, এমন ভাবনার মধ্যেই দুর্নীতির বীজটি লুকিয়ে। কয়েকশো ওষুধ কোম্পানি তাদের পণ্য বিক্রয় করার জন্য প্রাণপণ বিপণন করে চলবেন, কয়েক হাজার ল্যাব বা ডায়গনস্টিক সেন্টার একই পরীক্ষা করবেন, সেই পরীক্ষার খদ্দের খুঁজবেন, পাশাপাশি অবস্থিত একই ধাঁচের দুই কর্পোরেট হাসপাতাল রোগী আকর্ষণের প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন প্যাকেজের ব্যবস্থা করবেন বা ডাক্তারবাবুরা যাতে রেফার করেন সেইজন্য তাদের বিভিন্ন উপঢৌকনের ব্যবস্থা রাখবেন, আর আমরা ভাববো, স্রেফ নজরদারির কড়াকড়ি করলেই সমস্ত অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে? এই ব্যবস্থা বলবত রেখে কোনোভাবেই দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করা সম্ভব নয়। এই-ব্যবস্থায় ওষুধ কোম্পানির বার্ষিক বাজেটের একটা বিরাট অংশ মার্কেটিং-এর জন্য বরাদ্দ হচ্ছে। এই-ব্যবস্থায় বেসরকারি হাসপাতালকে মোটা মাইনে দিয়ে মার্কেটিং টিম পুষতে হয়, আর হাসপাতালের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই মার্কেটিং টিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ম্যানেজমেন্ট ক্লাসে এই পাঠই নিত্য শেখাচ্ছেন ম্যানেজমেন্ট গুরুরা। সেই ব্যবস্থা বজায় রেখে দুর্নীতির মোকাবিলা সম্ভব নয়।

ব্যবহৃত ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

শেয়ার করুন

উত্তর দিন